বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৩

সর্পিল রাজনীতির ছোবল


গণতান্ত্রিক সমাজে সহিষ্ণুতা প্রয়োজন, প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন। কিন্তু এইসব চেতনা আমাদের সমাজ থেকে যেন বিলুপ্ত হতে চলেছে। ছিদ্রান্বেষণ ও পরস্পরের দোষত্রুটি চর্চাই যেন এখন আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। অনাকাক্সিক্ষত এমন সংস্কৃতি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন প্রকট। আমাদের জাতীয় সংসদে যে ভাষায় কথা বলা হয়, পরস্পরের প্রতি যেভাবে বিদ্বেষ পোষণ করা হয়, তাতে জাতির লজ্জা বাড়ে। এর মূলে রয়েছে নষ্ট রাজনীতি। এই রাজনীতি এখন সর্পিল ভঙ্গিতে সব কিছুকে ছোবল মারতে চাইছে। কারোই যেন রক্ষা নেই।
রাজনীতিতো এমন ভীতিকর বিষয় হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভ, অহঙ্কার ও স্বার্থান্ধতা আমাদের রাজনীতিকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্বকেও আমাদের ভয়ঙ্কর রাজনীতির স্বাদ আস্বাদন করতে হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ড. ইউনূসের যে দুঃখ-বেদনা ও কষ্ট তা সাম্প্রতিক এক লেখায় তিনি প্রকাশ করেছেন। লেখাটিতে অনেক কথাই উঠে এসেছেÑ বিশেষ করে সরকারের ভুল নীতি ও পদক্ষেপের কথা। দুঃখের সাথে তিনি লিখেছেন, “গরীবের ব্যাংক গরীবের হাত থেকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন না। কলমের খোঁচায় আইন পাল্টিয়ে দিয়ে ৮৪ লাখ গরীব পরিবারের সঙ্গে চর দখলের খেলায় নামলে, সেটা সরকারের জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা হবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। আর দেশের মানুষ বিশ্বসমাজে তার গর্বের প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রাস করে ও টুকরা টুকরা করে ধ্বংস করতে দেবে, এই আশা করারও কোনো কারণ নেই।” ড. ইউনূসের লেখাটি ২০ জুন তারিখে দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে এবং এতে জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সরকার এই প্রতিক্রিয়াকে কীভাবে বিবেচনা করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আমরা জানি যে, ড. ইউনূসের সাথে গ্রামীণ ব্যাংকও যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে টুকরা টুকরা করার কৌশল গ্রহণের আগে সরকারের দশবার ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তেমন বিবেচনাবোধের পরিচয় দেয়নি সরকার। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে কারো সমালোচনা থাকতে পারে, এর নীতি ও কৌশলের ব্যাপারেও কারো দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু এ কথার অর্থ এই নয় যে, প্রতিষ্ঠানটিকে টুকরা টুকরা করে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করতে হবে। এ কারণেই হয়তো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক জেদের বশেই সরকারের উদ্যোগে গ্রামীণ ব্যাংকের কাঠামো ভাঙা হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলি খান বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত ঋণগ্রহীতা গরীব সদস্যদের কাছ থেকে আসা উচিত। কেননা গরীব মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না। তার মতে, সফল আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক কাজ করছে। কোনো গ্রাহক এ পর্যন্ত কোনো অভিযোগ করেননি। তারা ঋণ নিচ্ছেন এবং তা ফেরতও দিচ্ছেন। তাহলে কেন পুনর্গঠন দরকার? তিনি আরো বলেন, ৫১ শতাংশ মালিকানা সরকার নিতে চায় আইন সংশোধন করে। কিন্তু বিগত ৪০ বছরেও কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান লাভজনকভাবে পরিচালিত করা যায়নি। এভাবে করলে আরেকটা দায় সৃষ্টি হবে। তিনি মনে করেন, যেভাবে গ্রামীণ ব্যাংক চলছে, সেভাবেই চলতে দেয়া উচিত। হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম গত ১৯ জুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কেন গামীণ ব্যাংক পুনর্গঠন করব? অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস চলে যাওয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংক ভালভাবে চলছে। তাহলে কেন আবার গ্রামীণ ব্যাংক ভেঙে পুনর্গঠন করা হচ্ছে? একটা প্রতিষ্ঠান যদি ভালভাবে চলে, তবে নতুন করে পুনর্গঠনের প্রয়োজন নেই।’ মির্জা আজিজ আরো বলেন, ‘সরকারি মালিকানায় গেলে কী হয়, তা আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পারি। সরকারি মালিকানাধীন শুধু আর্থিক খাত নয়, উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত পুঞ্জীভূত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এতে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে। এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তাই সরকারি মালিকানায় গেলে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম ব্যাহত হবে। যে উদ্দেশ্যে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত তাও ব্যাহত হবে। এদিকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, রাজনৈতিক জেদের বশেই সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস করতে চাইছে। রাজনৈতিক জেদের কারণে বর্তমান সরকার ব্যাংকটির কাঠামো পরিবর্তন করে খ- খ- করতে চাইছে। এই ব্যাংকটির সব সফলতাকে ব্যর্থ করতে চাইছে। এটা অর্থনৈতিক  বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কৌতূহলের বিষয় হলো, বর্তমান সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরও গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগকে মেনে নিতে পারছেন না। গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯ টুকরা করার সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের বিরাট সম্পদ। বাংলাদেশের কখনই কোনো ক্ষতি করেননি তিনি। অথচ তাকে আমরা যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পাশ্চাত্য, এমনকি আরব দেশগুলোও মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে আমাদের কর্মকা-ে খুশী নয়। তাকে নিয়ে আমরা যা করছি, তাতে আমাদের দেশের গ্রামের মানুষরাও অখুশী।’
আমাদের সরকার তো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে পারছে না। তাহলে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর কর্মকা-ে জড়িয়ে দেশের মানুষকে অখুশী করার তৎপরতায় জড়াতে গেলো কেন? গ্রামীণ ব্যাংককে টুকরো টুকরো করার তৎপরতায় সরকারের কোনো লাভ আছে কি? এতে মানুষ অখুশী হলে নির্বাচনের এ বছরটিতে সরকারি দলের ভোট বাড়বে কি? এসব প্রশ্নের জবাব নেতিবাচক হলেও সরকার তার অভিযান থামাবে বলে মনে হয় না। কারণ অনেক কাজেই রাজনৈতিক জেদের বশে এখন তারা যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী আবুল হোসেনের কথা মনে পড়ে। পদ্মা সেতু বা দেশের ইমেজ সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো না। সরকারের কাছে বড় বিষয় বলে মনে হলো, মন্ত্রী আবুল হোসেনকে রক্ষার কাজ। তাই জেদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লো সরকার। কিন্তু এতে ক্ষতি ছাড়া কারো কোনো লাভ হলো কি? এ প্রসঙ্গে গত ২০ জুন দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ অনুযায়ী পদ্মা সেতু প্রকল্পে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে ঘুষ বাবদ কার্যাদেশের ৪ শতাংশ অর্থ দেয়ার কথা ছিল। রমেশ সাহার ডায়েরিতে লেখা ঘুষের তালিকায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নাম থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে আসামী করেনি। মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থাকলেও মামলা করা হয়েছে ৭ জনের বিরুদ্ধে। বাদ পড়েছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। আর বিশ্বব্যাংকের মূল অভিযোগ বাদ পড়ে যাওয়া আবুল হোসেনকে নিয়েই। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে করা দুদকের তদন্ত সম্পূর্ণ ও সঠিক হয়নি। গত ১৮ জুন প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ১১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী হিসেবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের দায় তিনি এড়াতে পারেন না। জানুয়ারিতে বিশেষজ্ঞ প্যানেল দুদককে লিখিতভাবে জানিয়েছিল যে, মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী এক্ষেত্রে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সাবেক সচিবের অনুরোধে তিনি এএনসি-লাভালিনের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে দেখা করে সম্ভবত অবৈধ অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করেন। প্যানেল মনে করে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নাম মামলায় আসামী হিসেবে এনে তাকে তদন্তের আওতায় রাখা প্রয়োজন ছিল। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের লিখিত মতামত সত্ত্বেও দুর্নীতি দমন কমিশন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে মামলার বাইরে রাখে। দুদক এক্ষেত্রে এমন ব্যর্থতার পরিচয় কেন দিল তার কারণ এখন উপলব্ধি করা যায়। গত ১৯ জুন দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিদায়ী সৌজন্য সাক্ষাতে যে সব কথা বলেছেন এ প্রসঙ্গে তা উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন ‘নখ-দন্তহীন বাঘ।’ তাই দুর্নীতি দমনে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হলে আইনের সংস্কার ও দুদককে শক্তিশালী করতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ২০০৯ সালে দুদকে যোগদানের পর ১৪ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, দুদক এখন একটি দন্তহীন বাঘ। তার নখগুলোকে কেটে দেয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাহীন করার প্রক্রিয়া চলছে। ৪ বছর পর বিদায়ী মুহূর্তে তিনি একই কথা বললেন। গোলাম রহমান আরো বলেন, বর্তমান বিচার ব্যবস্থা ও একাধিক আইনি জটিলতায় দুদক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের এমন স্পষ্ট ও সরাসরি বক্তব্যের পর আবুল হোসেন রহস্যের কারণ বোঝা যায়। বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় দুর্নীতি দমনের বিষয়টি স্পষ্টভাবেই বর্ণিত হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি দমনের জন্য যে দুদক, দন্তহীন করার পর তার নখগুলোও যদি কেটে দেয়া হয়, তাহলে সে কর্মক্ষম হবে কেমন করে? দুদককে অকেজো করে রাখার প্রক্রিয়াতেই উপলব্ধি করা যায় যে, দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে সরকার আন্তরিক ছিল না। কথা-কাজে এমন গরমিলের কারণেই শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি ও রেল-কেলেঙ্কারীর মত ঘটনা একের পর এক ঘটে যেতে পেরেছে। ফলে দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যানের বক্তব্যের আলোকে জনমনে এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে তা হলো, দুদককে শক্তিশালী করতে বর্তমান আইনের সংস্কারের কাজটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, নাকি রাজনৈতিক জেদের বশে গ্রামীণ ব্যাংককে টুকরো-টুকরো করা অধিক প্রয়োজনীয়? কোন কাজটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ তা জনগণের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু সরকার গুরুত্ব নির্ধারণে গণ-আকাক্সক্ষা পূরণে সমর্থ হয় কিনা- সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads