মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০১৩

চেতনার ভিশন বনাম মতা কুক্ষিগত করার মিশন

কয়েক দিন ধরে জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের মুখে ভিশন ২০২১ নিয়ে বেশ কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার মতায় আসার পর তাদের যেসব উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও চমক সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ভিশন ২০২১ বাংলাদেশের মানুষ এমন ভিশন বা ল্েযর কথা এর আগে এভাবে কোনো সরকারের কাছে শোনেনি। তাই স্বভাবতই নতুনের প্রতি মানুষের যে সহজাত আগ্রহ, সেই পটভূমিতে ভিশন ২০২১ মানুষ বেশ ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করেছে। যদিও রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যে বৈশিষ্ট্য, তা পর্যালোচনায় অনেক সচেতন মানুষই এই ভিশন দলটির মতা কুগিত করার ষড়যন্ত্র কি না, এমন সন্দেহের কথা জানিয়ে আসছেন। 
সম্ভবত রাজনীতি-সচেতন আওয়ামী লীগ মালয়েশিয়ার মহান রাষ্ট্রনায়ক ও আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক তুন ড. মাহাথির মোহাম্মদের ভিশন ২০২০ থেকেই ভিশন ২০২১ এর ধারণা লাভ করেছেন। কিন্তু একেবারেই দেশপ্রেমের মহান ব্রত নিয়ে মাহাথির মোহাম্মদ যে ভিশন ২০২০ গ্রহণ করেছেন, তা নিয়ে দেশটির জনগণের মধ্যে বিন্দুমাত্রও কোনো সন্দেহ সৃষ্টি হয়নি। মাহাথিরও মানুষের মধ্যে যাতে ন্যূনতম কোনো সন্দেহ না জাগতে পারে, সে ব্যবস্থাই করেন।
১৯৯১ সালে মাহাথির আধুনিক মালয়েশিয়া গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ভিশন ২০২০ নামে ৩০ বছর মেয়াদি এই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শুধু নিজের মতা ধরে রাখার ষড়যন্ত্র হিসেবে নয়; প্রকৃত অর্থেই উন্নয়নের ল্েয যে এই ভিশন তা প্রমাণিত হয় তার কার্যক্রমে। তাই তো দেশটিকে একটি চমৎকার অবস্থানে রেখে এবং নিজে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থানের সময় ২০০৩ সালে মতা থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। এমন নজির আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতিতে কল্পনাই করা যায় না। অথচ এই ল্যমাত্রার অধীনে মাহাথিরের মতা ছেড়ে যাওয়ার পরও ব্যাপক কাজ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মাত্র দুই বছরে ৪৪০ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণ ও পুরনো রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি, এ সময়ের মধ্যে ২০ হাজার ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ, ৩৬ হাজার পরিবারে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের ১৪ হাজার ঘর নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে।
এবার আসা যাক মাহাথিরের মতা গ্রহণের গোড়ার দিকে। তিনি দায়িত্ব নেয়ার আগে দেশটির অর্থনীতি ছিল একেবারেই সাদামাটা। বাংলাদেশের মতোই একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে ছিল এর পরিচিতি। তার দায়িত্ব নেয়ার মাত্র এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮০ সালেও দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১২ বিলিয়ন ডলার। মাত্র ২২ বছরের ব্যবধানে ২০০২ সালে দেশটির জিডিপির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ২১০ বিলিয়ন ডলারে। ২০০৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর Bloomberg Businessweek Magazine এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়। একই বছরে অর্থাৎ ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ছিল ১৮.১১ বিলিয়ন ডলার। ২০০২ সালে এর পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৭.৫৭ বিলিয়ন ডলারে। বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য থেকে এ চিত্র পাওয়া যায়।
অর্থাৎ ২২ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে ২৯.৪৬ বিলিয়ন ডলার। অন্য দিকে একই সময়ের ব্যবধানে মালয়েশিয়ার জিডিপি বৃদ্ধির পরিমাণ হলো ১৯৮ বিলিয়ন ডলার। সহজ কথায় ১৯৮০ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ২২ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের চেয়ে মালয়েশিয়ার জিডিপি বেশি বেড়েছে ১৬৮.৫৪ বিলিয়ন। অথচ ১৯৮০ সালে মালয়েশিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ দেড় গুণেরও বেশি ছিল। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১০.৬ বিলিয়ন ডলারে। অন্য দিকে ২০১১ সাল নাগাদ মালয়েশিয়ার জিডিপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭৮.৬৭ বিলিয়ন ডলারে।
এভাবেই উন্নয়ন সূচকের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করলে প্রায় সব বিভাগেই দেখা যাবে, দুই দেশের বিস্তর ফারাক। দুটোই দণি এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এর যাত্রা শুরু করে। তাই এই দুই দেশের মধ্যে তুলনা দেয়াকেই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। এবার ভিশন ২০২০ বাস্তবায়নে মাহাথিরের নেয়া অনেক পদেেপর মধ্যে একটি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক, যা বাংলাদেশের উপকারে আসতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।
মালয়েশিয়াকে উন্নয়নের শীর্ষে নিয়ে যেতে তুন ড. মাহাথির মোহাম্মদের যেসব পদপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তার অন্যতম কর্মসূচি হচ্ছে তার মহাসড়ক কর্মসূচি। দেশের রাজধানী শহর থেকে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত প্রশস্ত— সড়ক নির্মাণ করেছেন। এই সড়ক কখনো ঘন জঙ্গল, আবার কখনো বিস্তীর্ণ মাঠ, আবার কখনো নদী বা খালের ওপর দিয়ে ব্রিজ আকারে চলে গেছে। এটিকে সেই সময় দেশবাসীর কাছে মস্তবড় পাগলামি হিসেবেই মনে হয়েছে। অনেকেই এ নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসিও করেছেন তখন। কিন্তু যখনই এ সড়কের নির্মাণ শেষ হলো, যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ এসে ধরা দিলো মালয়েশিয়ার জনগণের কাছে।
বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করি। এই সড়ক যখন ব্যবহৃত হতে শুরু করল, মালয়েশিয়ার প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে গড়ে উঠল বড় বড় শিল্পকারখানা। কারণ পণ্য বা কাঁচামাল পরিবহনের কোনো সমস্যা নেই। মুহূর্তেই সব কিছু পৌঁছে যাচ্ছে দেশের যেকোনো প্রান্তে আর রাজধানীতে তো বটেই। পাগলা ঘোড়ার মতোই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল মালয়েশিয়ার অর্থনীতি। পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় কমিয়ে দেশবাসীকে যখন সততা ও কঠোর পরিশ্রমের মন্ত্রে উদ্ধুব্ধ করতে সম হলেন মাহাথির মোহাম্মদ, তখন দেশটির উন্নতির চাকা এতটাই দ্রুততার সাথে এগিয়ে চলল যে, বিশ্ববাসীকে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেয়া সম্ভব হলো।
এবার আসা যাক বাংলাদেশে। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে শুরু করে উত্তরে অনেক দূর পর্যন্ত এখনো লাখ লাখ একর জমি পড়ে আছে। বুড়িগঙ্গা ব্রিজ পেরিয়ে দেিণ কেরানীগঞ্জ সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে লাখ লাখ একর জমি। এভাবে ঢাকার আশপাশে অনেক জমিই এখনো পড়ে আছে। কিন্তু এসব জায়গা থেকে বিমানবন্দরে আসতে বা রাজধানীর যেকোনো জায়গায় আসতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়। আর সে কারণেই ঢাকার মধ্যে গাদাগাদি করেই সব কিছু গড়ে উঠছে। দেশের প্রধান রফতানি খাত গার্মেন্ট শিল্পেরও একটি বড় অংশই ঢাকার একেবারে ভেতরে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে। পুরান ঢাকার চিপা গলিতে পড়ে আছে শত শত প্লাস্টিক কারখানা। ঘটছে নিমতলি বা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো মর্মান্তিক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। আর এতে মাঝে মধ্যেই থমকে যাচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগ।
কিন্তু এর পরও এখনো বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা শ্রম ও জনবহুল এই ছোট্ট দেশটিতে বিপুলসংখ্যক কর্মম শ্রমিক থাকায় এখনো টিকে আছে এ দেশের গার্মেন্ট শিল্প। বড় প্রতিবেশী দেশসহ নানা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মুখেও থেমে নেই এই শিল্পের বিকাশ। কিন্তু এভাবে আর কত দিন টিকে থাকা যাবে? এমন শঙ্কা মাঝে মধ্যেই সব ওলট পালট করে দিতে চায়।
এর সমাধানের পথ অবশ্য একটি নয়। এর সাথে মালিকদের ভূমিকা, সরকারি সুব্যবস্থাপনা, জ্বালানি সঙ্কটের সমাধানসহ অনেক কিছুই জড়িত রয়েছে। তবে অবশ্যই মালয়েশিয়ার মতো রাজধানীর সাথে সংযুক্ত থাকবে এমন একটি মহাসড়ক অবশ্যই দরকার, যাতে শহরের আশপাশে যেকোনো বড় শিল্পকারখানা বা শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠলে তার মালামাল কোনো যানজট ছাড়াই পৌঁছে দেয়া যাবে বিমানবন্দরসহ প্রয়োজনীয় গন্তব্যে।
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে খুব সাদামাটাভাবেই বিষয়টির অবতারণা করলাম। সরকার এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দল নিয়ে কাজ শুরু করবেÑ এমনটিই কামনা থাকল। শুধু মতা কুগিত করার মানসিকতা থেকে সরলপ্রাণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কোনো ভিশন ঘোষণা না দিয়ে সত্যিকার অর্থেই ভিশন ঠিক করা হোক। সে ল্েয অন্তত মাহাথিরের মতো মহাসড়কের মতো একটি পদপে হলেও সরকার গ্রহণ করবে সে প্রত্যাশাই দেশবাসীর।
পরিশেষে একটি বাস্তবতার গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। অনেকবার ইরান সফর করেছেন আমার এমন এক শিক্ষকের কাছে শোনা গল্প। স্যার বলেছেন, ইরানে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর আমেরিকার সাথে ইরানের যে মহাতিক্ততার শুরু তার সামান্যও নড়চড় হয়নি এখনো। ইরানকে কোণঠাসা করতে আমেরিকার নেতৃত্বে একের পর এক অর্থনৈতিক অবরোধ ইরানকে প্রতি মুহূর্তে হোঁচট খেতে বাধ্য করছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলোÑ ইরানের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রায় সব অবকাঠামো ও নির্মাণ শিল্পের প্রায় শত ভাগই আমেরিকাকে অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে। এর কারণ জানতে চাইলে ইরানিরা যে জবাব দিলেন তা হলো কোনো উন্নয়ন হঠাৎ করে হয় না। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বারবার নানা ভুলত্র“টি শুধরিয়ে বর্তমান পৃথিবীতে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছেছে আমেরিকা। আমাদের এখন বছরের পর বছর নষ্ট করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দরকার কী? আমরা বর্তমান আমেরিকা বারবার হোঁচট খেয়ে উন্নয়নের যে পর্যায়ে এসেছে, সেখান থেকেই শুরু করতে চাই আমাদের যাত্রা। সুতরাং আমাদের মতো এত ছোট ও গরিব দেশের এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় নয়, এখন সময় পরীতি পথ অনুসরণ করে দ্রুত উন্নতি আর অগ্রগতির পথে ধাবিত হওয়া। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads