শুক্রবার, ৭ জুন, ২০১৩

গভীর সঙ্কট থেকে বিএনপিকে উদ্ধার এবং কিছু উদ্ধারকারী

সারা দেশ যখন পুড়ছে ও সরকার যখন নীরুর মতো বাঁশি বাজাচ্ছে, তখন সুশীলসমাজের কেউ কেউ হঠাৎ অন্য গীত গাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় দেশ নয়, সরকার নয়, তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বিএনপির গভীর সঙ্কট নিয়ে। গত ১৯ মে একজন সাংবাদিক  হঠাৎ করেই লিখলেন গভীর সঙ্কটে বিএনপি
বিভিন্ন নৌদুর্ঘটনার সময় সোহরাব-রোস্তম-আমির হামজা এই ধরনের কিছু উদ্ধারকারী জাহাজের নাম আমরা শুনতে পাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপিকে উদ্ধার করার জন্য দয়াশীল মিডিয়া বিএনপির জন্য এই ধরনের উদ্ধারকারী দাঁড় করিয়ে রাখেন।
অন্য দিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ও তার তনয়ের নেতৃত্বে বিকল্প ধারা বিএনপির সাথে একীভূত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু পরে তাদের সংবাদ সম্মেলন শুনে মনে হয়েছে যে তারাও বিএনপির জন্য এই ধরনের উদ্ধারকারী হিসেবেই প্রতিপন্ন হতে চান। বিএনপির সাথে একীভূত বা জোটভুক্ত হতে বিকল্প ধারার অসুবিধা না হলেও ১৮ দলের সাথে আদর্শিক ফারাক রয়েছে। কাজেই এই লাভের গুড় কোনো পিঁপড়ারা খেয়ে ফেলে কি না, তা ভেবেচিন্তেই বিএনপিকে অগ্রসর হওয়া দরকার।
বিএনপির জন্য এমনই একজন উদ্ধারকারী জাহাজতুল্য সাংবাদিককে চিনতে ভুল করে ফেলেছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সামসুজ্জামান দুদু। বিএনপি নেতাদের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি একটি জবাব দিয়েছেন। জবাবটি যে খুব কাজে দিয়েছে তা বোঝা গেছে একই সাংবাদিকের পরবর্তী লেখাটি পড়ে। এবার শিরোনাম করেছেন, হেফাজত ও জামায়াতের বন্ধু বিএনপি।
এই ভাবে শিরোনাম দিয়েও বোধ হয় দৈনিকটি তাদের মনের খেদটি কমাতে পারেনি। লেখাটির সাথে দুটি কার্টুন ছবি জুড়ে দিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার ছবিটি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও তারেক জিয়ার মুখটি বিকট করে আঁকা হয়েছে।
বিএনপিকে এই বিশেষ কায়দায় উদ্ধারের কোশেশ দেখে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী থমাস এডিসনের ছোটবেলার এক কাহিনী মনে পড়ে যায়। বিশ্বখ্যাত এই বিজ্ঞানী ছোট বেলায় ট্রেনে খাবারদাবার ও নিউজপেপার ফেরি করে বেড়াতেন। একদিন চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে ছোট্ট এডিসন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ও প্রায় ট্রেনের নিচে পড়ে যেতে লাগলেন। তখন দয়ার্দ্র হয়ে এক ভদ্রলোক তাকে কানে ধরে টেনে ট্রেনে উঠান। ভদ্রলোকের আজব বদান্যতায় এডিসনের জীবনটি রক্ষা পেলেও তার শ্রবণযন্ত্রটি জীবনের তরে নষ্ট হয়ে যায়। তার প্রতি ভদ্রলোকের কৃপাটি এডিসন স্মরণ করেন এভাবে। ভদ্রলোক আমার দুটি উপকার করেছিলেন। এক. আমার জীবন রক্ষা করেছিলেন। দুই. আমি কানে না শোনাতে শাপে বর হয়েছে, বাইরের কোলাহল এবং কথাবার্তা কানে না পৌঁছাতে নিজের গবেষণাকর্মে বেশি মনোযোগ দিতে সক্ষম হয়েছি।
বিএনপির প্রতি এই সাংবাদিকের পরামর্শগুলো একই স্বাদ ও মেজাজের মনে হয়। তিনি এবং যেসব বিএনপিপ্রেমীর জন্য এই লেখাটি তিনি লিখেছেন তারা তথাকথিত গভীর সঙ্কট থেকে বিএনপিকে উদ্ধারের জন্য এমন করেই কানে ধরে টেনে তুলতে চাচ্ছেন।
লেখকের আশা ছিল চিলে কান নিয়ে গেছে এটা শুনেই চিলের পেছনে দৌড়াবে বিএনপির নেতা ও কর্মীরা। কিন্তু তা না করে কানে হাত দিয়ে ফেলেছেন বিএনপির সামসুজ্জামান দুদু। এটাই বোধ হয় লেখকের এই মনোযাতনার বড় কারণ। সঙ্কটটি বিএনপির নয়। আমার মনে হচ্ছে সঙ্কটে পড়ে গেছেন এই সাংবাদিকের মতো পরামর্শকরা।
তার মূল অভিযোগ, গত জোট সরকারের আমলে তারেক রহমান শত্রুর শত্রু হিসেবে আওয়ামীবিরোধী জঙ্গি ও মৌলবাদীদের সাথে একাত্ম হয়েছেন। তখন খালেদা জিয়া সন্তানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলেননি। মুশকিলটি হলো, এ ধরনের অভিযোগ করার সময় আওয়ামী লীগের কোনো হাইব্রিড নেতা এবং নিরপেক্ষ গবেষক তাদের মনোজগতে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। এই অভিযোগটিকে ঘিরে পাল্টা কয়েকটি প্রশ্নের জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। অথচ বিষয়টি নিয়ে একটা নিরপেক্ষ গবেষণার জন্য এই প্রশ্নগুলোর জবাব অত্যন্ত জরুরি।
উদাহরণস্বরূপ, জেএমবির পালের গোদাদের গ্রেফতার করে দ্রুত বিচার করে সাজা দিয়েছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। পরবর্তী জরুরি সরকার এসে সেই সাজা কার্যকর করেছিল। এই কথাগুলো পরামর্শদাতাদের লেখা বা অনুভবে কখনোই ঢোকে না।
বামপন্থী সর্বহারাদের কাজের দায় নিয়মতান্ত্রিক বামপন্থী রাজনীতিকদের ঘাড়ে চাপানো যায় না। একই যুক্তি ধরে বলা যায়, উগ্র বা জঙ্গি ইসলামপন্থী গ্রুপগুলোর কাজের দায় সরল সমীকরণে অন্যান্য নিয়মতান্ত্রিক ইসলামপন্থী দলগুলোর ওপর চাপানো যায় না। প্রথম যুক্তিটি মানলেও রহস্যময় কারণে এই পরামর্শদাতারা দ্বিতীয়টি মানতে চান না।
আর এ ধরনের ইসলামপন্থী দল বা জোট আওয়ামী লীগের সাথেও জোটবদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগকে এরা বরাবর কৃষ্ণ হিসেবে জ্ঞান করেন। কারণ এই কৃষ্ণের বেলায় যা লীলাখেলা, অন্যের বেলায় তা পাপ হয়ে পড়ে। মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে এ দেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল থাকবেই। কাজেই এদের সাথে জোটবদ্ধ বা কৌশলগত রাজনৈতিক ঐক্য আওয়ামী লীগের জন্য পাপ না হলে বিএনপি বা তারেক রহমানের বেলায় পাপ হবে কেন? মদিনা সনদের প্রতিষ্ঠাসহ এ ধরনের যতগুলো কথা প্রধানমন্ত্রী উচ্চারণ করেছেন তার ভগ্নাংশও বেগম খালেদা জিয়া বা তারেক জিয়া উচ্চারণ করেননি। তার পরও সুশীলসমাজের গোস্বাটি স্পষ্ট হচ্ছে না।
তা ছাড়া গত চারদলীয় জোটটি সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সিট পেয়েছিল। শরিয়া শাসন প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে থাকলে তো সংসদে ভোটের মাধ্যমেই তা কায়েম করে ফেলতে পারত। এই সহজ রাস্তা বাদ দিয়ে এরা কেন দেশব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করে ইসলাম কায়েম করতে গেল? এই প্রশ্নটিকে তারা যতই পাশ কাটাতে চাচ্ছেন, তা ততই তাদের দিকে ফিরে আসছে। ইতিহাস এই প্রশ্নের দায় থেকে তাদের মুক্তি দেবে না।
স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি আছে কি না এটা নিয়েই যখন মাঝে মধ্যে মনের ভেতর খটকা জাগে, তাদেরকেই আমরা বানিয়ে বসেছি বুদ্ধি ও জ্ঞানের একেক দিকপাল। কাজেই এই জাতির কপাল পুড়বে না তো কার পুড়বে ?
ছেলে তারেক জিয়াকে দুষতে গিয়ে মা খালেদা জিয়ার এক পলক প্রশংসা করা হলো। কিছুক্ষণ পর মার এই প্রশংসাটিও আর ধরে রাখা গেলো না। কারণ এই গবেষকের গবেষণা মতে, খালেদা জিয়া এখন নিজেই বাম থেকে অতি ইসলামি জিহাদি বুদ্ধিজীবীতে রূপান্তরিত কিছু বুদ্ধিজীবীর পরামর্শে পরিচালিত হচ্ছেন। প্রতিপক্ষকে যদি জিহাদি বিশেষণে বিশেষিত করে ফেলা যায় তবে এই লোকদের কাজটি খুব সহজ হয়ে যায়।
কারণ নিজেদের নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রচার চালিয়ে প্রতিপক্ষকে বিএনপি-জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবী সিল এঁটেও তাদের কাজটি হচ্ছিল না। তাই এখন আর বিএনপি-জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবী নয় এরা হলেন বাম থেকে অতি ইসলামি জিহাদি বুদ্ধিজীবী
সম্ভবত বাংলাদেশ পুলিশের কাছ থেকে এই কৌশলটি গ্রহণ করেছেন এই সাংবাদিক। ইসলামি সাহিত্যের বিভিন্ন বই পুস্তক এ দেশের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে আছে। ভিন্ন মতের ইসলামি সাহিত্যকে এরা নাম দেয় জিহাদি বই। এসব বইয়ের মলাটে একেকটা শিরোনাম থাকলেও তার ওপরে কম্পিউটার কম্পোজে গড়পড়তা লিখে দেয় জিহাদি বই। এখন একই কায়দায় ভিন্ন মতের বুদ্ধিজীবীদের পিঠে এই কলাম লেখকেরা মেরে দিচ্ছেন জিহাদি বুদ্ধিজীবীর সিল!
এদের আফসোস, বেগম খালেদা জিয়ার অনেক সিদ্ধান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জানতে পারেন টিভি সংবাদের মাধ্যমে। এই বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবে এই নেতাদেরও বেগম খালেদা জিয়া এখন আর বিশ্বাস করতে পারছেন না বা তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। এই বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শেই তিনি ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ বিএনপির কিছু নেতা এই উদ্ধারকারীর শরণাপন্ন হয়েছেন, তাদের মনের কষ্টের কথা জানিয়েছেন। বিএনপির যে কটি বিপদ বা সঙ্কট লেখাটিতে চয়ন করা হয়েছে তা পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে এখানে উল্লেখ করা হলো।
১. বিপজ্জনক দিক হলো বিএনপির এসব নেতা খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে তাদের মনের কথাগুলো তাকে সরাসরি বলতে পারছেন না।
২. বিএনপির সঙ্কট কেবল নেতাদের সাথে কর্মীদের কিংবা দলীয় চেয়ারপারসনের সাথে অন্য নেতাদের দূরত্ব নয়। মূল সঙ্কটটি হলো, দলটির মধ্যে নীতি ও আদর্শের প্রচ  টানাপড়েন। প্রশ্ন উঠেছে, জিয়াউর রহমান যে উনিশ দফাকে দলের মন্ত্র করেছিলেন, সেটাই বহাল থাকবে, না জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতের আদর্শকে ধারণ করবে?
জিয়ার আদর্শে দলটি ফিরে যেতে চাইলেই এদের কাছে মনে হবে জামায়াত কিংবা হেফাজতের আদর্শের কাছে ফিরে যেতে চাচ্ছে। আশার কথা হলো, বিএনপির ভেতরে এবং বাইরে এ ধরনের পরামর্শকরা ক্রমশই বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ছেন। কলাম লেখকের লেখার প্রতিটি ছত্রে তার সেই হতাশাই ফুটে উঠেছে।
এসব জ্ঞানীগুণী জিয়ার উনিশ দফার কথা বলেন কিন্তু সেই উনিশ দফায় কী কী দফা ছিল তা কখনোই তলিয়ে দেখেন না। এই উনিশ দফার মধ্যেই পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের কথা রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের কথা রয়েছে। কাজেই এই দুটি দফাকে ধরে রাখাকেই এই কলাম লেখকেরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াত ও হেফাজতের আদর্শ বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছেন। মূলত বিএনপির নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এসব কথা লিখেছেন।
এরা বাম থেকে ইসলামি জিহাদি বুদ্ধিজীবীতে রূপান্তরিত যে শক্তিটির কথা উল্লেখ করেছেন তারা হলেন প্রকৃত অর্থে বিএনপির নিজস্ব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা থেকে সৃষ্ট থিংক ট্যাংক। বাইরের সব এন্টিনার প্রভাবগুলো সম্ভবত এই থিংক ট্যাংকটি অকার্যকর করে দিচ্ছে। প্রতিপক্ষকে জব্দ করার জন্য মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, জিহাদি প্রভৃতি শব্দগুলো এরা কৌশলগত কারণে ব্যবহার করে।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দলটি একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল দল। পৃথিবীর অপরাপর উন্নত জাতিগুলো ধর্মকে যেভাবে রেখেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়া তা থেকে ভিন্ন কিছু করেননি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে যদি প্রতিটি টাকার পেছনে লেখা থাকতে পারে ইন গড উই ট্রাস্ট । তবে প্রায় একই মেজাজ ও সম ধরনের কথা সংবিধানে সন্নিবেশিত করে তিনি সেকুলার ভাবধারায় বড় ধরনের অপরাধ করে বসেননি।
অর্থনৈতিক বিশ্বটা বরাবরই কিছুটা স্বার্থপর। আমাদের বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগে কোনো কোনো বন্ধু সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তার পর এগিয়ে আসেনি। কেউ এক টাকার সাহায্য দিয়ে তিন টাকার কথা শুনিয়েছে। তার মধ্যেও মোটামুটি সাইজের টোপলাগুলো এসেছে মধ্যপ্রাচ্য বা মুসলিম বিশ্ব থেকে। রেমিট্যান্সের একটা বড় অংশ এখনো আসছে এসব দেশ থেকেই। কাজেই মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর বাস্তব প্রয়োজনটিকে ভিশনারি জিয়া এভয়েড করতে পারেননি। এই দেশ ও জাতির প্রয়োজন ছিল এমন কোনো কথা উচ্চারণে ভয় পেতেন না জিয়া। জিয়ার জন্ম না হলে মনের অনেক কথা এ দেশের মানুষ উচ্চারণ করতে পারত না।
মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে গিয়ে বাকি বিশ্ব থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন থাকতে বলা হয়নি। কালচারাল এই নৈকট্যকে সারা বিশ্ব সহজ চোখেই দেখে থাকে। ফলে প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির সফলতাকে অন্য কেউ এখনো অতিক্রম করতে পারেননি। মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নত করলেও তিনি কোনো ধরনের ধর্মীয় নেতা হিসেবে পরিচিতি পাননি বরং আধুনিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই বাদবাকি বিশ্বে সমাদৃত হয়েছেন।
এ দেশে উদার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। উদার গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো পরমতের প্রতি সহিষ্ণুতা। এই উদার গণতন্ত্রের বদৌলতেই বাকশালের খাদ থেকে আবারো আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম সম্ভব হয়েছে। এটা কোনো গায়ের জোরের কথা নয়Ñ এর পেছনে সাপোর্টিং ডকুমেন্ট বা ঐতিহাসিক সমর্থন রয়েছে।
উদার গণতন্ত্রের মূল কথাটি হলো তোমার বক্তব্যের সাথে ভিন্নমত পোষণ করতে পারি। কিন্তু তোমার এই বক্তব্য প্রকাশের জন্য প্রয়োজন হলে আমার নিজের জীবনটিও উৎসর্গ করতে রাজি আছি। এই উদারতাটি সে দিন বাকশালের খাদে পড়া আওয়ামী লীগের দিকে প্রসারিত করেছে বলে বিএনপিকে আওয়ামী লীগের রক্ষাকর্তা বা বন্ধু হয়ে পড়েনি।
উদার গণতন্ত্রের সেই উদারতাটি জামায়াত ও হেফাজতের বেলায় প্রয়োগ করলে তাদের বন্ধু হতে হবে কেন? বিএনপি জানে এই জামায়াতে ইসলামী আবারো একদিন আওয়ামী লীগের সাথে মিশে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। কাজেই বাকশালী আদর্শে উজ্জীবিত এসব ব্যক্তির পক্ষে বিএনপির উদার গণতান্ত্রিক চরিত্রটি বোঝা একটু কষ্টকর। কাজেই এটা বিএনপির সঙ্কট নয়Ñ পরামর্শদাতাদের বোঝার অক্ষমতা।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে আস্থার বাইরে রেখে কোনো রাষ্ট্রনায়কই তার দেশকে এগিয়ে নিতে পারেননি। ড. মাহাথির মুহাম্মদ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা ও চেতনার বাইরে গিয়ে এই ম্যাজিক উন্নতি জাতিকে উপহার দেননি। এই নেতার কাট কাট ধরনের স্পষ্ট বক্তব্য অনেককে আহত করলেও পুরো বিশ্বের সমীহ কুড়িয়েছে। কোনো দল বা নেতার প্রতি আস্থা স্থাপনের পূর্ব শর্ত সেই দল বা নেতার মনটি স্পষ্টভাবে পড়তে পারা। বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনায়কদের প্রত্যেকের জীবনের পাতাটি ছিল এমন ঝরঝরে পরিষ্কার। এ ধরনের ঝরঝরে পরিষ্কার পাতা আমরা জিয়ার জীবন খাতায় দেখতে পাই। এক দিকে কাজটি সম্পন্ন করে তাকে কখনোই অন্য দিকে ব্যাখ্যা টানতে হয়নি। তার ভক্তরা জানত কেন তারা তাকে এত পছন্দ করে। অপর দিকে তার শত্রুরাও জানত কেন তারা তাকে এত ঘৃণা করে।
প্রেসিডেন্ট জিয়া মারা গেলে তার ভক্তরা খুঁজে পায় তার ছেঁড়া গেঞ্জি, ভাঙা স্যুটকেস। আর অন্য কেউ  মারা যাওয়ার পর তার ভক্তরা জাদুঘরে জায়নামাজ প্রদর্শন জরুরি মনে করেন। দুই নেতার রেখে যাওয়া ভক্তদের মানসিক গঠনটি এখানে স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। একজন রেখে গেছেন জনগণের পরিপূর্ণ আস্থা। অন্যজন রেখে গেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা হারানোর দায়।
এই আস্থা হারানোর দায় বা বেদনাটি প্রকট হয়ে ওঠে নির্বাচনের আগে আগে। বিএনপির প্রার্থীরা স্যুটেড বুটেড হয়ে জনসাধারণের সামনে এলেও আওয়ামী লীগের অধিকাংশ প্রার্থীকে টুপি-পাঞ্জাবি পরে নির্বাচনী পোজ দিতে হয়। বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের প্রার্থীদের লেবাসের দিকে একটু নজর দিলেই প্রবণতাটি স্পষ্ট হবে।
গত চার বছর আওয়ামী লীগ এই আস্থাহীনতার সঙ্কটটি কমাতে পারেনি, বরং আগের চেয়ে আরো অনেক বাড়িয়েছে। এক দিকে বাম্পার ফলনের কৃতিত্ব মা দুর্গাকে দিতে হয়েছে আবার অন্য দিকে মদিনার সনদ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার ঘোষণাটিও রাখতে হয়েছে। অথচ বিএনপি এই দুটি চূড়া থেকে নিরাপদ সমতলে থেকে বিশ্বাসীদের অধিকতর আস্থার জায়গাটি শক্তভাবে ধরে রেখেছে। আওয়ামী লীগের এ ধরনের ভারসাম্যহীন চরম মতবাদের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার চেয়ে বিএনপির ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান এ দেশের সুস্থ ও বিবেকবান মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করে।
রাজনৈতিক, আর্থিক এবং নৈতিকভাবে যেখানেই আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়, সেখানেই জিয়া ও তার দলের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া, তার পরিবার ও দলের প্রতি দেশী ও বিদেশী এই গোষ্ঠীটির আক্রোশের কারণটি সহজেই বোধগম্য।
২০০৬ সালের পর থেকে বিএনপির ওপর অনেক ঝড়ঝাপটা এসেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এর মাধ্যমে শত্রু মিত্র চেনাও দলটির নেতা ও কর্মীদের জন্য অনেক সহজ হয়েছে। এই গোষ্ঠীর জন্য হতাশার কারণটি হলো, বিএনপি তার শত্রুদের ভালো করে চিনে ফেলেছে। কাজেই বিএনপিকে কখন কোন কাজটি করতে হবে এই শত্রুরাই সুন্দর করে দেখিয়ে দেয়।
দলের ভেতরের এসব এন্টিনাকে ডি-একটিভেইট করার কাজগুলো আরো প্রজ্ঞা ও সতর্কতার সাথে করতে হবে। আমাদের রাসূল সা: তাঁর শিষ্যদের মোনাফেকির লক্ষণ সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছেন; কিন্তু মোনাফেক হিসেবে কারো নাম প্রকাশ করেননি। হিপোক্রেটস বা মোনাফেকদের সাথে নিয়েই পথ চলেছেন। মোনাফেক সঠিকভাবে চিহ্নিত হলেও অনেক সময় লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। আর নির্ণয়ে ভুল হলে ডাবল বা ট্রিপল ক্ষতি। এগুলো মাথায় রেখেই বিএনপিকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পা ফেলতে হবে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads