বৃহস্পতিবার, ২০ জুন, ২০১৩

গ্রামীণ ব্যাংক ভেঙ্গে দেয়া প্রসঙ্গে


সরকার কর্তৃক গঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই প্রতিষ্ঠানটিকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিসমূহের আদলে ১৯টি ভাগে বিভক্ত করার সুপারিশ করেছে বলে জানা গেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরানুযায়ী ব্যাংকটিকে ১৯টি ছোট ছোট স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হলে এর প্রধান কার্যালয় শুধু নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করবে। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে যে ব্যাংকটিকে ভেঙ্গে ১৯ বা ততোধিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক আইনগত, ব্যবস্থাপনাগত ও আর্থিক কোনও যোগাযোগ থাকবে না। এসব প্রতিষ্ঠান বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো স্থানীয় সম্পদ বা দায় ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। সুপারিশে গ্রামীণ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়কে নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা ছাড়াও মাঠ পর্যায়ের সংগঠনসমূহ নিবন্ধন করার আইনগত কর্তৃত্ব প্রদানের কথাও বলা হয়েছে। এতে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য মালিকানায় সরকারি শেয়ারের অংশ ৫১ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারি শেয়ারের অংশ হচ্ছে ৫ শতাংশ অবশিষ্ট ৯৫ ভাগ শেয়ারের মালিক হচ্ছেন ব্যাংকটির সুবিধাভোগী তথা ঋণ গ্রহীতা সদস্যরা। প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের চেয়ারম্যান জনাব মামুনুর রশিদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ক্ষুদ্র ঋণের অভিজ্ঞতা সংগ্রহের জন্য ভারত সফরে গেছেন। তারা গুজরাটের আমুল ও সেবা নামের দু’টি ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কার্যক্রম থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা বিবেচনা করে দেখবেন, এখানে উল্লেখ্য যে, সরকার গত বছরের ১২ মে তারিখে সাবেক সচিব মামুনুর রশিদকে প্রধান করে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেনÑ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি এবং চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট মোসলেহ উদ্দিন আহমদ।
১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন খাতে বাংলাদেশের একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। এই ব্যাংকটির উদ্যোক্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার আগে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামে এর কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছিল এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের জোবরা শাখা বেশ কয়েক বছর গ্রামীণ ব্যাংকের অভিহিত শাখা হিসেবে কাজ করার পর ব্যাপক মূল্যায়নের ভিত্তিতে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি জন্ম লাভ করে। এই ব্যাংকটি নিয়ে নানা কথা থাকলেও গ্রামের হতদরিদ্র বিশেষ করে বিত্তহীনদের সংগঠন ও উন্নয়নে এর সাফল্য অনন্য। আমাদের দেশসহ সারা দুনিয়ায় একটি ধারণা ছিল যে, দরিদ্র ও বিত্তহীনরা ব্যাংকিং সেবা পেতে পারে না কেননা এই সেবা পেতে হলে যে জামানত দিতে হয় তা তাদের নেই। এই অবস্থায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রমাণ করে দিয়েছে যে, জামানত ছাড়াই দরিদ্র-বিত্তহীনরা ব্যাংকিং সেবা পেতে পারে এবং তাদের ঋণ পরিশোধের হারও বিত্তশালীদের তুলনায় অনেক বেশি শতকরা ৯৫ থেকে ১০০ ভাগ। এই সাফল্য এবং ঋণের সদ্ব্যবহার বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন অসামান্য সাফল্য অর্জনে সহায়তা করেছে এবং ব্যাংকটির সেবা সামাজিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সাফল্য দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও শিকড় গাড়তে সক্ষম হয় এবং উন্নত ও অনুন্নত শতাধিক দেশে এই ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ মডেল দারিদ্র্য বিমোচনের রোল মডেল হিসেবে গৃহীত হয় এবং গ্রামীণ ব্যাংক ও তার উদ্যোক্তা ড. ইউনূস যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ড. ইউনুসের খ্যাতি এবং নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে বর্তমান সরকার প্রধান ও সরকারি দলের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অনেকেই প্রকাশ্যে বলেছেন যে, নোবেল পুরস্কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই প্রাপ্য ছিল, ড. ইউনূসের নয়। এ নিয়ে অনেক বাকবিত-াও হয়েছে। সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. ইউনূসকে সরিয়ে দিয়েছেন এবং গত চার বছর ধরেই ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু তাতে পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। এতে ব্যর্থ হয়ে ব্যাংকটি ভেঙ্গে দেয়ার জন্য নতুন করে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। আমাদের ধারণা ব্যাংকটি ১৯ বা ততোধিক ভাগে বিভক্ত করার সুপারিশ সরকারের উপরোক্ত উদ্যোগেরই একটি অংশ। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। কমিশন ব্যাংকটিকে বিভক্ত করার যে সুপারিশ করেছে এবং সরকারি শেয়ারের পরিমাণ শতকরা ৫১ ভাগে উন্নীত করে ব্যাংকের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা পেশ করেছে তাকে আমরা শুধু অবাস্তব নয়, পরস্পরবিরোধী বলেও মনে করি। ফলে এর সুবিধাভোগী ৮৪ লক্ষ দরিদ্র পুরুষ ও মহিলা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আবার এর উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে এই বিশাল প্রতিষ্ঠানটি লুটপাট সমিতিতেও রূপান্তরিত হবার আশংকা রয়েছে যেমনটি হয়েছে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রে। আবার ক্ষুদ্র ঋণের ভারতীয় অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর জন্য কমিশন যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাকে আমরা উপযোগী বলেও মনে করি না। সামগ্রিক বিষয়টির মধ্যে আমরা প্রতিহিংসা ও ধ্বংসাত্মক প্রবণতাই প্রত্যক্ষ করছি। এই অবস্থায় বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করার পথ পরিহারের জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads