সোমবার, ১০ জুন, ২০১৩

হেফাজতের অবরোধ : গভীর রাতের নির্মমতা


কী লিখবো? বলার ও লিখার যেন ভাষা নেই! খবর পাচ্ছি, শাপলা চত্বর ও এর আশপাশের এলাকায় হত্যা ও গুম হয়েছে ২৫০০ রাসূলপ্রেমিক তৌহিদী জনতা। কেউ বলছেন, ১০০০, কেউ বলছেন ২০০০; আবার কেউ বলছেন, ৩০০০! খুব সকালে এক বড় ভাই মোবাইলে জানালেন, লাশের সংখ্যা ৪৩১ ঢাকায় চাকরি করেন আমার এক মামা। তিনি জানালেন, মতিঝিল ও পল্টন এলাকায় তার অনেকের সাথে কথাবার্তা হয়েছে। তার মতে, ২০০০-এর বেশি লোক গত রাতে হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে, স্বার্থান্বেষী মিডিয়াগুলো প্রচার করছে যে সংখ্যা; তা উল্লেখ করতে বিবেক সায় দিচ্ছে না!
সত্য সংবাদ প্রচার হতে পারে, সেই সন্দেহে ভোর রাত ৪টার সময় দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দিল সরকার! ইসলামিক টিভিও বন্ধ। ইন্টারনেট সূত্রে তথা ফেইসবুক, টুইটারে অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় একাধিক ফেইসবুক পেইজের সূত্রে নানা তথ্য জানা যায়। ইটিভি’র এক ক্যামেরাম্যানের বরাত দিয়ে লিখা হয়েছে, মৃতের সংখ্যা ২৫০০-এর কম হবে না। তথ্য পাওয়া যায়, ট্রাক বোঝাই করে ঐ লাশ ফেলা হয়েছে! সময় টেলিভিশনের ক্যামেরায় কিছু চিত্র ধারণ করা হয়েছে বলেও জানা যায়।
জানি না সত্য তথ্য কোনটি? বিবেকের আর্তনাদ আর মর্মবেদনা বুকে ধারণ করেই কলম ধরলাম। ৬ মে, বিকেল বেলা যখন লিখছি জানি না এর পর কি হবে?
সম্প্রতি ১৩ দফা দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গত ৬ এপ্রিল রাজধানীর শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় ও শক্তি প্রদর্শন করেন তারা। ঐ সমাবেশ থেকেই সরকারকে দাবি বাস্তবায়নের আল্টিমেটাম দেয়া হয়। ৫ মে ঢাকা অবরোধের ঘোষণা আসে ঐ সমাবেশ থেকেই। ৬ই এপ্রিল থেকে ৫ মে’র মাঝখানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় একই দাবিতে সক্রিয় ছিল তারা।
৫ মে। হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি। ৬০ লাখ লোকের সমাগমের ঘোষণা দেয়া হয়। সে জন্য রাজধানীর ৯টি স্পট নির্ধারণ করা হয়। প্রধান স্পট ছিল মতিঝিলের শাপলা চত্বর। ঘোষণার আলোকে কয়েকদিন আগে থেকেই লোক সমাগম চোখে পড়ে।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী’র আহ্বানে সাড়া দেয় লাখো লাখো ইসলামপ্রিয় মানুষ। হেফাজত আমীরের ডাকে ১৩ দফা রক্ষার অঙ্গীকার করে ধর্মপ্রাণ জনতা। দেশের প্রায় সকল অঞ্চল থেকে রাজধানীতে আসেন তৌহিদী জনতা। এ যেন এক মহাজাগরণ! দেশ-বিদেশের মানুষ দেখেছে সেই মহাজাগরণ। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়েছে রাজধানী। উত্থিত হয়েছে নাস্তিক মুরতাদদের ফাঁসির স্লোগান।
হেফাজত শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছিল। তারা সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছিল। সরকার সহযোগিতা করেনি। বরং শুরু থেকেই বাধার সৃষ্টি করে। সরকারের কড়া নির্দেশে সক্রিয় ছিল প্রশাসন। মুহুর্মুহু গুলী, টিয়ারসেল ও ব্যাপক লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। তাদের সাথে আগ্নেয়াস্ত্রসহ অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যোগ দেয় ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অন্যান্য সংগঠনের হাজারো ক্যাডার বাহিনী। দিনভর হামলায় প্রাণ হারায় ১৬ জন ইসলামপ্রিয় তৌহিদী জনতা।
হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী সমাবেশে আসতে পারেননি। প্রশাসনের বাধার কারণে তিনি আসতে পারেননি। সমাবেশ থেকে ঘোষণা আসে তাদের আমীর উপস্থিত হয়ে পরবর্তী ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত তারা রাজপথে অবস্থান করে যাবেন। হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব তার বক্তৃতায় বলেন, ‘আমাদের ১৩ দফা দাবি ঈমানী দাবি। আমাদের আন্দোলন ঈমানী আন্দোলন। আমাদের ভাইদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। তারা শহীদ হচ্ছেন’। তিনি বলেন, ‘আমরা কোন দলের বিরুদ্ধে নয়, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। আমরা শহীদ হতে প্রস্তুত আছি। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না’। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আমাদের ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের পূর্ব পর্যন্ত এখানে অবস্থান করব। প্রয়োজনে এক মাস অবস্থান করে দাবি আদায় করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’।
রোববার বিকেলে দলীয় সভানেত্রীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হেফাজতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘সমাবেশ শেষ করে সন্ধ্যার মধ্যে ঘরে ফিরে যান। অন্যথায় সরকার তা বরদাশত করবে না’। তিনি বলেন, ‘আজ ঢাকায় আসতে পেরেছেন, আগামীতে আর পারবেন না। আগামীতে ঘর থেকে বের হতে দেয়া হবে না’।
সন্ধ্যার পর মতিঝিল ও আশপাশের এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। ঐ সময় শাপলা চত্বরে শান্তিপূর্ণ অবস্থান থাকলেও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। হেফাজত কর্মীদের উপর অতর্কিত গুলী চালায় পুলিশ। পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা বলেন, ‘সরকার হেফাজতকে স্তব্ধ করতে কূটকৌশল নিচ্ছে’।
রাত ১২টা থেকে শুনা যাচ্ছিল, শাপলা চত্বরের চারপাশে প্রশাসন সক্রিয় হচ্ছে। রাত ২টার মধ্যে শাপলা চত্বর চতুর্দিক থেকে ঘেরা করে যৌথ বাহিনী বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। রাত আড়াইটা থেকে অভিযান শুরু হয়। ক্লান্ত শ্রান্ত হেফাজত কর্মীদের উপর চড়াও হয় যৌথবাহিনী। হেফাজতের কর্মীরা তখন কেউ জিকির করছিল, কেউবা ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। যৌথবাহিনীর আচমকা হামলায় হতভম্ব হয়ে পড়ে তারা। মুহূর্মুহু গুলী, টিয়ারসেল ও ব্যাপক লাঠিচার্জে স্তম্ভিত হেফাজত কর্মীরা দিগি¦দিক ছুটোছুটি করতে থাকে। শাপলা চত্বর দখলে নেয়া যৌথবাহিনী।
নীরবে কাঁদছে দেশের মানুষ। কাঁদছে তৌহিদী জনতা। সারা দেশ থেকে ছুটে আসা ইসলামপ্রিয় আল্লাহর গোলামরা নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। আত্মীয়-স্বজনরা উদ্বিগ্ন। স্বজনদের ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যাকুলতা কমছে না। সন্তানহারা বাবা-মা’র আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। চলছে পিতাহারা সন্তানদের ক্রন্দন। স্বজনহারাদের গগণবিদারী কান্না যেন থামছেই না! আহতদের আর্তচিৎকারে এক বেদনাময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
হে আল্লাহ! যারা সত্য ও সুন্দরের জন্য জীবন দিলো, তাদেরকে শহীদ হিসেবে কবুল করো। তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দাও। আহতদের সুস্থতা দাও। মজলুমদের সাহায্য করো। জালিমদের হেদায়াত দাও। আমীন॥

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads