সোমবার, ৩ জুন, ২০১৩

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি

আওয়ামী লীগ, বাকশাল, কমিউনিস্ট, গণবাহিনী, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র একসাথে চলতে পারে এটি এখন আর দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। সাড়ে চার বছরে বর্তমান সরকারের শাসনকালে এটিই প্রমাণিত হয়েছে, এখন এসব মিলে একসাথে দেশ ও জাতিকে কিছু দিতে পারে বলে দেশের মানুষ আর বর্তমান সরকারে যারা আছেন বলা যায়, তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাই আওয়ামীলীগার। আমার জানা মতে, তিনি বাকশালের সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। অন্যরা হয় কেউ বাকশালী অথবা কমিউনিস্ট নয়তো বা চরমপন্থী গণবাহিনীর নেতা। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান অপকর্ম, সন্ত্রাস, গণহত্যা ও দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য গণবাহিনীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। গণবাহিনী নেতা তখনকার আত্মগোপনে থেকেও মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে ধাবিত হয়েছিলেন। মুজিব সরকারের সাথে রীতিমতো সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল গণবাহিনীর। গণবাহিনীর তৎকালীন নেতা বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী। পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ১৩ মিনিটে পার্লামেন্টে বাকশাল কায়েমের বিল পাস করিয়েছিলেন। তার ভাষণের শেষ চারটি লাইন এখানে উদ্ধৃত করছিÑ আওয়ামী লীগ পচে গেছে, গলে গেছে, দুর্গন্ধ হয়ে গেছে। আজ থেকে সারা দেশে বাকশাল কায়েম করা হলো। আওয়ামী লীগসহ অন্য সব দল বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো। বাকশালই হচ্ছে আমার দল। অগ্নিকন্যাখ্যাত মতিয়া চৌধুরী মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানিয়ে জনগণের মধ্যে বিতরণ করতে চেয়েছিলেন। আজ মন্ত্রী হয়ে তার মুখে যখন শুনি বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, তার কন্যা শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের মানসকন্যা, তখন আমার কাছে মনে হয় এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে
ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সশস্ত্র হোন্ডা মিছিলে গ্রামবাসী একত্র হয়ে হামলা করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে। হতাহতের ঘটনায় রাজনীতিক, কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী অনেকেই দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করে জাতিকে সজাগ থাকা এবং এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, মিথ্যা প্রচার করে শান্তিপূর্ণ মিছিলে গ্রামবাসীকে লেলিয়ে দিয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়েছে। তার এ আহ্বান অসার, অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই নয়। সাড়ে চার বছরে তার কর্মীরা কী করেছেন তার খবর যদি তার কাছে থাকত, তা হলে তিনি এ আহ্বান জানাতেন না বলে ধারণা করছি। মানুষের জমাজমি, বাড়িঘর দখল, টেন্ডারবাজি, হামলা-মামলা, হত্যা, লুণ্ঠন, খুন, রাহাজানি, সফলতার সাথে গুমের কাজ ছাড়া তার দলের লোকদের আমলনামায় তেমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। মানুষ কতটুকু অতিষ্ঠ হলে একটি গ্রামের নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে মাইকের ঘোষণা শুনে বের হয়ে আসতে পারে। প্রধানমন্ত্রীকে এটি বুঝতে হবে। জুয়ার আসর, পানশালা, সামাজিক অপরাধের সব কাজে যারা জড়িত থাকে, তাদের গ্রামবাসী প্রতিরোধ করবে না কেন? আর মিথ্যা প্রচারে একটি গ্রামের ২০ জন, ৫০ জন লোক এগিয়ে আসতে পারে। বাড়িঘর খালি করে পুরো গ্রামবাসী এগিয়ে আসার কথা নয়। এমন ঘটনা দেশের অন্যান্য স্থানেও সংঘটিত হচ্ছে। সাতক্ষীরা, বগুড়া, ফরিদপুরের ভাঙ্গাসহ বহু জায়গায় এই কয়েক মাসে এমন নজির স্থাপিত হয়েছে। সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপি ও কর্তাব্যক্তিরা এখন গণবিচ্ছিন্ন। জনগণের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। পুলিশ প্রশাসনকে অপব্যবহার করে সরকার টিকে আছে বলতে অত্যুক্তি হয় না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ সংলাপ লন্ডন-ভিত্তিক একটি পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। দৈনিক ইনকিলাব লন্ডন-ভিত্তিক ওই পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে সংলাপটি প্রথম প্রকাশ করে। পরদিন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ধারাবাহিকভাবে তিন-চার দিন দৈনিক আমার দেশে স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। উইকিলিকসের জনক অ্যাসাঞ্জ বিশ্বব্যাপী তথ্য ফাঁস করে দুনিয়ার মানুষের কাছে পরিচিতি ও আস্থা লাভ করেছেন। কিন্তু তার ফাঁস করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দুনিয়ার কোনো দেশের সাংবিধানিক পদে থাকা কোনো ব্যক্তি পদত্যাগ করেননি। আমার দেশে প্রকাশিত আলোড়ন সৃষ্টিকারী স্কাইপ সংলাপের সত্যতা স্বীকার করে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করেছিলেন। সরকার তাকে বিশ্বস্ত ও অনুগত মনে করে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে আবার নিয়োগ দিয়েছে; অথচ সত্য প্রকাশ করার কারণে মাহমুদুর রহমানকে সাইবার ক্রাইম অপরাধে গ্রেফতার করে ১৩ দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা, নবী সা: ও ইসলাম সম্পর্কে অশালীন ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য ও বিদ্রƒপ করে নাস্তিক ব্লগারদের লেখা আমার দেশ প্রকাশ করার অভিযোগে আমার দেশ সম্পাদক গ্রেফতার ও পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ দিকে চারজন নাস্তিক ব্লগারকে ব্যাপক তদন্তের পর সরকার গ্রেফতার করেছে। এর মধ্য দিয়েই সরকার প্রমাণ করেছে আমার দেশে প্রকাশিত লেখা সত্য।
১৮ দলীয় জোটের ডাকা ৩৬ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিনে মহিলা দলের তিনজন নেত্রীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের প্রত্যেককে তিন মাসের জেল দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেছেন। জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের ঢাকা মহানগরীর সাংগঠনিক সম্পাদক মিলি জাকারিয়া, সহসাংগঠনিক সম্পাদক নিলুফার ইয়াসমিন নিলু, কর্মী পলি এখন কারাবাসে। তাদের অপরাধ, তারা হরতালের সমর্থনে মিছিল করছিলেন। পুলিশ মিছিলে ধাওয়া করলে মিলি সহকর্মী নিলুর বাসায় আত্মগোপন করেন। বাসায় ঢুকে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসে। মিলি জাকারিয়াকে যতদূর জানি, তিনি অত্যন্ত সাহসী, পরিশ্রমী, দল ও বেগম জিয়ার প্রতি অনুগত। পরিশীলিত ও মার্জিত আচরণের নেত্রী। এ সরকারের আমলে বছরখানেক আগে একবার মিছিলের অগ্রভাগ থেকে গ্রেফতার হয়ে ছয় দিন জেলে ছিলেন। খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে যে দিন উচ্ছেদ করা হয়, সেই দিনও জাহাঙ্গীর গেটে তিনি পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। নিষ্ঠুর পুলিশ সেই দিন তার দুটি পা থেঁতলে দিয়েছিল। ২১ দিন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তিনি বাসায় ফিরেছিলেন। এখনো তার দুই পায়ের গোড়ালি ও কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা। প্রতিদিন তাকে পেইনকিলার সেবন করতে হয়। ১৯৯৮ সালেও দলীয় কার্যালয় থেকে একটি মিছিল কাকরাইল মোড়ে এলে মিছিলের অগ্রভাগে থাকা মিলি জাকারিয়া পুলিশি আক্রমণের শিকার হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। বুট, লাঠি, রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাকে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। এ আঘাতের ফলে তিনি চিরতরে তার মাতৃত্ব হারান। ভারত থেকে চিকিৎসা করেও এই সামর্থ্য ফেরত পাননি। ২৭ এপ্রিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে শাপলা চত্বরে নারী জাগরণ মঞ্চ তৈরি করার কথা ছিল। অথচ মাত্র চার দিন আগে অর্থাৎ ২৩ তারিখে তিনজন বিএনপি নেত্রীকে বিনা দোষে আত্মপক্ষ সমর্থন করার আগেই অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আওয়ামী-বাকশালী শাসনব্যবস্থার মধ্যে তফাত এটুকুই।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads