বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৩

সিটি নির্বাচনে জনতার রায়


১৫ জুন খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীর চরম ভরাডুবি হয়েছে। বিশাল ব্যবধানে বিরোধী দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এ নির্বাচনকে অনেকে অত্যাচারীর পরাজয় ও অত্যাচারিতের বিজয় হিসেবে দেখছেন। নির্বাচনে ভোট ডাকাতি বা কারচুপি না হলেও প্রচুর কালো টাকা ব্যবহার হয়েছে, যা নির্বাচনী এলাকার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। ভোটের আগের দুই রাত ছিল কালো টাকার ছড়াছড়ি।
সরকারের একগুঁয়েমি ও অহংবাদী মনোভাবের কারণে বিরোধী দলের যৌক্তিক দাবির প্রতি কর্ণপাত করা হচ্ছে না। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর মামলা, হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন ও অত্যাচার-অবিচার করে শায়েস্তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নিজেদের অপকর্মের দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। মানুষ সরকারের অপকর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও ত্যক্তবিরক্ত। গুম, খুন, অপহরণ ও নির্যাতনে বিরোধী দল দিশেহারা। বিরোধী দলের প্রতি নির্যাতন মানুষ ভালো চোখে দেখছে না। মানুষ চায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। অবাধ লুটপাট, দুর্নীতি, ঘুষবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্য, দখলবাণিজ্য, ভূমিদস্যুতা, দুঃশাসন ও আইন শাসনের প্রচণ্ড অভাব মানুষ অহরহ প্রত্য করছে। শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিছমিল্লা গ্র“প, কুইক রেন্টাল, রেলওয়ে কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু দুর্নীতি ইত্যাদি সরকারের ইমেজকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। নিজেরা কেলেঙ্কারির হোতা হয়ে বিরোধী দলের প্রতি দোষারোপ অযৌক্তিক ও অশোভন। বিশ্বায়নের এই যুগে অবাধ তথ্যপ্রবাহের ফলে কোনো কিছু চেপে রাখা যায় না। সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড মানুষের নখদর্পণে। বালিতে মুখ গুঁজে থাকলে প্রলয় বন্ধ হয় না। গত সাড়ে চার বছর সরকারি দল দুর্নীতি দুঃশাসনের উদাহরণ সৃষ্টি করছে, যা কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। নিজেদের হাজার হাজার মামলা উঠিয়ে নিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন মামলা দিয়ে তাদের নানাভাবে অপমান, অপদস্থ ও হয়রানি করা হচ্ছে, যা অনৈতিক ও অযৌক্তিক। কল্পিত, বানোয়াট মামলা দিয়ে বিরোধী দলের বাঘা বাঘা নেতা-নেত্রীদের হয়রানি করে সরকার সব কিছু ঠিকঠাক বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে, যা অসম্ভব বলে আমাদের প্রতীতি হয়েছে। দমন, পীড়ন করে দেশ শাসনের ঐতিহ্য স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বৈশিষ্ট্য। গণতান্ত্রিক কোনো সভ্য দেশে এরূপ শাসন বেমানান। বিরোধী দল দমনে সরকার নতুন করে সন্ত্রাস দমন আইন পাস করেছে। এসব আচরণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এসব কর্ম মানুষের অপছন্দের বহিঃপ্রকাশ চার সিটি নির্বাচনের ফলাফল।
বিরোধী রাজনীতিকদের সাথে দেশে বিদেশে সম্মানিত জ্ঞানী-গুণী বিশিষ্টজনদের সরকার হেয় ও অপমান অপদস্থ করে মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে করেছে সঙ্কুচিত। আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে ও এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করায় সাংবাদিক সমাজের সাথে দেশের মানুষ বীতশ্রদ্ধ ও অখুশি। সাড়ে চার বছরে ১৮ জন সাংবাদিক নিহত ও বহু সাংবাদিক আহত হয়েছেন। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সাথে বহু সাধারণ মানুষ নিখোঁজ, গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়ায় সরকার কোনো কার্যকর পদপে নেয়নি। সাগর-রুনির খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় না নেয়ায় সবাই হতাশ। শ্রমিক নেতা আমিনুলের হত্যাকাণ্ডের রহস্য অনুদঘাটিত। এসব কারণে সরকারের প্রতি মানুষের মন বিষিয়ে ছিল, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ১৫ জুনের সিটি নির্বাচনে।
হেফাজতে ইসলামের ৫ ও ৬ মের ঢাকা অবরোধের সময় সরকার যেভাবে তাদের বেইজ্জত ও বে-আব্র“ করেছে সিটি নির্বাচনে তার বিষময় ফল ফলেছে। দুর্বৃত্তদের অপকর্মের দায় হেফাজত কর্মীদের ওপর চাপিয়ে সরকার যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে, মানুষ তাকে ভালো চোখে দেখেনি। ঘুমন্ত, তন্দ্রাচ্ছন্ন ও দোয়া দরূদ পড়তে থাকা অবস্থায় পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও ক্যাডার বাহিনী যৌথ অভিযান শুরু করে। আলো নিভিয়ে তিন দিক থেকে ঘুমন্ত অনাহারী হেফাজত কর্মীদের ওপর আক্রমণে চার দিক থেকে নিন্দা, সমালোচনা ও বিরূপ মন্তব্য শোনা যায়।
জাতীয় নির্বাচন, দেশব্যাপী বিস্তৃত ৩০০ নির্বাচনী এলাকার বহু কেন্দ্র নিভৃত পল্লীতে অবস্থিত। অনেক জায়গায় যোগাযোগ ভালো নয়। ফলে ওইসব এলাকায় মিডিয়া যেতে অনীহা প্রকাশ করবে। হাজার হাজার কেন্দ্রে পর্যবেক ও মিডিয়ার অনুপস্থিতিতেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এত অধিকসংখ্যক কেন্দ্রে পর্যাপ্ত পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাব নিয়োগ সম্ভব হবে না। শুরু হবে দাঙ্গা, হাঙ্গামা ও ব্যালট বাক্স ভরা ও ছিনতাইয়ের মহোৎসব। আর এসব আঁচ অনুমান করে জনগণ চার সিটিতে বিশাল ব্যবধানে সরকারি দলের প্রার্থীদের পরাজিত করেছেন। সিটি করপোরেশন সীমিত এলাকাভিত্তিক আর সে কারণে গোটা দেশের ভোটারদের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেনি বলে সরকারি দলের দাবি যথার্থ নয়। সীমিত এলাকা হলেও এসব সিটিতে সব শ্রেণীপেশার মানুষ বসবাস করেন। সুতরাং বলা যায়, এসব নির্বাচনে গোটা দেশের মানুষের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। মানুষ সরকারের দাম্ভিক ও উগ্র আচরণের প্রতিবাদে অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপে বলে আর কোনো অসাংবিধানিক সরকারের প্রয়োজন নেই বলে দাবি করেছেন। তার দাবি বাস্তবতা বর্জিত ও কল্পনাপ্রসূত। স্পষ্টত এ নির্বাচনের ফলাফলে সরকারের প্রতি অনাস্থা ও নির্দলীয় সরকারের প্রতি আস্থা প্রকাশ পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়কের দাবি করলে নির্বাচনই হবে না বলে উষ্মা প্রকাশ করে বক্তব্য দেয়ায় জনমনে আরো সংশয় ঘনীভূত হচ্ছে। এরূপ মনোভাব গণতন্ত্রের জন্য অশুভ ও অশনিসঙ্কেত। আমরা মনে করি, বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে হবে ও সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে। বিরোধী দল জনবিচ্ছিন্ন নয়, বরং সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সংসদ চলছে। বল এখন প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে। তিনি ইচ্ছা করলে এই সংসদে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে কার্যকর পদপে নিয়ে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে অবদান রাখবেন বলে প্রত্যাশা করছি। দেশ বিদেশের সবাই প্রধানমন্ত্রীর পদপে দেখতে উন্মুখ হয়ে আছেন। খাল কেটে কুমির আনার ভয় দেখানো হচ্ছে। আমরা মনে করি, একগুঁয়েমি ও অহংবাদী মনোভাব নিয়ে এগোতে থাকলে কুমির এমনিতেই আসার আশঙ্কা রয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads