মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০১৩

বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ

তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বাংলাদেশ এমনই এক আলোচিত দেশ হয়ে উঠেছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা প্রায় সবারই জানা। আজকাল প্রায় প্রতিদিনই আলজাজিরা, সিএনএন, বিবিসি, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জাতীয় চ্যানেলসহ বিভিন্ন দেশের টিভিতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সব ধরনের দুর্ঘটনা শিরোনাম আকারে দেখানো হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও তো এমনটি দেখিনি। কারণ বাংলাদেশ জন্মের পর কেউ এমন ভয়াবহ, অস্থিরতা ও এত অপমৃত্যু দেখেনি। এক দিকে দেশে সমস্যার অন্ত নেই, অন্য দিকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত দেশের প্রথমসারির রাজনীতিবিদদের মিথ্যাচারে দেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা প্রায় নিঃশেষের পথে। এভাবে চলতে থাকলে এমন একদিনও আসতে পারে, যখন দুনিয়ার কোনো দেশই বাংলাদেশের কারো কথা বিশ্বাস করবে না।
একজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী হিসেবে এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যখন কোনো অস্ট্রেলিয়ান বা ভিনদেশীয় আমাকে বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলে, তোমার দেশের বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা নাকি ১০ শতাংশ অথবা বাংলাদেশে নাকি কোনো উন্নতিই হচ্ছে না, সবাই দুর্নীতি করেই ব্যস্ত ইত্যাদি ইত্যাদি? সাভার ট্র্যাজেডির পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিএনএনের কাছে দেয়া সাাৎকারের পর আমার এক লেকচারে এক ভারতীয় ছাত্র প্রায় ২৫ জন বিভিন্ন দেশীয় ছাত্রছাত্রীর সামনে এমন এক মন্তব্য করল, যা পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে লজ্জাবোধ করছি। দেশের রাজনীতিবিদদের জন্য প্রবাসে বসে আমাদের কেন এত আজেবাজে মন্তব্য হজম করতে হবে, যাতে দেশের ভাবমর্যাদার চরম ুণœ হয়? দীর্ঘ দিন প্রবাস যাপন করলেও কাউকে কখনো বাংলাদেশ নিয়ে কোনো আজেবাজে মন্তব্য করলে ছাড় দিইনি। অথচ আজ সুযোগ পেয়ে চোখের সামনে ভিনদেশীয়রা দেশকে নিয়ে কটা করে যাচ্ছে; প্রতিবাদ করার যথাযথ কারণ দাঁড় করাতে পারছি না। বাংলাদেশী হয়ে জন্ম নেয়াটাই কী ছিল দুর্ভাগ্যের?
সাভারের ঘটনাটি দেশে-বিদেশের মানুষের হৃদয়ে এতটাই স্পর্শ করেছিল যে, সুদূর চীন থেকে এক যুবতী পর্যন্ত সাভারস্থলে এসেছিল। অথচ দেশের এক মন্ত্রী ভিন্ন দেশে গিয়ে বলেছিলেন, সাভার ঘটনা সিরিয়াস কিছু নয়। বিএনপির এক নেতা সে দিন টিভির এক টকশোতে সাভারের ট্র্যাজেডিকে বিমান দুর্ঘটনার মতোই একটি ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। তার বক্তব্য ও উদাহরণে অনুষ্ঠানের উপস্থাপকের মতো আমিও বেশ বিস্মিত হয়েছি। আসলে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবন আর তেলাপোকার জীবনের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। সাভারে উদ্ধারকাজের শেষাংশে ধ্বংসস্তূপ থেকে হঠাৎ করেই বেরিয়ে আসা সারি সারি লাশগুলো দেখে তা-ই মনে হলো।
বাংলাদেশ এমনই এক আজব দেশে পরিণত হয়েছে যে জেলহাজতে থাকা নারীরাও সেখানে নিরাপদ নয় এবং নির্যাতিত হচ্ছে। সম্প্রতি এক নিউজে দেখলাম এক নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক ছাত্রীর জামার হাতা কেটে দেয়া হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আটটি মসজিদের মাইক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে সেসব মসজিদে আজান দেয়াও বন্ধ করা হয়েছে। হেফাজতের সমাবেশে কত লোক মারা গেছেন আজ পর্যন্ত কেউ সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেনি। অনেকেই বেশ আস্থার সাথে বলছেন এ গণহত্যার সাথে পাশের দেশের লোকবল জড়িত। কিছু ছবি ও ভিডিও ফুটেজ এবং ভিন্ন ভাষী লোকদের কথোপকথনের আলামত তা-ই ইঙ্গিত করে। একটি জাতীয় দৈনিক এ বিষয়ে একটি বিষদ রিপোর্টও সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। কথাগুলো সত্য হলে বাংলাদেশকে আর গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বলা যাবে না।
আমি প্রায় এক যুগ ধরে ঢাকায় অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনারের কাছ থেকে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে সৃষ্ট সহিংসতার কারণে সেখানে ভ্রমণ নিরাপদ নয় এর ওপর কড়া সতর্কতাস্বরূপ ই-মেইলবার্তা পেয়ে আসছি। কয়েক বছর আগে ই-মেইলটি আসত বছরে একবার কি দুইবার; কিন্তু গত ছয় মাসেই গড়ে সপ্তাহে কমপে একটি করে ই-মেইল পাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে একদিন বিদেশীরাও বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তখন দেশে অর্থনীতি বলে আর কোনো শব্দই থাকবে না।
বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতির জন্য আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি এবং অসুস্থ ধারার বিচার প্রক্রিয়াই প্রধানত দায়ী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় স্বয়ং জাতিসঙ্ঘ পর্যন্ত গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সন্দেহের দানা বেঁধেছে বাংলাদেশের নিরাপত্তারীদের কাজের মান নিয়ে। আলোচনায় এসেছে আদৌ জাতিসঙ্ঘের দূত হিসেবে নিয়োগ পাবে কি না। তাদের এ উক্তির সাথে আমি কাজের মিল পাই গত বছর দেশে অবস্থানকালে। ট্রেনে করে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সময় দেখি কিছু লোক ব্যাজ গলায় লাগিয়ে কিছু কিছু যাত্রীর ব্যাগ চেক করছে এবং হাতে থাকা রিভলভারের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে ঘুরাচ্ছে। তাদের কার্যকলাপ দেখে আমি আমার বাবা-মাসহ অন্যরা বেশ অবাক হই। কারণ তারা যদি সত্যিকার আইনের লোক হয়ে থাকেন, এভাবে এগুলো ঘুরাতেন না। এভাবে ঘুরানোর ফলে যেকোনো মুহূর্তে বাটনে চাপ লেগে একজন সাধারণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যেতে পারেন। কারণ আমার জানা মতে, রিভলভার সর্বদাই প্রস্তুত রাখতে হয় যেকোনো সমস্যা মোকাবেলায় তৎণাৎ ব্যবহারের জন্য। তাদের অ্যাকশন আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছিল ছোটবেলায় দেখা জসীম-জাম্বু অভিনীত কোনো এক ছবির দৃশ্য। একই সাথে তাদের চেহারা ছুরত দেখে বেশ সন্দেহ হচ্ছিল, তারা আদৌ আইনের কি না।
গত কয়েক বছরে দেশ অসংখ্য প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, যার বেশিরভাগ এখনো অসমাপ্ত রয়ে আছে। আর কয়েক মাস পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সরকারসহ দেশের সব রাজনীতিবিদের জন্য এটি এক মহাঅগ্নিপরীা। যদিও অনেকেই মনে করেন এ পরীার সফলতার ওপরই নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ, আমি একটু ভিন্নমত পোষণ করছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দেশ তখনই শান্ত হবে যখন চারটি বিষয়ের সুরাহা হবে। বিষয় চারটি বেশ জটিল হলেও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাধানও অসম্ভব নয়। ১) বিডিআর বিদ্রোহের যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে ৫৯ সেনা অফিসারের হত্যাকাণ্ডের হোতাদের বের করা ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যাতে বাংলাদেশের জীবদ্দশায় আর কেউ এমন জঘন্য ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়। ২) আস্তিকতা ও নাস্তিকতার সমাধান করা। আগে এ বিষয়টি দেশের কিছু কিছু মানুষের মনে মনে ছিল; কিন্তু এখন বিষয়টি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। ৩) আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে দলমত নির্বিশেষে প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত ট্রাইব্যুনালে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা। ৪) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুর মীমাংসা করা ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads