বৃহস্পতিবার, ৬ জুন, ২০১৩

অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকিতে তবু বিশাল বাজেট


অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল জাতীয় সংসদে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বিশাল এক বাজেট পেশ করেছেন। পঞ্চম বারের মতো বাজেট দিতে পারার সাফল্যে উল্লসিত অবস্থায় থাকলেও বাংলাদেশের মতো গরিব একটি দেশে এত বিপুল অর্থ তিনি ঠিক কোন ধরনের খাত থেকে যোগাড় করবেন সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি তার বাজেট প্রস্তাবে। পাশাপাশি বরং ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা ঘাটতি রাখার মধ্য দিয়েও তিনি গভীর সংশয়ের সৃষ্টি করেছেন। মূল্যস্ফীতির মতো অনিবার্য কিছু বিষয়ও রয়েছে, যেসব বিষয়ে সত্য এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সরকার আগেই রেকর্ড করে রেখেছে। ওদিকে বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে এবারও ‘বিপ্লব’ ঘটানোর আয়োজন করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি আয়ের পরিমাণও যখন কমতে থাকবে মানুষ তখন কীভাবে বেশি-বেশি টাকা কর দেবে এবং করের পরিমাণ না বাড়লে সরকারই বা প্রকল্প বাস্তবায়নসহ ব্যয় মেটানোর অর্থ কোথায় পাবেÑ এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই বাজেটে। আরও অনেক মৌলিক প্রশ্নেরও জবাব দেননি অর্থমন্ত্রী। এসব বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা করা যাবে। কিন্তু এই সময়ে যে কথাটা না বললেই নয় তা হলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেন্ডার বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা পর্যন্ত কেলেংকারী অপ্রতিহতভাবে বেড়ে চলেছেÑ যার ফলে বহু প্রকল্পই অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। গত অর্থবছরের অনেক প্রকল্প এখনো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কিন্তু এসব বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি রয়েছে বিপুল পরিমাণে রেমিট্যান্স এবং ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক সাহায্য ও ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত রফতানি আয় কমে যাওয়ার মতো কিছু বিষয়। রয়েছে গার্মেন্ট খাতের বিরাট বিপর্যয়ও। অন্য কিছু কারণেরও উল্লেখ করা দরকার। যেমন লম্বা অনেক আশ্বাস শুনিয়ে ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ সরকার এখনও গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ জ্বালানির সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর ফলে পণ্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারলেও সরকার দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোল, অকটেন ও সিএনজিসহ জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে কিছুদিন পরপরই। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় তো বটেই, পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে গেছে যথেষ্ট পরিমাণে। সব কিছুর জন্যই শেষ পর্যন্ত বাড়তি দাম গুণতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বাজার নিয়ন্ত্রণে শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনাতেও সরকার ক্ষতিকর ব্যর্থতা দেখিয়ে এসেছে। এদিকে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করার আগেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছেও কয়েকদিন আগে থেকেই। কিছুদিন ধরেই ব্যবসায়ীরা দাম হাঁকাচ্ছেন যথেচ্ছভাবে। অথচ নিয়ম হলো, অর্থমন্ত্রী প্রথমে সংসদে প্রস্তাব আকারে বাজেট পেশ করবেন। সে প্রস্তাবের নানাদিক নিয়ে সংসদ সদস্যরা আলোচনা করবেন। সবশেষে ৩০ জুন বাজেট প্রস্তাব পাস হবে। যদি বাড়ানো হয় তাহলে পণ্যের দাম বাড়বে ১ জুলাই থেকে। কোনো কোনো পণ্যের এমনকি দাম কমারও সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে আমাদের দেশের নিয়ম হলো, বাজেট আসছে কথাটা প্রচারিত হতে না হতেই ব্যবসায়ী-মহাজনরা দাম বাড়ানোর জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন। এ নিয়ম চলে আসছে বহুদিন ধরে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সেটা আরও দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে এজন্য যে, ব্যবসায়ী-মহাজনদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের লেনদেনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সোজা কথায়, ব্যবসায়ী-মহাজনদের কাছ থেকে চাঁদা ও কমিশন আদায় করা হয়। একই কারণে সরকার একদিকে চোখ বুঁজে থাকে, অন্যদিকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ব্যবসায়ী-মহাজনরা। মাঝখান থেকে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা যায়, তাদের জিহবা বেরিয়ে আসে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি, উপরন্তু নির্বাচনের বছর বলে সরকার ও ব্যবসায়ী-মহাজনদের উভয় পক্ষই সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো পণ্যের নাম বলা যাবে না, যার দাম লাফিয়ে না বেড়েছে। এতে অবশ্য কিছুই যায়-আসে না ক্ষমতাসীনদের। এজন্যই জনগণের এই কঠিন দুর্দশার মধ্যেও ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে অর্থমন্ত্রীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। এজন্যই চারদিকে যখন শুধু নেই আর নেই তখনই তিনি এত বিশাল আকারের একটি বাজেট পেশ করেছেন। বলা দরকার, এভাবে চমক দেখাতে পারলেও অর্থমন্ত্রী কিন্তু জনগণকে মোটেও আশান্বিত করতে পারেননি। জনগণ বরং ভীষণভাবে হতাশ ও ভীত হয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, লক্ষ হাজার কোটি টাকার বাজেটের মাধ্যমে চমক দেখানোর পরিবর্তে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে যদি প্রাধান্য দেয়া হতো এবং মানুষকে যদি লাফিয়ে বেড়ে চলা পণ্যমূল্যের কবল থেকে কিছুটা হলেও নিস্তার দেয়া হতো তাহলেই জনগণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারতো। সেটাই যে কোনো নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্বও বটে। কিন্তু এবারও সে দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতাই দেখিয়েছে সরকার। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর পরিণতি শুভ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির পাশাপাশি আমদানি ব্যয়ে বিপুল বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স আয়, বৈদেশিক সাহায্য ও এডিপিতে বিদেশি অর্থায়ন কমে যাওয়ার ফলে এরই মধ্যে ভারসাম্যে বিরাট ঘাটতির মুখে পড়েছে দেশ। অন্তত আগামী দু-এক বছরের মধ্যে ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়েই দেশের অর্থনীতি ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে পড়েছে। এমন অবস্থায় দরকার আর্থিক খাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেয়া এবং সে অনুযায়ী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা। সরকারকে গার্মেন্টসহ শিল্প-কারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। আর্থিক খাতে দুর্নীতিও কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য দরকার সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জোর উদ্যোগ নেয়া। না হলে সংকটই শুধু আরও মারাত্মক হবে না, দেশের অর্থনীতিও বিপর্যযের মুথে পড়বে। তখন আর লক্ষ হাজার কোটি টাকার বাজেটেও কোনো কাজ হবে না, জনগণ বরং সরকারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে- যা ক্ষমতাসীনদের জন্য মোটেও শুভ হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads