বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০১৩

আদর্শ আওয়ামী ধারাপাত এবং ইহুদি-খ্রিষ্টানে তফাত


ছোটবেলায় সুর করে পড়েছি তিন-একে-তিন, তিন-দু-গুণে ছয়। আমাদের বাবারাও একই জিনিস পড়েছেন। তাদের বাবারাও একই। তেমনিভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরও একটি আদর্শ ধারাপাত রয়েছে। এই ধারাপাতটি আবার স্থির নয়, চলমান। কারণ এখানে সব সময় ‘তিন-দু-গুণে ছয়’ হবে তার নিশ্চয়তা নেই। ‘তিন-দু-গুণে’ কত হবে, তা নির্ভর করে আওয়ামী লীগের কখন কত লাগে তার ওপর।
এই ধারাপাতে মতিয়া চৌধুরীর সর্বশেষ ‘নামতা’টি হলোÑ ‘নারী নেতৃত্ব হারাম, তবে পাশে বসলে আরাম।’
‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ এই বিধানটি এখন ঠিকঠাক পালন করছে না বলেই এই নারী নেত্রী জামায়াতের ওপর এমনভাবে চটেছেন।
এই অগ্নিকন্যা সত্তর সালের গোড়ার দিকে অবশ্য অন্য নামতা আওড়াতেন। যার চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানো হালাল বা আরাম মনে করতেন তা এখন উচ্চারণ করা মাকরুহ তো বটেই, কল্পনা করাও হারাম। কাজেই হালাল-হারামের এই আওয়ামী ধারাপাতটি অনেকেরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
যাদেরকে টার্গেট করে এই ছড়াটি লেখা হয়েছে, তারা যে শুধু জাতীয়তাবাদী আরামটিই উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন তা নয়; বর্ণিত আরামের ধর্মনিরপেক্ষ ভার্সনটিও তাদের এই কপালে জুটেছে। সঙ্গত কারণেই শেখ হাসিনা ও সাজেদা চৌধুরীর পাশে মতিউর রহমান নিজামীর সেই বিখ্যাত ছবিটি ছড়াকারের মগজে ঠাঁই পায়নি। অ-জামায়াতি মাওলানাদের সাথে তাদের রাজনৈতিক সখ্য বা পাশে বসার ‘আরাম’টি এখানে উল্লেখ করা বাহুল্য হবে মাত্র।
১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গ বা রাজনীতিকে বিবেচনা করা হয়েছে হালাল অর্থাৎ আরামের রাজনীতি হিসেবে। এখন বিএনপির সাথে জোট করায় তা হারামের রাজনীতি হয়ে পড়েছে। এই আরামের রাজনীতির বদৌলতে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শাসন ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল আওয়ামী লীগ।
শেখ হাসিনা তখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আমি তখন একটি ইরানি জাহাজে কর্মরত। জাহাজের ইরানি ফিটার আমাকে এসে বলে, আগা (মিস্টার)! বলো তো তোমাদের দেশে হয়েছেটা কী? এক মহিলা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেন, সাথে সাথেই অন্য এক মহিলা ক্ষমতায় চড়ে বসলেন! ঠিক করে বলো তো দেখি, তোমাদের দেশে কি আসলেই কোনো পুরুষ মানুষ নেই?
একই সুরে জবাব দিলাম, আগা ফিটার! থাকবে কিভাবে বলো? রাষ্ট্র ও সংসার চালানোর দায়িত্ব মহিলাদের ঘাড়ে অর্পণ করে আমরা সব পুরুষ যে জাহাজে চলে এসেছি। আমরা চালাই জাহাজ আর আমাদের নারীরা চালায় দেশ ও সংসার।
আমার জবাব শুনে হো হো শব্দ করে হেসে উঠল। মনে হলো, আমার এই কথাটি তার পৌরুষের কোনো একটি জায়গাকে হঠাৎ ফুলিয়ে দিয়েছে। খুশির চোটে আমাকে আরো একটি গল্প বা পুরুষালি বুলশিট শোনাল। প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে বিমানবন্দরে নাকি একবার কষে থাপ্পড় মেরেছিলেন আসিফ জারদারি। ‘পুরুষের ব্যাটা এই পুরুষ’ প্রমাণ করেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও এক ধাপ ওপরে হলো মহামান্য স্বামীর পদটি। একই পরিস্থিতির শিকার অন্য এক পুরুষের মতো আকাশের পানে তাকিয়ে অভিযোগ করেননিÑ ‘জীবনটা কেন এমন হলো?’
পজেটিভ বা নেগেটিভ যাই হোক, পুরুষতন্ত্র বা পৌরুষ বলে যে একটা জিনিস আছে তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা জাহাজ চালাই। আমাদের বউয়ের মতোই কেউ একজন দেশ চালায়। এ ধরনের ভাবনা থেকেও পুরুষতন্ত্র বেশখানিকটা সুখ আস্বাদন করতে পারে। এ সুখটি দেয়াতেই এই ইরানি পুরুষ সে দিন আমাকে কড়া লাল টকটকে ইরানি চা খাইয়েছিল।
নারী পাঠকেরা এই অভাগাকে আবার দয়া করে ভুল বুঝবেন না। রোগ নির্ণয় যদি অর্ধেক প্রতিকার হিসেবে গণ্য হয়, তবে আমি এই মহৎ কাজটিই করতে চেয়েছি মাত্র। রানু আপার কথামতো, পুরুষতন্ত্রের একটা জলজ ‘চুদুরবুদুর’ ডাঙ্গায় এনে তুলে ধরেছি কেবল। আমার গত লেখাটি পড়ে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া এবং প্রাক্তন ফেনী নিবাসী, বন্ধু ও তার পতœী সঙ্গত কারণেই ফোন করেছেন। বন্ধুটির কমপ্লেইন, তার অনুমতি ব্যতিরেকে ফেনীর ভাষা নিয়ে কেন এই ‘চুদুরবুদুর’ শুরু করেছি। ভাবীর কথার সারমর্মটি ছিলÑ ‘ভাই, দেশের রাজনীতির অনেক ‘চুদুরবুদুর’ এত সুন্দরভাবে তুলে ধরেন অথচ নিজের বন্ধুর পুরনো ‘চুদুরবুদুর’গুলো একটুও সারাতে পারলেন না! আমার মনে হয়, রানু আপা এ দেশের মেয়েদের হাতে একটা চমৎকার শব্দ তুলে দিয়েছেন। স্বামী ধন কোনো ব্যাপারে একটু টালবাহানা শুরু করলেই এ শব্দটির প্রয়োগ ম্যাজিকের মতো কাজ দিতে পারে।
আওয়ামী ধারাপাতে যে টালবাহানাটি দেখে ওই সংসদ সদস্য শব্দটি প্রয়োগ করেছিলেন, সে ক্ষেত্রে কতটুকু কাজে দিচ্ছে তা এখন দেখার বিষয়। বিএনপিদলীয় অন্য একজন সংসদ সদস্য আরো একটু ঝাল দিতে গিয়ে শালীনতার হলুদ লাইনটি অতিক্রম করে ফেলেছেন। তার পরে আওয়ামী লীগের আরেক নারী সংসদ সদস্য তাদের নিজস্ব ধারাপাত থেকে কিছু বক্তব্য শুরু করলে শালীনতার মেশিনটিই কম্পিউটারের মতো ‘হ্যাং’ হয়ে যায়। বিএনপি সংসদ সদস্যদের দু’টি শব্দ নিয়ে আপত্তি উঠলেও আওয়ামী লীগের পুরো ধারাপাতটি নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কবি হেলাল হাফিজকে উদ্ধৃত করলেও এর দায় বক্তা এড়াতে পারেন না। মাননীয় স্পিকার শব্দটি সংসদ কার্যক্রম থেকে উঠিয়ে নিলেও আমাদের সুশীল সাহিত্য থেকে এই শব্দগুলোকে উঠিয়ে নেয়া হবে কি? সংসদে যা হারাম, তা সুশীল সাহিত্যের আসরে হালাল হয় কিভাবে? একই সমাজে, একই সময়ে শ্লীলতা-অশ্লীলতা, হালাল-হারামের নির্দেশক স্ট্যান্ডার্ডগুলো এভাবে বদলে যেতে পারে না। এটাও আওয়ামী ধারাপাতের মতো মনে হচ্ছে। সংসদে এ কবিতাটি আবৃত্তির আগে সুশীল সাহিত্যের পাতায় অবস্থান করছিল। তখন কেন এটাকে অশ্লীল, অপাঠ্য ও অশ্রাব্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি, তাও মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
গালিগালাজ অনেক সময় বক্তার জন্য টনিকের কাজ করে। তবে এসব উচ্চারণ ভদ্র সমাজে গ্রহণযোগ্য বা শোভন হয় না। বিকল্প ও ভদ্র ভাষায় মনের ক্ষোভ ও যাতনাগুলো তুলে ধরাই অধিকতর কাম্য। বিএনপির বর্তমান নারী সংসদ সদস্যরা এই নিদান বা আকালের সময় অনেক ভালো কাজ করছেন; কিন্তু এ ধরনের অসতর্ক শব্দ প্রয়োগ তাদের সেই ভালো কাজগুলোকে নষ্ট করে দিতে পারে। যেমন, কারো কারো মতে ‘চুদুরবুদুর’ শব্দটি জাস্ট নাকের ডগা দিয়ে গেছে। এর থেকে এক স্টেপ পরেই হলুদ এলাকা শুরু হয়ে গেছে। জানি এখন চরম কঠিন সময়। তার পরও রাগে, ক্ষোভে, হতাশায় এই বোধটি যেন তারা হারিয়ে না ফেলেন। গালি কিংবা কারো বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ছাড়াও অনেক শক্ত কথা বলা সম্ভব।
এই ভূখণ্ডের অন্যতম মহান এক নেতার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে কিছু আজেবাজে কথা এ দেশের ইথারে ছড়ানো ছিল; কিন্তু কোনো সুস্থ, ভদ্র মানুষ সেটিকে গ্রহণ করেনি। পরীক্ষার আগে এক ছাত্র মুখস্থ করে গেছে ‘এ জার্নি বাই বোট’ রচনাটি; কিন্তু প্রশ্নপত্রে দেখে ‘এ জার্নি বাই বাস’ এসেছে। নিজের মুখস্থ করা রচনায় ‘বোট’ শব্দটির জায়গায় ‘বাস’ বসিয়ে দেয় চিকন বুদ্ধির ওই ছাত্রটি। অপু উকিল হুবহু একই কাজ করেছেন। মূল গল্পটির শেখ মুজিবের জায়গায় খালেদা জিয়ার নামটি বসিয়ে দিয়েছেন। গল্পের মূল থিমটি ঠিক রেখে পাত্রপাত্রীর নামগুলো এ দিক-সে দিক করা হয়েছে। বর্তমান মার্কেট চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে হিন্দু মায়ের সাথে একজন ইহুদি বাবার চরিত্রও যোগ করা হয়েছে। নকল গল্পটি টেনে এনে মূল গল্পটি যা এত দিন আমাদের ইথারের নষ্ট অংশে লুক্কায়িত ছিল, তাকে আরো ব্যাপক প্রচারের সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছেন ‘চিকন বুদ্ধির’ এই ‘উকিল’ সাহেবা। তা ছাড়া নিজে হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়েও অপু উকিল হিন্দু ধর্মটিকে এত খারাপ ভাবলেন কেন? অস্ট্রেলিয়া থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক কলামিস্ট এ প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়েছেন। চলনে-বলনে শতভাগ সেকুলার শফিক রেহমানের অনুভবেও এরা ঠিকই ধরা পড়েছেন। তিনি লিখেছেনÑ ‘এরা মুসলিম নয়, এরা হিন্দু নয়Ñ এরা আওয়ামী লীগ।’
রচনাটি পড়া শুরু করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এটা কোনো আচমকা উচ্চারণ ছিল না। কবি হেলাল হাফিজের কবিতার মতো ভালো কথার মাঝে হঠাৎ অসভ্য, অভব্য একটি শব্দ এসে পড়েনি। মাননীয় ডেপুটি স্পিকার বাধাহীনভাবে গল্পটি বলতে দিয়েছেন। গল্পটি বলার সময় পুরো আওয়ামী হাউজ তাকে উৎসাহ দিয়েছে। এই অপু উকিল মূল অনুপ্রেরণাটি কার কাছ থেকে পেয়েছেন তা ধরতে জনগণকে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। দুই দিন পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার চিরাচরিত স্টাইলের মাধ্যমে একই ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন। সংসদের ভেতরে অপু উকিল যখন বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে এই খিস্তি-খেউর করেছেন, তখন সংসদের বাইরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই কায়দায় চড়াও হয়েছেন। তবে কিছুটা স্বস্তির কথা হলো, এত কিছুর পরও বেগম খালেদা জিয়া তার স্বভাবসুলভ সংযম ধরে রেখেছেন। সিঙ্গাপুর থেকেই নিজদলীয় সংসদ সদস্যদের সংযত হয়ে কথা বলার জন্য কড়া নির্দেশ পাঠিয়েছেন। একই ধরনের প্রতিশোধস্পৃহা ও ‘শিনাজুরির’ মাত্রা প্রতিপক্ষের অর্ধেক বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে থাকলেও এ দেশটিতে কোনো ভদ্র মানুষ বাস করতে পারতেন না।
বিরোধীদলীয় নেত্রীর দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নিয়েও তিনি অশ্লীল খোঁটা মারেন। বয়স হলে অনেক মেয়েই বিভিন্ন কারণে রাতের প্রথম প্রহরে ঘুমাতে পারেন না। অনেকের ‘বডি-ককটি’ এ সময় কিছুটা এলোমেলো হয়ে পড়ে। দিনের বেলায় যাদের রেগুলার কাজ থাকে না, তারা সারা রাত লেখাপড়া বা এ ধরনের কাজ সেরে একবারে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যান। কাজেই প্রধানমন্ত্রীকে কেউ বুঝিয়ে তার মুখটি বন্ধ করতে পারলে এতে তার নিজের এবং বৃহত্তর নারীসমাজের যারপরনাই উপকার হতো। এক মাঢ়িতে ব্যথা হলে যারা দুই পাটির সাকুল্য দাঁত তুলে ফেলতে চান, এ ধরনের নির্দল-কানা বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এই সমাজে নেহাত কম নয়।
শেখ হাসিনা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেন, নামাজ পড়েন, কুরআন তিলাওয়াত করেন। এই প্রতিযোগিতায় বেগম খালেদা জিয়া অনেক আগেই তাকে ওয়াকওভার দিয়ে দিয়েছেন। কাজেই বরাবরের মতো গুড গার্ল হলেন শেখ হাসিনা। ব্যাড গার্ল হলেন বেগম খালেদা জিয়া। বেশি মাত্রায় ধর্মকর্ম করে যতটুকু সওয়াব অর্জন করেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একবার গিবত করলেই কিন্তু তার দশ গুণ পাপ কামাই হয়ে যাবে। এর প্রভাব শুধু পরকালেই নয়, ইহকালের রাজনীতিতেও পড়বে।
ব্াস্তবতা হল্াে এত ধর্মকর্ম করার পরও তিনি নাস্তিকদের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রতিপক্ষ অনেক কম ধর্মকর্ম করেও আস্তিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এতে তার মনে কষ্ট। জনগণ কেন এমনটা ভাবে, তার উত্তর তাকেই খুঁজে বের করতে হবে।
যারা মাটি কাটার শ্রমিক বা কামলাদের সরদার বা সরদার তারা নিজেরা হাত দিয়ে মাটি কাটেন না। মাটির দাগ তাদের কাপড়ে বা শরীরে লাগে না। নিজে মাটি কাটার কাজ না করলেও সেই কাজের ভাগ তারা পান, মাটি কাটার দায়ও তাদের কাঁধে পড়ে। কাজেই নিজে নাস্তিক না হলেও কেন ওদের সাথে সম্পৃক্ত বলে পরিচিতি জুটিয়ে ফেলেছেন, তা বুঝলে নিজের এবং আশপাশের অনেকের ইহকাল ও পরকাল দুই কালেরই মঙ্গল হতো।
পৃথিবীর কোথাও একজন ধর্মযাজক খুন হলে সেই ধর্মের সব অনুসারী সোচ্চার হয়ে ওঠেন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও তাতে নৈতিক সমর্থন বা সহানুভূতি জানান। সিএনএন, আলজাজিরা এবং অন্যান্য বৈদেশিক সূত্রের বরাত থেকে প্রাপ্ত খবর, শাপলা চত্বরে কমপক্ষে দুই থেকে তিন শ’ আলেমকে হত্যা করা হয়েছে। প্রত্যুষে শয্যাত্যাগকারিণী, নামাজি, কুরআন তিলাওয়াতকারিণী এখনো তা নিয়ে একবারও দুঃখ প্রকাশ করেননি; বরং কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো তার নির্মম বচনগুলো একের পর এক বর্ষণ করে চলেছেন। সে দিন শাপলা চত্বরে নাকি কোনো গুলিই ছোড়া হয়নি। হেফাজতের কর্মীরা লাল রঙ মেখে শুয়েছিল। পুলিশ দেখে দৌড়ে পালায়। এই হলো তাঁর ভাষ্য।
দেশে নিত্যদিন অনেক মানুষ খুন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সাধারণত এদের দেখতে যান না। এমনকি, সময়ের সবচেয়ে আলোচিত খুনের শিকার, সাগর-রুনির বাসায়ও যাননি; কিন্তু ব্লগার রাজীবের বাসায় যেতে একটুও বিলম্ব করেননি। আরো অবাক ব্যাপার, এই রাজীবকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ভালোভাবে খোঁজখবর না নিয়েই শুভেচ্ছা পাঠিয়ে দিয়েছেন শাহবাগ চত্বরে। দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর ফজরের নামাজ কিংবা কুরআন তিলাওয়াতের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেয় না; বরং বাস্তব কাজগুলো দেখেই তারা সে পর্যায়ের কারো ব্যাপারে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসটি উঠিয়ে বলেছিলেন, এই টার্মে অর্ধেক কাজ সম্পন্ন করেছেন। সামনের টার্মে ক্ষমতায় আসতে পারলে বাকি কাজটুকু সারবেন। আওয়ামী ধারাপাতটির ওই লাইনগুলোর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আরেকবার ক্ষমতায় এলে মসজিদের মাইক থেকে না জানি কী বের হয়। এ কথাটি স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য অনেকেই তার ওপর নাখোশ হয়েছেন; কিন্তু সার্বিক আলামত এর চেয়ে ভালো দেখা যাচ্ছে কি?
প্রধানমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন, নিজের ছেলের বউ ইহুদি নয়, খ্রিষ্টান। ইহুদি বিয়ে করেছেন ড. কামাল হোসেনের মেয়ে। ড. কামালের পারিবারিক এ ইতিহাসটি অনেকেই জানতেন না। প্রধানমন্ত্রীর বদৌলতে তা সবার জানা হয়ে গেছে।
‘ইহুদি-খ্রিষ্টান’ শব্দযুগলটিকে আমাদের দেশে অনেকটা একই দৃষ্টিতে দেখা হয়। এ দু’টি শব্দের মধ্যে কোনো ফারাক করা হয় না। আর ‘আহলে কিতাব’ বলতে যাদেরকে বোঝানো হয়েছে, সেখানে ইহুদিরা এখনো আগের অবস্থানেই রয়েছেন। বরং ত্রিত্ববাদী খ্রিষ্টানেরা ধর্মীয় বিশ্বাসে একত্ববাদী ধর্ম থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছেন। ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাস ইস্যু নিয়ে ইহুদিদের সাথে মুসলমানদের রাজনৈতিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমান ছেলেদের জন্য আহলে কিতাব মেয়েদেরকে বিয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে এই সম্ভাবনাকে সামনে টেনে যে, বাবার দিক দিয়েই পরবর্তী বংশধারা প্রবাহিত হবে; কিন্তু যুগ উল্টে যাওয়ায় প্রবাহটিও উল্টে গেছে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ছেলে-মেয়ে যা-ই হোক রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অধিকতর শক্তিশালী কালচারটি দুর্বল কালচারটিকে গিলে ফেলে। এই বিবেচনায় ধর্মতাত্ত্বিকেরা মিশ্র বিয়ের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন। এখন কেউ যদি ধর্মের নির্দেশ মানতে চায়, তাকে পুরো আইডিয়াটাই গ্রহণ করতে হবে। মানতে না চাইলে সেখানেও অবকাশ রয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমস্যা এখানেই। গাছের আগাটিও খেতে চায়; আবার গোড়াটিও ছাড়তে চায় না। বিয়ের আগে জায়েজ-নাজায়েজের অঙ্ক কষে প্রেম শুরু করেনি। এখন রাজনীতির কারণে এটাকে জায়েজ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ কাজটি করেন সর্বদা ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক নফসের তাগিদে। আর তার ব্যাখ্যাটি করেন যে দিকে সুবিধা হয় সে দিকে টেনে। এটিই আওয়ামী ধারাপাত। তাদের সব কাজের মধ্যেই এর একটা মিল খুঁজে পাবেন।
বিশ্বের প্রতিটি সমাজ বা গোষ্ঠী এক ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। অগ্নি উপাসকরা নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও তাদের গোষ্ঠী বা ধর্মের বাইরে বিয়ে অনুমোদন করে না। এমনকি আধুনিক সভ্য সমাজও এই ভাবনার বাইরে যেতে পারেনি। ডায়ানা এবং মিসরের দোদির প্রেম নিয়ে ব্রিটিশ জাতি ও রাজপরিবারের সবচেয়ে বড় আশঙ্কাটি ছিল যে, ভবিষ্যৎ সম্রাটের হাফ ব্রাদার কিংবা সিস্টার মুসলমান হয়ে পড়তে পারে। যদিও সবাই জানত, দোদি কোন লেভেলের মুসলিম ছিলেন। অবশ্য ব্রিটিশ ও রাজপরিবারের জন্য যে ভাবনাটি জায়েজ, তা আমাদের জন্য নাজায়েজ। কারণ আমাদেরকে হতে হবে আধুনিক ও উদার।
আওয়ামী ধারাপাত আমাদেরকে সেই আধুনিক ও উদার হওয়ার আহ্বান জানায়। কাজেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির প্রতি সবচেয়ে বড় অবিচারটি করেছে তার নিজেরই রক্তÑ এ কথাটি বলার সাহসও আমাদের কোনো দিন হবে না।
দুই বোনের দুই ছেলের বিয়ে শাব্দিক প্যাঁচে কোনোভাবে কুক্সিগত করা সম্ভব হলেও টিউলিপের পক্ষে কী বলা যায়, তা-ও গবেষণার বিষয়। ‘শাহবাগী মাওলানা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সরকার ও মিডিয়ার আশীর্বাদ নিয়ে একটি সমাবেশ ডেকেছিলেন। ফপ হওয়া সেই সমাবেশ এবং সদ্য সমাপ্ত সিটি করপোরেশনের ফলাফল দেখে ‘আম ও ছালা হারানো’ এই মাওলানা সরকারকে বিশেষ নসিহত দেয়া শুরু করে দিয়েছেন।
আমাদের এলাকায় এক বাইসাইকেল মেরামতের কারিগর ছিলেন। সাইকেলের টায়ার ও টিউবে লিক হলে তা সারিয়ে দিতেন। চামড়া, রাবার এবং প্রায় একই ধরনের টুলবাক্স দেখতে পেয়ে এক লোক তাকে জুতার কারিগর বলে ভুল করে বসে। ভদ্রলোক সরল মনে পায়ের ছেঁড়া জুতাটি সেলাই করার জন্য এগিয়ে দেয়; কিন্তু সেই সাইকেলের কারিগরের প্রেস্টিজ জ্ঞান এতে মারাত্মকভাবে আহত হয়। এক মিনিট আগেও যাকে চিনত না সে হয়ে পড়ে জানের শত্রু। তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন, ‘ব্যাটা সাহস তো কম না, বেক্কলের ঘরের বেক্কল; তুই আমারে জুতার কারিগর ভেবেছিস?’ সেই জুতা উঁচিয়ে ভদ্রলোককে মারতে উদ্যত হলেন। আশপাশের লোকজন এসে ওই ভদ্রলোককে রক্ষা করেছিল।
কারণ তিনি জুতার কারিগর নন। সাইকেলের কারিগর। তেমনিভাবে ছেলেবউকে ইহুদি বলায় ক্ষেপে গেছেন। যদিও বা এ দু’টি ধর্মের সামনেই মুসলমানেরা একই ধরনের টুলবাক্স দেখতে পায়। এর তফাতটি ঠাহর করতে পারে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads