শুক্রবার, ৭ জুন, ২০১৩

সরকারের দিন গণনা শুরু : প্রসঙ্গ পররাষ্ট্রনীতি


কথাটা আমাদের নয়, ঘোষণার আকারে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ২৫ অক্টোবর তারা জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেবেন এবং তারপর সংবিধান অনুযায়ী নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সত্যি তেমন কোনো নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হতে পারবে কি না এবং হলেও বিরোধী দলগুলো সে নির্বাচনে অংশ নেবে কি নাÑ এ ধরনের কোনো জিজ্ঞাসার উত্তরে যাওয়ার পরিবর্তে অন্য একটি কথা লক্ষ্য করাই বেশি দরকার। সেটা হলো, মূলকথায় প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, তার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার দয়া করে বিদায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। একই কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনেও সরকারের দিন গণনা শুরু হয়ে গেছে। পর্যালোচনা শুরু হয়েছে  সরকারের সাফল্য(?) ও ব্যর্থতার নানাদিক নিয়ে। অন্য কিছু বিষয়ের মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে সরকারের পররাষ্ট্রনীতি। সত্যি বলতে কি, আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো পররাষ্ট্রনীতি আছে এবং সে নীতি অনুসারে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বহাল রাখা ও সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছেÑ এমন কথা সচেতন কোনো মানুষই বিশ্বাস করেন না। সাধারণ মানুষের চাইতে বেশি শিক্ষিত ও বেশি খোঁজ-খবর যে বিদেশীরা রাখে তারা তো নয়ই। এর কারণ সম্পর্কে জানানোর আগে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের ঘোষিত মেনিফেস্টো থেকে অংশবিশেষের উল্লেখ করা দরকার। ছয় হাজার ৭৫৯ শব্দের সে মেনিফেস্টোর একেবারে সবশেষে অর্থাৎ ২৩ নম্বরে ছিল পররাষ্ট্রনীতির প্রসঙ্গ। এর ক. অনুচ্ছেদে দলটি বলেছিল, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এই নীতির আলোকে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রেখে বহুমুখী সহযোগিতা জোরদার করা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে রাশিয়া, চীন ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত অসংখ্য রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে’ উদ্যোগ নেয়ার কথা জানানোর পর গ. অনুচ্ছেদে ছিল মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ‘ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক এবং উন্নয়ন ও সহযোগিতার ক্ষেত্র জোরদার করার’ ঘোষণা। এখানেও কথার মারপ্যাঁচ যথেষ্টই ছিল। যেমন সৌদি আরব, মিশর, প্যালেস্টাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতের মতো দেশগুলোকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের দেশ’ এবং তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোকে ‘মুসলিম দেশ’ হিসেবে উল্লে¬খ করেছিল আওয়ামী লীগ। যার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, দলটির মতে এমনকি সৌদি আরবও ‘মুসলিম দেশ’ নয়, বরং ‘মধ্যপ্রাচ্যের দেশ’! আরো দুটি তথ্যেরও উল্লে¬খ না করলেই নয়Ñ ঘ. অনুচ্ছেদে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় দক্ষিণ এশীয় টাস্কফোর্স গঠন করার এবং ঙ. অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা ‘পুনরুদ্ধার এবং উজ্জ্বল করার’ ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।
পর্যালোচনায় দেখা যাবে, নির্বাচনী মেনিফেস্টোতেই আওয়ামী লীগ বুঝিয়ে দিয়েছিল, দলটি ক্ষমতায় গেলে ঠিক কোন ধরনের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে। এই পররাষ্ট্রনীতি যে সর্বতোভাবেই ভারতমুখী হবে সে কথা বুঝতেও সচেতন মহলের অসুবিধা হয়নি। তা সত্ত্বেও বেশি আশাবাদী অনেকের ধারণা ছিল, নিজেদের ‘ভারতপন্থী’ পরিচিতির দুর্নাম কাটিয়ে ওঠার জন্য হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার অন্তত একটু রয়ে-সয়ে পা বাড়াবেন। অন্যদিকে তারা বুঝিয়ে ছেড়েছেন, ‘কয়লার ময়লা’ বিষয়ক প্রবাদ বাক্যটি অকারণে প্রচলিত হয়নি। ভারতপন্থী হিসেবে তো বটেই, সরকার প্রথম থেকেই ভারতের ইচ্ছাধীন ও অঙ্গরাজ্যের সরকারের মতো পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছে। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যখন একথা বলার সুযোগই নেই যে, বাংলাদেশের স্বাধীন দেশসুলভ নিজস্ব কোনো পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে। কথাটা শেষবারের মতো প্রমাণিত হয়েছে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সফরকালে। দীর্ঘদিন ধরে প্রচারণা চালিয়ে এলেও সরকার তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে ভারতকে দিয়ে স্বাক্ষর করাতে পারেনি। অজুহাত হিসেবে ভারতীয়রা পশ্চিমবঙ্গের ‘বাঙালী’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে সামনে এনেছিলেন। ভারতের স্বার্থে ‘বাঙালী’ নেত্রী মমতা ব্যানার্জিও ঘাড় বাঁকিয়ে বসার কৌশল নিয়েছিলেন। ফলে তিস্তা চুক্তি হিন্দুদের ‘স্বর্গে’ চলে গিয়েছিল।
নিজেরা তিস্তা চুক্তি থেকে পিছিয়ে গেলেও ভারত কিন্তু নিজেরটা কড়ায়-গ-ায় আদায় করে নিয়েছে। অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা কাঠামোগত চুক্তির পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে আসলে সর্বাত্মকভাবেই ভারতের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। এই চুক্তি ১৯৭২ সালের ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তির চাইতেও ভয়ংকর। কারণ, ১৯৭২ সালের চুক্তিতে তবু ২৫ বছরের মেয়াদ উল্লেখ করা হয়েছিল, যার পর চুক্তি বহাল রাখা না রাখার অধিকার পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু কাঠামোগত চুক্তিতে কোনো মেয়াদের উল্লেখ পর্যন্ত রাখা হয়নি। যার অর্থ, বাংলাদেশ কখনোই চুক্তিটি বাতিল বা অকার্যকর করার সুযোগ বা অধিকার পাবে না। চুক্তিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সকল দিক থেকেই বাংলাদেশকে গোলামির জিঞ্জিরে বেঁধে ফেলেছে ভারত। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়ে বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষে ভূমিকা পালন করতে হবে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংস করে দেয়ার কর্মকা-ে বাংলাদেশকে সামরিকভাবেও জড়িয়ে পড়তে হবে। যার ফলে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর যুদ্ধ চলে আসবে বাংলাদেশের ভেতরে।
‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা কাঠামোগত চুক্তি অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এমন কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক রাখতে ও বাণিজ্যসহ দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে লেনদেন করতে পারবে না, যার সঙ্গে ভারতের শত্রুতা বা খারাপ সম্পর্ক রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব অর্জন করেছে বিশেষ করে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। কারণ, স্বাধীনতার পর যুদ্ধে সমর্থন দেয়ার সুযোগ নিয়ে ভারতের সেনারা পাকিস্তানীদের সমুদয় সমরাস্ত্র লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর হিসাবে যার দাম ছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে সামরিক শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর হাতে কোনো অস্ত্রই ছিল না। অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। সে সময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল গণচীন। বস্তুত গণচীনের আন্তরিক সহযোগিতা নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। গাজীপুরস্থ সমরাস্ত্র কারখানায় অস্ত্র তৈরির পাশাপাশি রফতানির পথেও গণচীনই বাংলাদেশকে অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দিয়ে চলেছে। ট্যাংক থেকে যুদ্ধ বিমান পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি সমরাস্ত্র এসেছে গণচীন থেকে। অর্থাৎ গণচীনের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের ফলে চীনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত সুসম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, সরকারের এই ভারতপ্রীতিকে চীন সহজভাবে নাও নিতে পারে। চীন ও ভারতের দ্বন্দ্বমূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই, নিজের সমরাস্ত্রের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে চীনের সতর্কতাও একটি বড় কারণ হয়ে উঠবে। আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে ভারত চীনের সামরিক প্রযুক্তি চালান করে নিয়ে যাবে যা চীনের মতো পারমাণবিক শক্তিধর একটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে চীন সামরিক সহযোগিতা বন্ধও করতে পারে। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবেÑ যার অর্থ, বাংলাদেশ আসলে অঘোষিতভাবে ভারতের অধীনস্থ হয়ে পড়বে।
সীমান্ত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা দেশের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। মনমোহন সিং-এর সফরকালে অমীমাংসিত ও অপদখলীয় ভূমি উদ্ধারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে যে কল্পকাহিনী সরকার শুনিয়েছে বাস্তবে উল্টোটাই দেখা গেছে। যেমন বাংলাদেশকে মাত্র ৩৫৭ একর জমি দিয়ে আসাম পেয়ে গেছে ১২৩৯ একর জমি। এজন্য শুধু নয়, উলফাসহ আসামের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে ‘বলিষ্ঠ ভূমিকা ও সমর্থনের’ জন্যও শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের আরেক রাজ্য মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী ড. মুকুল সাংমাও বাংলাদেশকে ৪১ একর জমি দেয়ার বিনিময়ে ২৪০ একর জমি পাওয়ায় শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন! ওদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশীদের হাজার হাজার একর জমির মালিকানা নিষ্পত্তি না করেই বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শুরু করেছে। এভাবেই সীমান্ত সমস্যার ‘সমাধান’ করেছে শেখ হাসিনার সরকার!
আওয়ামী লীগ সরকার সবচেয়ে নোংরা মিথ্যাচার করেছেন ট্রানজিটের আড়ালে ভারতকে করিডোর দেয়ার প্রশ্নে। তিস্তা চুক্তি না করার কারণে ট্রানজিট (আসলে করিডোর) চুক্তি করা হয়নি বলে প্রচারণা চালানো হলেও বাস্তবে ভারতীয় যানবাহন ইতিমধ্যেই চলাচল শুরু করেছে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকেও ভারতীয় মালামাল পরিবহনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। অর্থাৎ প্রকাশ না করা হলেও সরকার ভারতকে করিডোর দিয়ে ফেলেছে। এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে গত বছরের ৩ জুন স্বাক্ষরিত নৌ-প্রটোকল চুক্তি থেকে।
প্রসঙ্গক্রমে দু-একটি কথা না বলে পারা যায় না। দেখা যাচ্ছে, কাজে-অকাজে শ’ দুই দেশে যাওয়ার মাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বিদেশ সফরের রেকর্ড করলেও বাস্তবে একমাত্র ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো উন্নতি ঘটেনি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও’বে¬ক থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইউ)-এর ১৩টি দেশের বাংলাদেশ সম্পর্কিত মনোভাবের বিশে¬ষণে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। গত বছরের ৯ মে ঢাকায় কর্মরত ইউ-এর ১৩ জন রাষ্ট্রদূত এক সংবাদ সম্মেলনে অভিন্ন ভাষায় যেসব কথা বলেছেন, তার কোনোটিই প্রমাণ করে না যে, এই দেশগুলোর সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সম্পর্ক আদৌ বন্ধুত্বপূর্ণ। এর পরপর ঢাকা সফরে আসা জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দীপু মনি তো প্রকাশ্যেই বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এজন্য দেশের নাম ধরে ধরে উদাহরণ দেয়ার দরকার পড়ে না। পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করার ক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কোনো দেশ বা সংস্থাই নেই। একই কথা মুসলিম দেশগুলোর বেলায়ও সত্য। সৌদি আরবের মতো প্রধান মুসলিম দেশের সঙ্গেও এই সরকার সম্পর্ক তিক্ত করে ফেলেছে, যার কারণে হাজার হাজার বাংলাদেশীকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে। অন্যদিকে ওই চাকরিগুলো পেয়ে যাচ্ছে ভারতীয়রা।
প্রসঙ্গক্রমে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির কিছু বিশেষ দিককে সামনে আনা দরকার। যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সফরকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে প্রধানমন্ত্রী সর্বতোভাবে দু’জন মাত্র উপদেষ্টার হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারা ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দেয়া থেকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, ছিটমহলসহ সীমান্ত সমস্যা এবং তিস্তাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন চুক্তি পর্যন্ত কোনো একটি বিষয়ে আয়োজনের সঙ্গেই সংশ্লি¬ষ্ট মন্ত্রীদের কারো ভূমিকা ‘দৃশ্যমান’ ছিল না। মনেই হয়নি, দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, নৌ পরিবহনমন্ত্রী এবং পানিসম্পদমন্ত্রী রয়েছেন। কারণ, এত বেশি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করার সব আয়োজনের জন্য দু’জন মাত্র উপদেষ্টাকেই দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। অথচ ‘সুপার উপদেষ্টা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই দু’জনের কেউই কিন্তু ‘নির্বাচিত’ জনপ্রতিনিধি নন। তা সত্ত্বেও তাদের ইচ্ছানুসারেই প্রতিটি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা পাত্তাই পাননি। দীপু মনিকে তো বটেই, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন থেকে বিরাট বপুর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পর্যন্ত প্রত্যেক মন্ত্রীকে সোজা দর্শকের গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দুই ‘সুপার উপদেষ্টা’। ফলে ট্রানজিট-করিডোর নিয়ে যার কথা বলার কথা তৎকালীন সে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সড়ক মেরামত করে দিন কাটিয়েছেন। ছিটমহল বিনিময়ের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানেরও কোনো খবর ছিল না। তিস্তাচুক্তি ও পানিবণ্টন নিয়ে এই যে এত হইচই হয়েছে অথচ এসব সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনকে। সবাইকে অন্ধকারে রেখে কাজ গুছিয়েছিলেন ‘সুপার উপদেষ্টা’রা। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছিল, বাংলাদেশে ‘নির্বাচিত’ ও ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের আড়ালে অন্য কোনো সরকারের রাজত্ব চলেছে কি না। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য শেখ হাসিনা এমনকি প্রকাশ্যে মমতা ব্যনার্জির সমালোচনা করারও সাহস পাননি! সব মিলিয়ে ‘নতজানু পররষ্ট্রনীতি’র কথাটাই প্রমাণিত হয়েছে!
উদাহরণ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা যখন দিল্লী¬ গিয়েছিলেন তখনও তার সঙ্গে বিষয়সংশ্লি¬ষ্ট মন্ত্রীরা যাওয়ার সুযোগ পাননি। সেবার সন্ত্রাস দমনসহ দু’দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত তিনটি পৃথক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এবং বৈঠকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম উপস্থিত থাকলেও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সঙ্গে নেননি প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে বাংলাদেশের বিপুল ঘাটতিসহ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য একটি প্রধান বিষয় ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাননি। অন্যদিকে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা কিন্তু ঠিকই উপস্থিত ছিলেন। সমুদ্র বন্দর এবং রেল ও সড়ক পথে করিডোর দেয়ার মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় করার কথা শুনিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এবং তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে দেখা গেলেও বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর কাউকেই সঙ্গে নেননি প্রধানমন্ত্রী। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে শোরগোল তোলা হয়েছিল কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি দলে বাংলাদেশের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীকে দেখা যায়নি। এসবের মধ্য দিয়েও প্রমাণিত হয়েছিল, সর্বতোভাবে ভারতের স্বার্থে সরকার এমন সব পদক্ষেপই নিচ্ছে, যেগুলো এমনকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের জন্যও বিপজ্জনক।
বিষয়টিকে অবশ্যই হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরের ব্যাপারে মন্ত্রীদের শুধু নয়, জাতীয় সংসদকেও কিছুই জানানো হয়নি। এখনো জানানো হচ্ছে না। অথচ, সংবিধানের নির্দেশনা হলো, জাতীয় স্বার্থ সংশ্লি¬ষ্ট যে কোনো বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে চুক্তির খসড়া সংসদে পেশ করতে হবে, পাস করিয়ে নিতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে ভৌগোলিক নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন এসে গেলে বিষয়টি সম্পর্কে জনমত যাচাই ও গণভোট আয়োজন করারও নির্দেশনা রয়েছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার সরকার জনমত যাচাইয়ের জন্য গণভোট আয়োজন দূরে থাকুক, সংসদে তো যায়ইনি, এমনকি সংশ্লি¬ষ্ট মন্ত্রীদের পর্যন্ত ধারে-কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। এমন অবস্থা সংসদীয় গণতন্ত্রে তথা নির্বাচিত সরকারের অধীনে চলতে পারে না। কথাটা প্রধানমন্ত্রীরও জানা না থাকার কথা নয়। তারপরও তিনি যখন তার ‘সুপার উপদেষ্টা’দের দিয়েই সবকিছু করিয়ে নিয়েছেন এবং সবই করিয়েছেন কেবল ভারতের জন্য তখন ধরে না নিয়ে উপায় থাকে না যে, বিরোধী দলের প্রচারণা অসত্য নয়Ñ ভারতের স্বার্থ হাসিল করে দেয়ার শর্তেই তাকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়েছিল। আর সমঝোতা প্রতিষ্ঠার সে প্রক্রিয়ায় এইচ টি ইমামসহ ‘সুপার উপদেষ্টা’রা ‘অবদান’ রেখেছিলেন বলেই জনগণ ও সংসদের পাশাপাশি নিজের মন্ত্রীদেরকেও ‘দৃশ্যমান’ হতে দেননি প্রধানমন্ত্রী। পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, বস্তা ভরে টাকা এনে নির্বাচন পাড়ি দিয়েছিলেন বলেই শেখ হাসিনাকে এখন দায় শোধ করতে হচ্ছে।
এভাবে যে কোনো পর্যালোচনায় পরিষ্কার হয়ে যাবে, শেখ হাসিনার সরকার আসলে সর্বতোভাবে ভারতের স্বার্থেই ভূমিকা পালন করে চলেছে। সরকারের এই নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারতও বাংলাদেশকে সামান্য ‘গনায়’ আনার প্রয়োজন বোধ করছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসবের মাশুল গুণতে গিয়ে জাতিকে এক সময় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও খুইয়ে ফেলতে হতে পারে।  এতটা সফল ও সুফলপ্রসূ পররাষ্ট্রনীতিই অনুসরণ করে চলেছে আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকার।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads