শুক্রবার, ২১ জুন, ২০১৩

বিদায়কালেও দুদককে ‘নখ ও দন্তহীন বাঘ’ই বলে গেলেন গোলাম রহমান


শেষবারের মতো কি না সেটা একটি প্রশ্ন বটে তবে আবারও সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যান জনাব গোলাম রহমান। গত ১৯ জুন সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাতের সময় দুদককে একটি ‘নখ ও দন্তহীন বাঘ’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এ জন্যই দুর্নীতি দমনে তেমন অগ্রগতি নেই। গুরুগম্ভীর অভিমতও ব্যক্ত করেছেন তিনি। বলেছেন, দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হলে দুদক আইনের সংস্কার এবং দুদককে শক্তিশালী করতে হবে। মানতেই হবে, ‘এক কথার মানুষ’ এই গোলাম রহমান। কারণ, ২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার পরও এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, দুদক এখন একটি ‘দন্তহীন বাঘ’। নখগুলোকেও কেটে ফেলার মাধ্যমে দুদককে ক্ষমতাহীন করার প্রক্রিয়া চলছে। এসব কথার জন্যই গোলাম রহমানকে ‘এক কথার মানুষ’ বলা হচ্ছে। কারণ, সেবার তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার পর কথাটা বলেছিলেন, আর এবার বলেছেন চেয়ারম্যান পদ থেকে বিদায় নেয়ার সময়। মাঝখানে পার হয়ে গেছে প্রায় বছর চারেকের দীর্ঘ সময়। উল্লেখ্য, আইনত মেয়াদ শেষ  হয়ে যাওয়ার পরও বহাল তবিয়তেই পদটিতে আসীন ছিলেন গোলাম রহমান। হয়তো আরো কিছুদিন থাকতেনও। কিন্তু এরই মধ্যে হাইকোর্টে তার চেয়ারম্যান পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছিলেন একজন। হাইকোর্টও রুল জারি করে জানতে চেয়েছিল, মেয়াদ শেষ হলেও আইনের কোন ধারার বলে গোলাম রহমান দুদকের চেয়ারম্যান পদে বহাল রয়েছেন? এটাও যে দুর্নীতির পর্যায়েই পড়ে সে কথাটাও প্রচ্ছন্নভাবে বলা হয়েছিল রুলের আড়ালে। মূলত সে কারণেই সাততাড়াতাড়ি সরে পড়েছেন গোলাম রহমান। কিন্তু যেহেতু টিভি ক্যামেরার সামনে আসাটা এক বিলাসিতাপূর্ণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল সেহেতু যাওয়ার আগেও একবার সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘সৌজন্য সাক্ষাতে’ মিলিত হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেননি তিনি। এ সময়ই গভীর আক্ষেপের সঙ্গে প্রায় চার বছর আগে নিজের উচ্চারিত মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, দুদক এখনো ‘নখ ও দন্তহীন বাঘ’ই রয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে তারই কথার পরিপ্রেক্ষিতে। বলা হচ্ছে, তিনি তো জেনে-বুঝেই ‘নখ ও দন্তহীন বাঘ’-এর ঘাড়ে চেপে বসেছিলেন। তখন শুনে মনে হয়েছিল, তার উদ্যোগে ও কার্যক্রমে দুদক নামের বাঘের মুখে নিশ্চয়ই ‘দন্ত’ গজাবে, বাঘের নখগুলোও ধারালো হয়ে উঠবে। অর্থাৎ দুর্নীতি প্রতিহত ও নির্মূল করার ব্যাপারে দুদক জোর তৎপরতা চালাবে। অন্যদিকে গোলাম রহমানও কিন্তু যথারীতি নিরাশই করেছেন। কারণ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতি দমন কমিশনÑ দুদকের ‘স্বাধীনতা’ কমতে কমতে এমনিতেই শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছিল চেয়ারম্যান গোলাম রহমানসহ দুদক কর্তাদের নীতি ও ‘সদিচ্ছা’। তারা সব সময় সরকারকে তোষণ করতেই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। নিজের শেষ দিনগুলোতেও গোলাম রহমান যে সামান্য এদিক-সেদিক করার ধারেকাছে যাননি তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করানোর এবং এ ব্যাপারে ইন্টারপোলকে পর্যন্ত টেনে আনার কর্মকা-ে। ক্ষমতাসীনরা নাটাইয়ে টান দেয়া মাত্র নৃত্যই করে শুধু ওঠেননি, রীতিমতো ঝাঁপিয়েও পড়েছিলেন গোলাম রহমানরা। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, বিদায়কালে বাগাড়ম্বর করলেও এই সেদিন পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার পুতুল ও হুকুমের দাসই ছিলেন তিনি।
এ ধরনের কর্মকা-ে গোলাম রহমানকে অবশ্য প্রথম থেকেই ভীষণ তৎপর দেখা গেছে। পূর্বসূরি জেনারেল (অব.) হাসান মাশহুদ চৌধুরীকে সর্বান্তকরণে অনুসরণ করেছেন তিনি। তার ‘যোগ্য’ নেতৃত্বের বদৌলতে দুদক ‘নির্বাচিত’ গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও সব কাজ করেছে সরকারের ইশারায়। সহজ কথায় ‘তল্পিবাহক’-এর ভূমিকা পালন করেছে। যেমন বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য ও অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং এমপিসহ ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধেই দুদক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এখনো নিচ্ছে না। এ ধরনের কারো কারো বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলেও তাকে আমলে পর্যন্ত নেয়নি দুদক। সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম রহমান বরং বিভিন্ন উপলক্ষে বলেছেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের বিরুদ্ধে তার কাছে নাকি কোনো অভিযোগই আসেনি! যুক্তিও তিনি দারুণই দেখিয়েছেন। বলেছেন, সরকারের কারো বিরুদ্ধে ‘হুট করে’ কিছু করা ‘ঠিক’ হবে না! কাউকে তিনি নাকি ‘জোর করে’ কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান না! পাঠকদেরও মনে পড়তে পারে, ২০১১ সালের এপ্রিলে শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও তদন্ত হওয়া সংক্রান্ত অভিযোগের জবাবে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, দুদকে জমা হওয়া অভিযোগগুলোই তদন্ত করে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত হয়। এখানে সরকারি বা বিরোধী দল দেখা হয় না। অথচ গত প্রায় চার বছরে অনেক মন্ত্রী ও এমপিসহ ক্ষমতাসীনদের এবং তাদের কারো কারো নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ তথ্য-প্রমাণসহ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। দু’লাখ টাকার স্থলে আট কোটি টাকা পর্যন্ত বিনা টেন্ডারে কাজ বাগিয়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্য¬ান্টের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ সরকারের পছন্দের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান চুক্তি অনুযায়ী যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করেনি যার ফলে বিদ্যুৎ সংকটেরও সমাধান হয়নি। কিন্তু দুদক একেবারে ঠোঁটে আঙুল লাগিয়ে বসে থেকেছে।
শেয়ার কেলেঙ্কারির ব্যাপারেও দুদক চুপটিই মেরে থেকেছে। যেন ৩৩ লাখ ক্ষুদে বিনিয়োগকারীসহ সাধারণ মানুষের প্রায় এক লাখ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করার অপরাধও কোনো দুর্নীতি নয়! এ ধরনের কোনো বিষয়েই দুদক ব্যবস্থা নেয়নি। কোনো বিষয়ে তদন্ত পর্যন্ত করেনি। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং এমপিসহ ক্ষমতাসীন দলের লোকজন সম্পদের নানা আকারের পাহাড় তৈরি করেছেন। কিন্তু দুদকের মুখে রা’টি পর্যন্ত শোনা যায়নি। ভাবখানা এমন যেন এগুলো আদৌ দুর্নীতি নয়! শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাকুক, কোনো বিষয়ে তদন্ত পর্যন্ত করেনি দুদক। স্বয়ং চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছেন, এসব বিষয়ে তাদের নাকি আপাতত কিছু করণীয় নেই! মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের বিরুদ্ধে তার কাছে নাকি কোনো অভিযোগই আসেনি! তাছাড়া সরকারের কারো বিরুদ্ধে ‘হুট করে’ কিছু করাও নাকি ‘ঠিক’ হবে না! শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ আর কত ‘সুনির্দিষ্ট’ করতে হবে তারও ব্যাখ্যা দেননি গোলাম রহমান। তিনি অবশ্য একবার আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, কোনো অভিযোগ এলে ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ করে দেখা হবে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি শুনিয়েছিলেনও জবরই। সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, আইনে আমাদের যতটুকু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ততটুকু প্রয়োগ করেই আমরা ‘সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে’ কাজ করার চেষ্টা করছি। সরকারের কোনো ধরনের বিধিনিষেধ তারা নাকি কখনো ‘আমলে’ নেননি! তারা আশাও করেছিলেন, সরকার এমন কিছু করবে না যাতে এ প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনতা খর্ব হয়। কারণ, এটা হলে দেশে-বিদেশে সরকারেরই ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হবে।
প্রশ্ন উঠেছিল, যেখানে ‘যতটুকু’ আর ‘ততটুকু’র ব্যাপার থাকে সেখানে আবার ‘সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে’ কাজ করতে পারার সুযোগ কোথায়? তাছাড়া অভিযোগের এই ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ কিন্তু বিরোধী দলের কারো ক্ষেত্রে করা হয়নি, এখনো হচ্ছে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীসহ সরকারবিরোধীদের ব্যাপারে দৌড়-ঝাঁপেরও কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না দুদকের। এখনো নেই। এমনকি তিন-তিনবার যিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং বিরোধী দলের নেতা হিসেবে এখনও যিনি জাতির স্বার্থে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে চলেছেন, সেই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও তাড়া করে বেড়াচ্ছে দুদক। ভৈরব সেতু নির্মাণে কথিত অনিয়মের অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য খালেদা জিয়াকে বহুবার চিঠি হাঁকিয়েছে দুদক। বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যেসব মামলা স্থগিত হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারেও ঘুম নেই দুদকের চোখে! অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খালেদা জিয়াসহ বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে এমন অনেক অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে দুদকের কর্তারা ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছেন, যেসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। দুদক এসব করেছেও আবার বেনামী চিঠির ভিত্তিতে। সরকারবিরোধী কারো সম্পর্কে বেনামী কোনো চিঠি পেলেও তাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি হাঁকিয়েছেন তারা। কারো কারো বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করেছেন। অত্যধিক গুরুত্বের সঙ্গে সে সব খবর রটিয়ে দেয়া হয়েছে। হয়রানির পাশাপাশি চলেছে অসম্মানিত করার কর্মকা-। রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার ব্যাপারেও দুদকের কর্তাব্যক্তিরা গায়ের ঘাম ঝরিয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় অরাজনৈতিক অনেক ব্যক্তিকেও দুদকের পাল্লায় পড়তে হয়েছে। তদন্তের নামে রীতিমতো হয়রানি ও অসম্মানিত করা হয়েছে তাদের। দুদক এমনকি নেতা-নেত্রীদের সম্পদের হিসাব চাওয়ার ক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্ব করেছে। বিরোধী দলের ব্যাপারে যথেষ্ট ‘উদার’ দুদককেই আবার ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে দারুণ ‘সংযমী’ দেখা গেছে। সরকারের গঠিত রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার কমিটির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রতিটি মামলাই বাতিল করেছে দুদক। রেহাই পেয়েছেন আওয়ামী লীগের অন্য সকলেও। একই দুদকের আবার ঘুম হারাম হয়ে গেছে বিরোধী দলের ব্যাপারে!
এভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে গোলাম রহমানের নেতৃত্বাধীন দুদক। এমন কিছুই যে ঘটবে এবং দুদক যে তার সংবিধান নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে না সে বিষয়ে অবশ্য আগেই ধারণা করা হয়েছিল। এর কারণ, দুদকের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের বদৌলতে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্তি পেয়েছিলেন গোলাম রহমান। তারও আগে আওয়ামী লীগের পূর্ববর্তী আমলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে সচিবের দয়িত্বও পালন করেছেন তিনি। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের ‘খাস লোক’ হিসেবে তার অনস্বীকার্য পরিচিতি রয়েছে। দুদকের অন্য দুই কর্তাও আওয়ামী লীগের খেদমত করার জন্য ‘সুখ্যাতি’ অর্জন করেছেন বলে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। দেশে যেহেতু যোগ্য লোকের ‘আকাল’ পড়েছিল সেহেতু এ ধরনের নিযুক্তি তারা পেতেই পারেন। কিন্তু আপত্তির কারণ হলো, দুদকের মতো একটি নিরপেক্ষ হিসেবে পরিকল্পিত ‘স্বাধীন’ সংস্থাকেও চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ও তার দুই সহযোগী সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ফেলেছেন। অথচ সরকারের ‘মনোনীত’ হলেও তাদের উচিত ছিল দুদককে সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে তারা যেমন ‘হুট’ করে কিছু করতে চাননিÑ আসলে করেনও-নি, বিরোধী দলের কারো বিরুদ্ধেও তেমনি ‘হুট’ করে কিছু না করলেই নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না। তেমনভাবে তৎপরতা চালানো দুদক কর্তাদের দায়িত্বও ছিল।
কিন্তু সে দায়িত্ব পালনের ধারে-কাছেও যাননি বলেই আওয়ামী লীগ সরকার দুদকের নখ কেটে ফেলার এবং হাতে-পায়ে বেড়ি পরানোর সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। কথাটা আমাদের নয়, আগেও বলেছি, দুদকের কীর্তিমান বিদায়ী চেয়ারম্যান গোলাম রহমানই অত্যন্ত নাটকীয় ভাষায় দুদককে ‘দন্তহীন বাঘ’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। সেবার তিনি আরো বলেছিলেন, এখন ‘দন্তহীন বাঘ’-এর নখ এবং হাত ও পাও কেটে ফেলার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি ও মনোভাবের আলোকে এমনটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, দলটির নির্বাচনী ইশতেহারে দুদককে শক্তিশালী ও বিকশিত করার প্রশ্নে স্পষ্ট কোনো অঙ্গীকার ছিল না। একটি অনুচ্ছেদে শুধু বলা হয়েছিল, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে।’ এ ছিল নামকা ওয়াস্তে অঙ্গীকার মাত্রÑ কিছু একটা বলতে হবে বলেই দায়সারাভাবে কথাগুলো বলেছিল আওয়ামী লীগ। দলটি অবশ্য নির্বাচনী ইশতেহারের মূলকথা থেকে সরে যায়নি। সত্যিই দুদকের ‘স্বাধীনতা নিশ্চিত’ করার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারÑ তবে নিয়েছে আওয়ামী স্টাইলে! এ জন্যই সংস্থাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। দুদক যে আর স্বাধীন থাকতে এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ অভিযান চালাতে পারবে নাÑ সেকথা এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। একথা বলাও আমরা দায়িত্ব মনে করি যে, সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি ‘স্বাধীন’ অবস্থান ও মর্যাদা হারালে এবং ব্যর্থ হলে দায়ী থাকবেন গোলাম রহমানের মতো কর্তা ব্যক্তিরাÑ যারা তল্পিবাহকের ভূমিকা পালন করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের ‘অবদান’ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ, এমনিতেই ‘নাচুনে বুড়ি’ দুদককে সরকার ‘ঢোলের বাড়ি’ তো শুনিয়েছেই, নাচিয়েও ছেড়েছে। নাচাচ্ছে এখনও। শুধু তা-ই নয়, আইন সংশোধন করার মাধ্যমে পুরো দুদককেই সরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকিয়ে ফেলারও আয়োজন করেছে। পদক্ষেপগুলো নিন্দনীয় হলেও এসবের চাইতে বেশি সত্য হলো, গোলাম রহমানের মতো কর্তাব্যক্তিরা এমন ন্যক্কারজনকভাবেই চামচামোর কাজ-কারবার চালিয়েছেন এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন, যার সুযোগ নিয়ে সরকার দুদকের হাত-পা এবং নখও কেটে ফেলতে পেরেছে। সব মিলিয়ে দুদক এখন ‘মিউ মিউ করা বেড়ালে’ পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। দুর্নীতি দমনের প্রধান যে উদ্দেশ্য নিয়ে দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সে উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো রকম গাফিলতি, স্বজনপ্রীতি ও তোষণনীতি চলতে দেয়া যায় না। এর ফলে কমার পরিবর্তে দুর্নীতি বরং বাড়তে থাকবে। কারণ, প্রমাণিত সত্য হলো, দুর্নীতি সব সময় ক্ষমতাসীনরাই বেশি করেন, এখনও তারাই করছেন। এভাবে চলতে থাকলে ব্যর্থ হয়ে যাবে দুদক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। এ জন্যই দুদক কর্তাদের উচিত কেবলই বিরোধী দলের পেছনে দৌড়ে ঘাম ঝরানোর পরিবর্তে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগের তদন্ত করা। দোষী সাব্যস্ত হলে সংশ্লিষ্টজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। ‘সদিচ্ছা’ সবার বেলাতেই সমানভাবে দেখানো দরকার। তা না করে কেবলই সরকারকে খুশি করার মাধ্যমে চাকরি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলে কর্তাব্যক্তিদের পরিণতি এক সময় হাস্যকর হয়ে উঠবে। যেমনটি হয়েছে ‘বেচারা’ গোলাম রহমানের।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads