সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৩

সিটি নির্বাচন : একটি বিশ্লেষণ


গত ১৫ জুন দেশের চারটি সিটি কর্পোরেশন যথাক্রমে সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল এবং খুলনায় মেয়র ও কাউন্সিলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে চারটি মহানগরীতেই আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীরা বিরাট ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন। বলাবাহুল্য এই চারটি মহানগরীর মধ্যে ইতোপূর্বে সিলেটে বদরুদ্দিন কামরান, রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান লিটন, বরিশালে শওকত হোসেন হিরণ এবং খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক মেয়র হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং এদের সকলেই নিজ নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের জাদরেল নেতা ছিলেন। ১৫ জুনের নির্বাচনে এদের সকলেই ধরাশায়ী হয়েছেন। সিলেটের বদরউদ্দিন কামরান তার ১৮ বছরের ঐতিহ্য ভেঙ্গে ১৮ দলীয় প্রার্থী ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে ৩৮ হাজার ৪৪৯ ভোটে পরাজিত হয়েছেন। রাজশাহীর খায়রুজ্জামান লিটন বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের কাছে ৪৮৩৮০ ভোটে, বরিশালের শওকত হোসেন হিরন বিএনপির আহসান হাবিব কামালের কাছে ১৮০১০ ভোটে এবং খুলনার তালুকদার আবদুল খালেক বিএনপির মনিরুজ্জামান মনির কাছে ৬১১০৭ ভোটে পরাজিত হয়েছেন। ভোট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থীরা মোট প্রদত্ত ভোটের ৬০ শতাংশের বেশী এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থীরা ৪০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছেন। ১৪ দলীয় প্রার্থীদের কেউই তাদের নিজস্ব ভোট কেন্দ্রে জয়ী হতে পারেননি। শুধু মেয়র নির্বাচন নয়, কাউন্সিলর নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট মর্মান্তিকভাবে পরাজয় বরণ করেছেন। ১১৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৭৫টিতে ১৮ দলীয় জোট, ৩১টিতে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। অবশিষ্ট ১০টি পদ পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন বাংলাদেশে বরাবর একটি নির্দলীয় নির্বাচন হিসেবে গণ্য হয়ে আসলেও সম্ভবত এবারই সর্বপ্রথম জাতীয় ইস্যুকে সামনে রেখে এবং ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক জোটদ্বয়ের সমর্থনে প্রার্থী মনোনয়ন এবং নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থীদের কাছে গোহারা হেরেছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের এই ভরাডুবিকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় তার নেতৃত্বাধীন ১৪ দল সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থীরা পরাজিত হওয়ায় দলটির নেতারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এই দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য হতাশার সুরেই বলেছেন, ‘এইভাবে ভাবিনি। ভেবেছিলাম দুটি জিতব হারব দুটিতে।’ ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশ কয়েকজন সংশ্লিষ্ট চারটি সিটি কর্পোরেশন ঘুরে এসে পরাজয়ের কারণও ব্যাখ্যা করেছেন। তারা বলেছেন যে, টালমাটাল জাতীয় রাজনীতিতে জনসমর্থনের হাওয়া বদল, মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নয়ন কর্মকা- না করা, দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা এবং নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব, কোন্দল আর দলীয় অনৈক্যের কারণে চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবি ঘটেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক সরকারি দলের পরাজয়ের কারণ অন্বেষণ করতে গিয়ে বলেছে যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল পদ্মাসেতু দুর্নীতি, শেয়ার বাজার ও হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতাদের লুটপাট দুর্ব্যবহার প্রভৃতি কারণে সরকারি দল ও জোট সিটি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সরকারি জোটের এই পরাজয়কে অশনী সঙ্কেত বলে মন্তব্য করেছেন এবং বলেছেন যে, বাংলাদেশে পরিবর্তন করার যে ট্রেডিশন আগামীতেও তা থাকবে কি থাকবে না এ ব্যাপারটি গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। এই পরাজয়ের পর দলটির নেতারা নতুন রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করছেন বলে জানা গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে আর কোন নির্বাচন না দেয়ার জন্য দলে একটি চাপেরও সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন জাতীয় নির্বাচনের আগে আর কোনও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা পরাজিত হলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে এবং নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়তে পারেন। এর প্রভাব জাতীয় নির্বাচনের উপরও পড়বে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য এই পরাজয়ের ভিন্ন একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যে করতে পারে সিটি নির্বাচন এর একটা প্রমাণ। এর ফলে তার দৃষ্টিতে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা ও দাবি অসার প্রমাণিত হয়েছে। ১৮ দলীয় জোট অবশ্য বলেছে যে, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তাদের বিজয় তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে আরো শক্তিশালী করেছে। বিরোধী দলের এই মন্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী একটি হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন। তিনি তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক সরকার হিসেবে অভিহিত করে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই সরকার তথা তত্ত্বাবধায়ক চাইলে দেশে নির্বাচনই হবে না। সেটা কারো জন্য ভালো হবে না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বেশিরভাগই প্রধানমন্ত্রীর এ মন্তব্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন। যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত তারা জানেন যে, আওয়ামী লীগের পক্ষে একান্ত বাধ্য না হলে ক্ষমতা ছাড়া কষ্টকর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের দ্বারা গঠিত প্রথম সরকারের আমলে মাত্র দুই-আড়াই বছরের মাথায় তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামায় চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তারা একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে দেশের সকল রাজনৈতিক দলই শুধু নিষিদ্ধ করেননি দলীয় ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় চারটি দৈনিক পত্রিকা রেখে দেশের বাকি সকল পত্র-পত্রিকাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পার্লামেন্টের নির্ধারিত নির্বাচন বন্ধ করে দিয়ে আইন পাস করে বিনা নির্বাচনে বিদ্যমান সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে আজীবন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এখানে জনমত বা নির্বাচনের কোন বালাই তারা রাখেননি। রক্ষীবাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে বিরোধী দলের চল্লিশ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিলেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ ঐ আওয়ামী লীগেরই উত্তরসূরী এবং অনেকেরই ধারণা দলটির জুলুম-নির্যাতন দুর্নীতি-অপশাসন ও লুটপাট এবং দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় মূল্যবোধকে নিশ্চিত করে দেয়ার যে তৎপরতা শুরু হয়েছে তাতে বর্তমানে এই দলের জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় যদি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে দেশের ভোটাররাই রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঝুঁকি নিতে পারেন না। এবং পারেন না বলেই তিনি যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য জামায়াতকে সাথে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং অব্যাহত হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগেরে মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারকে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য করেছিলেন এবং দুইবার এর অধীনে নিজেই ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তিনি বাতিল করে দিয়েছেন এবং তাকে এখন অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করছেন। বিশ্লেষকদের ধারণা তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিরোধী দলের আন্দোলন যদি আরো জোরদার হয় এবং শেখ হাসিনা যদি বুঝতে পারেন তার আর ক্ষমতায় থাকার কিংবা আসার সম্ভাবনা নেই তাহলে তিনি দুটি কাজ করতে পারেন; (১) নির্বাচন বন্ধ করে দিয়ে তার পিতার ন্যায় সংসদে আইন পাস করে বর্তমান সংসদের মেয়াদ আরো ৫ বছর বৃদ্ধি করে দিতে পারেন। (২) তিনি তৃতীয় কোন শক্তির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন। কিন্তু কোন অবস্থাতেই তিনি বিএনপি জোটের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজী হবেন বলে মনে হয় না। বিশ্লেষকদের এই ধারণা কতটুকু সত্য হয় একমাত্র ভবিষ্যতই তা বলে দিতে পারে।
এখন সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে আসি। সিটি নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও আমি আগেই বলেছি, এতে জাতীয় ইস্যুগুলো প্রাধান্য পেয়েছে এবং এই প্রেক্ষিতে এই নির্বাচনকে ঝবসর-ঘধঃরড়হধষ ঊষবপঃরড়হ তথা আধা জাতীয় নির্বাচনের মর্যাদা দেয়া যেতে পারে। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের ভরাডুবির একাধিক তাৎপর্য রয়েছে। অনেকের মতে এই নির্বাচনটি ছিল বিরোধী দলের জন্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি টোপ। তারা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দেশে ও বিদেশে অনুকূল একটি পরিবেশ ও প্রচারণা চালানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। আমার দৃষ্টিতে তাদের এই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। তারা এক টোপে সর্বোচ্চ দুটি শিকার হয়ত পাবার আশা করেছিলেন। কিন্তু চারটি শিকারই যে বিরোধীদের ছিপে আসবে তা তাদের ধারণাতীত ছিল। আবার একশ’ ভাগ মেয়রের সাথে সাথে ৭৬ শতাংশ কাউন্সিলর পদও যে তাদের হারাতে হবে তা তারা ভাবেননি। এই অবস্থা তাদের জন্য বিব্রতকর। দ্বিতীয়ত এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটারদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই ক্ষোভের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এই কারণগুলোর মধ্যে দৈনিক প্রথম আলোর ভাষায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও শেয়ারবাজারের লুটপাট, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতাদের লুটপাট-দুর্ব্যবহার এবং দমন-পীড়ন প্রধান। পত্রিকাটির এই অনুসন্ধানের সাথে সম্ভবত দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ খুবই কম। কিন্তু এর বাইরেও যে কারণগুলো সরকারি জোটের ভরাডুবির পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে রয়েছে ধর্ম, বিশেষ করে দেশের ৯০ ভাগ মানুষের ঈমান, আকীদা, ও জীবনাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান, সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের ধারা বাতিল করে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপন, নাস্তিক মুরতাদদের তোষণ, দেশ থেকে ইসলামী রাজনীতি উচ্ছেদের লক্ষ্যে সম্পূর্ণ অন্যায়, অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিকভাবে জামায়াত-শিবিরের উপর ক্র্যাকডাউন, দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের উপর পর্যন্ত জুলুম-নির্যাতন, গ্রেফতার-রিমান্ড এবং হাজার হাজার শিবির নেতা-কর্মীর শিক্ষাজীবন ধ্বংসকরণ এবং দেশের আলেম-ওলামা ও হেফাজতে ইসলামের ওপর ফেরাউনী আচরণ। শাপলা চত্বরের গণহত্যাকেও মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। ভোটের মাধ্যমে সরকারের দুঃশাসনের তারা জবাব দিয়েছেন। আবার সরকারের টোপও তারা বুঝতে পেরেছে এবং এর ফলে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আরো জোরদার হয়েছে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে মহড়া চালাতে চেয়েছিলেন সরকারি দলের আচরণে তার মান যথেষ্টভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। বিরোধী দলের একজন মেয়র প্রার্থীর উপর সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে এবং পুলিশ ঐ প্রার্থীকে লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়লে তার দেহরক্ষী তাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। নির্বাচনকালে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনী বিধিমালা লঙ্ঘন করে দলীয় প্রার্থীর অনুকূলে প্রচারণা চালিয়েছেন এবং সরকারি গাড়ি এবং সম্পদের অপব্যবহার করেছেন। সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছেন এবং বহু কেন্দ্রে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের এজেন্টদের ঢুকতে দেননি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে দৈহিকভাবে নির্যাতন করে তাদের বের করে দিয়েছেন। এসব ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। প্রশাসন কিংবা নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আবার ভোট গণনার ক্ষেত্রেও তারা বাধার সৃষ্টি করেছে এবং ভোটের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নেয়ার জন্যে নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করেছেন এবং বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করেছে। সরকার নিরপেক্ষতার মহড়া দিতে গিয়েও তাদের থামাতে পারেননি। চারটি সিটি কর্পোরেশনে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে দলীয় সরকারের অধীনে দলীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং এমপিদের ক্ষমতায় রেখে ক্ষমতা রদবদলের জন্যে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তাতে অবস্থা কি হবে তা সহজেই অনুমেয়। মেয়র প্রার্থীদের ঘোষণাপত্র বিশ্লেষণ করে প্রদত্ত সুজন পরিবেশিত এক তথ্যে দেখা গেছে যে, গত পৌনে পাঁচ বছরে বিদায়ী চার মেয়রের গড় আয় বেড়েছে ৬৭৪৭.১৮ শতাংশ। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের গড় আয় কমেছে ২২.৭৮ শতাংশ। ক্ষমতায় যাওয়ার পর মেয়রদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির এই হারকে মানুষ মেনে নিতে পারেনি।
টিআইবি’র রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত বছরসমূহে বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েছে। দুর্নীতিতে বাংলাদেশ এশিয়ায় দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্প, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, রেলের দুর্নীতি, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ইউনিপেটুইউ, আইটিসিএল এবং বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাহীন দুর্নীতি। শেয়ারবাজারের পুঁজি হারিয়ে ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী দিশেহারা হয়ে বিক্ষোভ আন্দোলনে মাঠে নামলে আওয়ামী লীগ সরকার নির্মমভাবে তাদের দমন করেছেন। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঘুষ কেলেঙ্কারিতে ধরা পড়লেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী বানিয়েছেন। তিনি নির্লজ্জের মতো জাতিকে উপদেশ দিয়ে বেড়ান। ভোটাররা এটিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। জনস্বার্থে আত্মত্যাগের কথা বলে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা সরকারি-বেসরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারা বেসরকারি ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় ও টেলিভিশন, বিদ্যুৎ ও টেলিকম খাত, জাহাজ নির্মাণ থেকে শুরু করে নতুন নতুন ব্যবসা ও একচেটিয়া লাইসেন্সেরও অনুমতি নিয়েছেন। এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ। বিদ্যুৎ ও টেলিকমসহ গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক একাধিক সেক্টর এ প্রতিষ্ঠানটির একচেটিয়া দখলে চলে গেছে। পিছিয়ে নেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরও। তিনি বেসরকারি ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়, শিপিং ব্যবসাসহ বেশকিছু ব্যবসার সুবিধা নিয়েছেন। বিদ্যুৎ সেক্টরেও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা লুটেছেন। এতে বিমানমন্ত্রী ফারুক খানের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এনামুল হকের মালিকানাধীন নর্দার্ন পাওয়ার সলিউশন লিমিটেড, সরকার সমর্থিত প্রতিষ্ঠান শিকদার গ্রুপের পাওয়ারপ্যাক হোল্ডিংস, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনাল, কোয়ান্টাম পাওয়ার লিমিটেড ছাড়াও নামে-বেনামে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের একজন হুইপ, ঢাকার একজন সংসদ সদস্যসহ সরকারি দলের বেশ কয়েকজন নেতা ও এমপি পেয়েছেন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ।
বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, এমপি, তাদের স্বজন কিংবা সরকারদলীয় নেতারা নতুন জাহাজ তৈরির ৩২টি লাইসেন্স ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। অনেক মন্ত্রী-এমপি জাহাজ তৈরির লাইসেন্স নিয়েছেন স্বনামে-বেনামে। বর্তমান সরকারের আমলে আইটি তথা টেলিযোগাযোগ খাতে যত লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই পেয়েছে সরকার দলের লোকজন। সরকারের সঙ্গে ব্যবসা না করার ক্ষেত্রে এমপিদের বিধান উপেক্ষা করে অনেক মন্ত্রী-এমপি নিজের নামে লাইসেন্স নিয়েছেন। অনেকে নিয়েছেন আত্মীয়ের নামে।
ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের বিগত সাড়ে চার বছরে রাজনীতির নামে ছাত্রলীগ নানা অপরাজনৈতিক কর্মকা-ে নিজেদের সম্পৃক্ত করে জনগণের আস্থায় কুঠারাঘাত করেছে। অনেকটা বিনা বাধায় তারা দেশজুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হানাহানি, টেন্ডারবাজি, খুন ও ধর্ষণের মতো অসংখ্য অঘটন ঘটিয়েছে। যাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে। সরকারদলীয় ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠনের উন্মত্ত সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া লুটপাট, হত্যা, গুম ছাড়া বিরোধী দল বিশেষ করে জামায়াত ও বিএনপির উপর ফেরাউনী কায়দায় জুলুম-নির্যাতন এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমায় তাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করার বিষয়টি সাধারণ মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। তারা ক্ষমতাসীনদের চরিত্রে ফেরাউনী বৈশিষ্ট্যের অভিব্যক্তি দেখতে পেয়েছেন।
আমি উপরে যে কথাগুলো বললাম এর সবগুলোই হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতিবাচক দিক। যা ভোটারদের সরকারি দলের প্রার্থীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। এগুলো ছাড়াও যে ইতিবাচক বিষয়গুলো ১৮ দলীয় জোটের বিজয়কে নিশ্চিত করেছে তার মধ্যে রয়েছে জোটভুক্ত দলগুলোর দৃঢ় ঐক্য ও অঙ্গীকার। ক্ষমতাসীন মহাজোটকে ১৪ দলের জোট বলা হলেও তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোন দলের খুব একটা দেখা পাওয়া যায় না। আবার আওয়ামী লীগের মধ্যেও সুযোগ-সুবিধা, টেন্ডার ও চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে সর্বত্রই একাধিক গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ লেগেই আছে। ১৮ দলীয় জোটে জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোটসহ বেশকিছু দল রয়েছে, যারা তৃণমূল পর্যায়ে অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং তাদের সাথে হেফাজত যুক্ত হয়ে তাদের আরও শক্তিশালী করেছে। বিএনপি’র মধ্যে কোথাও কোথাও আন্তঃদলীয় কোন্দল দেখা গেলেও সিটি নির্বাচনের প্রাক্কালে তাদের এই কোন্দল সম্পূর্ণভাবে প্রশমিত হতে দেখা গেছে এবং তারা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রার্থীদের নির্বাচনী কাজে সহায়তা করেছেন। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে এবং জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগের পক্ষে তার অবস্থান ধরে রাখা খুবই কঠিন হবে বলে আমার বিশ্বাস।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads