সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৩

যেমন করে চুদুর বুদুর শব্দটি সবার হলো


একজন বিখ্যাত কবির একটি লাইন অনুসরণ করেই উপরের শিরোনামটি তৈরী করা হয়েছে । আমরা জানি সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বিএনপি’র সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু বলেছেন ‘তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে চুদুর বুদুর চইলত ন’ পরবর্তীতে ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাটি এই ‘চুদুর বুদুর’ শব্দটি আদৌ অশ্লীল কি না- তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করে। তাদের অনুসন্ধানে প্রকাশ পায়,
(০১) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে চুদুর বুদুর শব্দটির তিনটি অর্থ দেয়া হয়েছে। এক, বাড়াবাড়ি করা (সিলেট, পাবনা অঞ্চলে এই অর্থে ব্যবহার দেখা যায়)। দুই, গড়িমসি (এই অর্থে ব্যবহার বেশি ময়মনসিংহ, ঢাকায়)। তা ছাড়া এক ধরনের খেলা রয়েছে, যার নাম চুদুর বুদুর।”
(০২)“কলকাতার ভাষাবিদ (বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য) পবিত্র সরকার বলেছেন, “এটা নিশ্চিতভাবেই অনার্য শব্দ। বাংলায় অনার্য শব্দের উৎস তিনটি। টিবেটো-বার্মান, অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়। এরই কোনটি থেকে এই ধ্বনাত্মক শব্দটি এসে থাকবে।” এছাড়া পবিত্র সরকার এবং ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক নির্মল দাসের অভিমত, চুদুর বুদুর গ্রাম্য শব্দ, অশ্লীল কিছুতেই নয়। অর্থ বাড়াবাড়ি করা বা গড়িমসি করা।”
এ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনন্দবাজার লিখেছে, “চুদুর বুদুর গালাগালি নয়। তবুও বাংলাদেশের জাতীয়া সংসদ উত্তাল হল এই একটি শব্দে। শ্লীল না অশ্লীল, তা নিয়ে দীর্ঘ বাদানুবাদ। বাংলাদেশে তো বটেই, এ বাংলাতেও লঘু আড্ডায় চুদুর বুদুর আদৌ অপরিচিত শব্দ নয়।”
আমার নিজের অভিজ্ঞতায় আমি অনেক শিক্ষিত মানুষ, বিশেষতঃ নোয়াখালী জেলার মানুষকে সভা সমিতিতে অবলীলাক্রমে এই শব্দটি ব্যবহার করতে দেখেছি। বিশেষ কারণে তখন আমার মনে হয়েছিল শব্দটি অশ্লীল। কিন্তু উপরের সবকিছু জেনে এখন আমি দ্বিধাহীন ভাবে মুক্ত কন্ঠে এই শব্দটি উচ্চারণ করে থাকি। আর আমার জানা অনেকেই এখন তা করে থাকেন এবং তাদের অনেকে সাগরের অপর পাড়ের বিদেশের মানুষ। নোয়াখালীর মানুষ যারা নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করেন তারা ফেনীর একটি আঞ্চলিক শব্দের এমন দুই বাংলায় এবং বিদেশে আন্তর্জাতিক ভাবে গৃহীত হওয়া দেখে নিশ্চয়ই খুশী হবেন এবং এর উদ্যোক্তা হিসেবে  সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু এবং সঠিক অর্থ জানানোর জন্য আনন্দবাজার পত্রিকা, অধ্যাপক পবিত্র সরকার এবং অধ্যাপক নির্মল দাসের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন । 
আনন্দ বাজার লিখেছে “শব্দটিকে কিছুতেই অশ্লীল বলা যাবে না। তবে ঠিক, ভদ্রসমাজে তেমন ব্যবহার হয় না।”  আশা করা যায়, যৌক্তিক কারণেই এখন থেকে এটি দেশে, বিদেশে ভগ্রসমাজে বহুল ভাবে ব্যবহৃত হবে । তবে, জাতীয় সংসদে এটি এক্সপাঞ্জ করার দাবী করা হয়েছে । উপরে বর্ণিত যুক্তিতে অশ্লীলতার  কারণে এটি এক্সপাঞ্জ হবার  কথা নয়, যদিও অন্য কারণে হতে পারে ।
যে অর্থে সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু শব্দটি ব্যবহার করেছেন তাও এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসকগণ যখন নিজেদের সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে নিজেরাই আবার ক্ষমতার দখল করার একটি প্রক্রিয়া চালাতে শুরু করে তখন এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ধারণা প্রকাশ করে এবং আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ অনেক দল তাতে সমর্থন দেয়। তাদের প্রবল আন্দোলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালু হয়, তাদের অধীনে মোটামুটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় এবং একটি গণতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় আসে । কিন্তু এই দলটি আবার তাদের কার্যকাল শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে অস্বীকার করে। প্রবল আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করে এবং জয়লাভ করে । তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। একই ধরনের পরবর্তী নির্বাচনে তারা জয়ী হয়। এভাবে দৃশ্যতঃ কোনই সমস্যা না থাকার পরেও এবং আদালতের পরোক্ষ সমর্থন থাকার পরেও শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চালু করে। এখানে আদালতের কথা বার বার বলা হলেও জনগণ জানে,  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আদালতের সমর্থন আছে এবং যে দল মাত্র কয়েক মিনিটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান বাতিল করতে পারে, তারা এমন সহজেই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান পাস করাতে পারে । অথচ বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলে তা না করে, ক্ষমতাসীন দলের  নেতা, মন্ত্রী সবাই একেক সময় একেক রকম কথা বলতে থাকে । তাদের এই সকল কথা বা আচরণ যদি এক কথায় প্রকাশ করতে হয় তাহলে বাংলা ভাষার বিশাল শব্দ ভান্ডার তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটি মাত্র শব্দই পাওয়া যাবে, তা হচ্ছে – ‘চুদুর বুদুর’ ।  তাই সংসদে এটি এক্সপাঞ্জ করা হোক বা না হোক, সঙ্গত কারণেই শব্দটি ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষের হৃদয় দখল করে ফেলেছে । আর দেশের একটি অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত সাধারণ একটি শব্দ আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে ।
সাধারণ ভাবে ‘চুদুর বুদুর’ একটি  ক্রিয়াপদ । একটি কাজ যে মানুষ  বেশী বেশী করে বাংলা ভাষায় সেটি তার বিশেষণ হিসেবেও ব্যবহৃত হয় । একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে একই বিশেষণ বার বার ব্যবহার করা হলে পরে বিশেষ্য পদটির আর প্রয়োজন হয় না, বিশেষণ দিয়েই তাকে চেনা যায় । ‘চুদুর বুদুর’ শব্দের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে । মাননীয় সংসদ সদস্য শব্দটি বেশ কিছু ছোট দল সহ প্রধানতঃ আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ ধরনের কাজ (যেমন, বাড়াবাড়ি, গড়িমসি ইত্যাদি) কে বোঝাতে এই বিশেষণ ব্যবহার করেছেন । ইতিমধ্যে এটি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলটির বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করে হয়েছে । এটি যদি চলতে থাকে তা হলে “চুদুর বুদুর” শব্দটিকে একটি অত্যন্ত ভাগ্যবান শব্দ বলে মেনে নিতে হবে । বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িত প্রধান দলটির বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া অবশ্যই এক বিরল সৌভাগ্য ।  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads