বুধবার, ৫ জুন, ২০১৩

সরকারের আর এক হাত হলো অজুহাত


বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের ১৫ ধাপ অবনতি ঘটেছে। ফ্রান্সভিত্তিক ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’ তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। সর্বশেষ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪তম, যা গত বছর ছিল ১২৯তম। বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থারও অবনতি ঘটেছে। ভারত ৯ ধাপ পিছিয়ে ১৪০তম স্থানে রয়েছে। আর পাকিস্তান ৮ ধাপ পিছিয়ে আছে ১৫৯ নম্বর স্থানে। সূচকে এ বছর শীর্ষে অবস্থান করা তিনটি দেশ হলো যথাক্রমে ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও নরওয়ে। আর সর্বনি¤েœ অবস্থান করা তিনটি দেশ হলো শেষ দিক থেকে যথাক্রমে তুর্কমেনিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইরিত্রিয়া। শীর্ষে ও সর্বনি¤েœ থাকা তিনটি দেশের অবস্থান গত বছরও একই রকম ছিল। গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক নির্ধারণ প্রসঙ্গে সংগঠনটি জানায়, গণমাধ্যম সংক্রান্ত আইন এবং সাংবাদিকের নিরাপত্তার দিকগুলো বিবেচনায় এনে এই সূচক তৈরি করা হয়েছে। সংগঠনটির রেকর্ড অনুযায়ী সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের ইতিহাসে ২০১২ সালটি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। ২০১২ সালে ২৩ জন সাংবাদিক এবং ৯ জন নেটিজেন (ইন্টারনেটের মাধ্যমে খবর প্রকাশকারী) ও সিটিজেন সাংবাদিক নিহত হন। এ ছাড়া কারাবন্দী হন ১৭৮ জন সাংবাদিক এবং ১৬৩ জন নেটিজেন।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর সূচকের মাধ্যমে বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতার একটা চিত্র আমরা পেয়েছি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এখনো সাংবাদিকরা নিহত হচ্ছেন এবং বন্দী হচ্ছেন কারাগারে। আর সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের ইতিহাসে ২০১২ সালটি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। প্রশ্ন জাগে, সাংবাদিকরা তো কোনো দেশের পদাতিক বাহিনীর সদস্য নন, অপরাধী চক্রের সদস্যও নন, তাহলে কেন এভাবে তাদের নিহত কিংবা বন্দী হতে হবে? এমন চিত্র থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে। এ কারণেই সাংবাদিকদের ওপর এত দমন-পীড়ন ও নিষ্ঠুর হামলা। আর স্বাধীন গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে আমাদের এই অঞ্চল যে বেশ পিছিয়ে আছে তার প্রমাণ সংগঠনটির সূচক। সূচকে এগিয়ে গেলে তো আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এগিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, গত বছর সূচকে পাকিস্তান পিছিয়েছে ৮ ধাপ, ভারত পিছিয়েছে ৯ ধাপ, আর বাংলাদেশ পিছিয়েছে ১৫ ধাপ। অর্থাৎ এগুনো তো দূরের কথা, গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে এই অঞ্চলে গত বছর সবচাইতে পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিষয়টি উপলব্ধি করছে বাংলাদেশের জনগণ, উপলব্ধি করছে সাংবাদিক সমাজ।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম নানাভাবে দমন-পীড়নের শিকার হলেও সরকার তা স্বীকার করতে চায় না, আর তথ্যমন্ত্রী তো চাতুর্যের সাথে বলেন উল্টো কথা। এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে। দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি বন্ধ করে সরকার মিডিয়ার স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে উল্লেখ করে অবিলম্বে এসব মিডিয়া  চালুর দাবি জানিয়েছেন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি। জবাবে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, মিডিয়া বন্ধের সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সম্পর্ক নেই। তথ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের কারণে প্রশ্ন জাগে, তাহলে মিডিয়া বন্ধের সাথে কিসের সম্পর্ক আছে? বাংলাদেশে মিডিয়া বন্ধের ইতিহাসতো নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময় মিডিয়ার বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলেছে। আর বাকশাল আমলে বাংলাদেশের মিডিয়ার বিরুদ্ধে যে খড়গ নেমে এসেছিল তা তো আমাদের মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। মিডিয়ার বিরুদ্ধে দমন নীতিকে তো তখন তিনি সমর্থন করেননি। কিন্তু আজ তিনি এসব কি বলছেন? মন্ত্রী হলে কি মানুষ বদলে যায়?
কোনো মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার স্বাধীনতার আর কোনো প্রয়োজন আছে কী? সেতো তখন স্বাধীনতা-পরাধীনতা সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে যায়। মিডিয়ার ক্ষেত্রেও একথা সমান সত্যি। কোনো মিডিয়াকে বন্ধ করে দিলে সেতো মৃত্যুবরণ করে। মিডিয়া বন্ধের সাথে সাথে সেখানে কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারী ও শ্রমিকরা বেকার হয়ে রুটি-রুজির অভাবে মৃত্যুর দিকে ধাবমান হয়। এভাবে মিডিয়া ও মিডিয়া কর্মীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে কি না তা সংশ্লিষ্টদের এখন বিশেষভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণের চাইতেও মারাত্মক। কারণ স্বাধীনতা হরণ করলে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়, আর মিডিয়া বন্ধ করে দিলে তার মৃত্যু ঘটানো হয়। স্বাধীনতা হরণের চাইতে জীবন হরণ কি আরো মারাত্মক নয়? এখন আমরা মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণের সাথে সাথে জীবন হরণের ঘটনা লক্ষ্য করছি। মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণ এবং বন্ধ করে দেয়া মিডিয়া চালুর ব্যাপারে যখন প্রশ্ন করা হয় তখন সরকারের মন্ত্রী বাহাদুররা চাতুর্যের সাথে নানা কথা বলে থাকেন। কিন্তু এসব কথার বিরুদ্ধে তারাও যে এক সময় কথা বলেছেন, সে কথা তারা ভুলে যান। কিন্তু তা জনগণের ঠিকই মনে থাকে। ফলে স্ববিরোধী আচরণের কারণে রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রী  বাহাদুরদের পতন ঘটে জনসমর্থন হারিয়ে। আসলে চাতুর্যের ছলা-কলায় সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না। বাস্তব সত্য হলো দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বর্তমান সরকার কিছু দিন আগে বন্ধ করে দিয়েছে। ঐসব মিডিয়ার কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করেও মিডিয়াগুলো চালু করতে পারছে না। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক চেতনা। এই চেতনা কি গণতান্ত্রিক চেতনা, না কি স্বৈরতান্ত্রিক চেতনা, সে রায় জনগণ অবশ্যই দেবে আগামী নির্বাচনে। কথায় বলে, মানুষের দু’হাত হলেও সরকারের না কি তিন হাত। আর তৃতীয় সে হাতটি হলো অজুহাত। গণতান্ত্রিক চেতনার অভাবে আমাদের সরকারগুলো জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হলেও অজুহাত সৃষ্টিতে বেশ পারঙ্গম। দেশের বন্ধ মিডিয়াগুলো চালু করার ক্ষেত্রেও সরকার সৃষ্টি করে চলেছে নানা অজুহাত। এসব অজুহাতে জনগণের আস্থা নেই। আর আখেরে তাতে সরকারের কোনো কল্যাণ আছে বলেও মনে করার কোনো কারণ নেই।
রাজনীতি আসলে শুধু কৌশলের ব্যাপার নয়। দেশ ও জনগণের সমৃদ্ধি ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে রাজনীতিতে প্রয়োজন আদর্শনিষ্ঠা, নীতি-নৈতিকতা, সততা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা। এ সবের অভাব ঘটলে শুধু চাতুর্য দিয়ে রাজনীতিতে সাফল্য অর্জন করা যায় না। বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে লক্ষ্য করলে বেশ স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করা যায়। বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগে জেলায় জেলায় এখন কোন্দল ও আস্থাহীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তার মূলে রয়েছে আদর্শনিষ্ঠা ও সততার অভাব। জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগে এখন যে দলীয় কোন্দল লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা নিরসনে ব্যর্থ হচ্ছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম থেকে শুরু করে সাংগঠনিক সম্পাদকদের এলাকায়ও দলীয় কোন্দল এখন তুঙ্গে। সাংগঠনিক স্থবিরতা আর দলাদলি হাত ধরাধরি করে চললেও বিভাগভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা তা নিরসনে ব্যর্থ। কিছুই করতে পারছেন না তারা। জাতীয় নির্বাচন যখন দোরগোড়ায় সেই মুহূর্তেও কোন্দল ও বিভক্তি থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছে না ঐতিহ্যবাহী এ দলটি। বরং কোন্দল যেন বেড়েই চলেছে। কোন্দল জেলায় জেলায় প্রায় সব নির্বাচনী এলাকায়। কেন্দ্র থেকে বার বার তাগিদ দিলেও কোন্দল নিরসনের ফলাফল শূন্য। দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা নেতাদের সাথে মতবিনিময় সভায় কোন্দল নিরসনের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু ঢাকা থেকে নিজ এলাকায় যাওয়ার আগেই দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশ ভুলে গেছেন কোন্দলে আক্রান্ত নেতারা। কেবল কোন্দলই নয়, কোনো কোনো জেলায় সাংগঠনিক কর্মকা-ের চিত্র হতাশায় নিমজ্জিত। অনেক জেলাতেই দলের সম্মেলন নেই এক যুগ থেকে দেড় যুগ। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে যেন ভুলে গেছেন তৃণমূলের ক্ষমতাপিপাসু নেতারা। কেন্দ্রও এক্ষেত্রে চরম উদাসীন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, কাজী জাফরুল্লাহর নিজ জেলা ফরিদপুরে দলের বিভক্তি এতটাই ভয়াবহ যে, সেখানে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগ। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে সাজেদা চৌধুরীর দ্বন্দ্বে ফরিদপুর জেলার নেতা-কর্মীরা রয়েছেন দুই মেরুতে। উভয় গ্রুপের কর্মী-সমর্থকরা আগাম ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষের প্রস্তুতিও নিয়েছিল একাধিকবার। মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে দুই গ্রুপের নানা চিত্র। নয় বছর আগে সম্মেলন হলেও সেখানে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের কোনো তাগিদ নেই। বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই রিপোর্ট থেকে উপলব্ধি করা যায়, মুখে গণতন্ত্রের কথা নানাভাবে উচ্চারিত হলেও দলটির মধ্যে এখন গণতন্ত্রের কাক্সিক্ষত চর্চা নেই। যে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই সেই দল কিভাবে রাষ্ট্রীয় পরিম-লে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করবে? কথা ও কাজের গরমিলের কারণে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এবং পরমত সহিষ্ণুতার বদলে দমন-অবদমন ও নিষ্ঠুরতার পথে অগ্রসর হয়ে দেশে এক অস্থির ও অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে সরকার। সরকারের এখন যেন একটাই লক্ষ্য, যে কোনোভাবে আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসা। এ জন্যই মানুষ এখন বলছে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। সরকার যে গণতান্ত্রিক পথে চলছে না তার বড় প্রমাণ দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা। এসব ঘটনায় প্রশ্ন জাগে, কিছু গণমাধ্যম বন্ধ করে দিলেই কি সরকার জণগণের মুখ বন্ধ করে দিতে পারবে? জনগণ চায় মিডিয়ার স্বাধীনতা। জনগণের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নই যদি হয় সরকারের দায়িত্ব তাহলে দমন পীড়নের পথ থেকে সরে এসে এখন সরকারের উচিত হবে বন্ধ মিডিয়াগুলো চালু করে দেয়া। তেমন শুভবুদ্ধির উদয় হয় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads