বুধবার, ১৯ জুন, ২০১৩

এদের নিয়ন্ত্রণ করবে কে?


পৃথিবীতে এমন বহু দেশ আছে যাদের অর্থনীতি পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। পর্যটন শিল্প বর্তমান বিশ্বে এতটাই গুরুত্বলাভ করেছে যে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রসমূহের একটি করে মন্ত্রণালয়ও আছে। বাংলাদেশেও এই বিষয়টি স্বীকৃত। বাংলাদেশে পর্যটনের সম্ভাবনা অপার। আমাদের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী সবাই পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে চমৎকার বক্তব্য রাখেন। তাদের বক্তব্যে জনমনে আশাবাদ জাগে, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির স্বপ্নও জাগে। তবে স্বপ্ন বাস্তবায়নের খোঁজ খবর নিতে গেলে আশা ভঙ্গ হয়। অনেক সময় এমন ঘটনাও লক্ষ্য করা যায়, যাতে আমাদের কা-জ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে।
আমরা জানি, দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি দলের লোকজনেরও পর্যটন শিল্পের অনুকূলেই কাজ করার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সুশাসনের অভাবে আমাদের দেশে সরকারি দলের লোকজন এতটাই দাম্ভিক ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে, দেশের স্বার্থও তাদের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয় না। এ কারণেই হয়তো দৈনিক আমাদের সময়ের শিরোনাম হয়েছে ‘পর্যটক শূন্য কুয়াকাটায় আতঙ্ক’। গত ১৮ জুন এই শিরোনামের রিপোর্টে বলা হয়, পর্যটন নগরী কুয়াকাটায় প্রেসক্লাবে হামলাসহ আওয়ামী লীগের তা-বের পর পুরো এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। গত সোমবার সকাল থেকে কুয়াকাটার অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে এলাকা ছেড়েছেন অধিকাংশ পর্যটক। ১৭ জুনের হামলার ঘটনায় আহতদের পটুয়াখালী ও বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। আবারো হামলার আশঙ্কায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৬ জুন বিকেলে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সহ-স্বেচ্ছাসেবক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন কুয়াকাটা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে চা-চক্রে মিলিত হলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতি বাকের মোল্লা ও যুবলীগ সভাপতি সাগর মোল্লার নেতৃত্বে প্রেসক্লাবে হামলা চালানো হয়। হামলার ঘটনায় ৩০ জন আহত হয়। কুয়াকাটা প্রেসক্লাব সভাপতি রোমান ইমতিয়াজ তুষারসহ ৫ সাংবাদিককে পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায় ১৬ জুন রাত ১০টা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ ক্যাডাররা পর্যটন নগরী কুয়াকাটা, তুলাতলী ও আলীপুরে বিএনপি সমর্থিত ব্যবসায়ীদের দোকানে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে। পরে পটুয়াখালী থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে দাঙ্গা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বিএনপি’র এক সমর্থক জানান, তার দু’টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট হয়েছে। তিনিসহ তার পরিবারের অন্যরা বর্তমানে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। পুলিশ সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি জানান। বরিশাল থেকে কুয়াকাটায় ঘুরতে আসা একটি পরিবারের প্রধান কাসেদ আদনান জানান, ১৬ তারিখ রাতে যে নারকীয় তা-ব এখানে হয়েছে, তারপর এখানে আর কোনো পর্যটক থাকার কথা নয়। পরদিন সকালে বাসে করে তিনিসহ তার পরিবারের সদস্যরা বরিশাল ফিরে গেছেন। কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ জানান, বর্তমানে কুয়াকাটার কোনো হোটেলে একজন পর্যটকও নেই। সবাই আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।
পর্যটন নগরী কুয়াকাটায় সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ যে সন্ত্রাসী তা-ব চালিয়েছে, তা শুধু সরকারের জন্য নয়, জাতির জন্যও লজ্জাকর। তাদের কর্মকা-ে শুধু যে আমাদের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক চেতনাও। বিএনপি’র মত একটি বড় দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতার কি কুয়াকাটা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে চা-চক্রে মিলিত হওয়ার অধিকার নেই? সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হয়ে চা খাওয়া ও মতবিনিময় করাতো বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। একমাত্র ফ্যাসিবাদী চেতনার মানুষ ছাড়া সুস্থ ধারার কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী একটি প্রেসক্লাবের চা-চক্রে সাংবাদিক বা ভিন্নমতের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা চালাতে পারে না। আর এরা কেমন ধারার রাজনীতিক, যারা এলাকা ও দেশের স্বার্থ বোঝে না। এদের সন্ত্রাসী হামলা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, কুয়াকাটার হোটেল-মোটেলে একজন পর্যটকও আর অবস্থানের সাহস পাননি। তারা দেশের পর্যটন শিল্পের এমন ক্ষতি করার সাহস ও অধিকার কিভাবে পেল? স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন কি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বিচরণকারী এইসব সন্ত্রাসীর ব্যাপারে অবগত নন? নাকি সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের সমীহ করে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন পর্যটন নগরীর পুলিশ ও প্রশাসন। কিন্তু এমন পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে তো পর্যটন নগরী চলবে না। পর্যটন নগরীর বিকাশের স্বার্থে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন প্রয়োজন। বিষয়টি সরকারকে বুঝতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদেরও।
আমরা সবাই জানি যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আরোহনের আগে নির্বাচনী ইসতেহার প্রকাশ করেছিল, জনকল্যাণমূলক নানা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। ক্ষমতার দম্ভে ও রাজনৈতিক স্বার্থে সরকার নির্বাচনী ইসতেহারের অনেক কথাই ভুলে যেতে পারে কিন্তু জনগণ তো ভুলে না। জনদুর্ভোগ বাড়লে, আশাহত হলে জনগণ শুধু ক্ষুব্ধই হয় না, সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে। যার প্রতিফলন লক্ষ্য করা গেছে খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালের সিটি নির্বাচনে। চার সিটি নির্বাচনের আগেও দেশের জনগণ বর্তমান সরকারের জন্য সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিল। ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার পর্যায়ে দু’টি বড় নির্বাচনেও বিপর্যয় ঘটেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোটের। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সামগ্রিক ফলাফলও ক্ষমতাসীন মহাজোটের অনুকূলে ছিল না। বিপর্যয় ঘটে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও। এগুলো ছিল মহাজোট সরকারের জন্য একের পর এক হুঁশিয়ারি বার্তা। কিন্তু সরকার কিংবা সরকারি দল ধারাবাহিক এসব সতর্কবার্তাকে আমলে না নেয়ায় মহাজোটের জন্য বিপর্যয়ের মাত্রা বেড়েই চলেছে। চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মহাজোট সরকারের শোচনীয় পরাজয়ের মহা ধাক্কা লেগেছে সরকার ও সরকারি দলের মধ্যে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারের প্রতি জনগণ এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে যে, তারা চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যুর চাইতেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছে জাতীয় রাজনীতির নানা ইস্যুকে। এ প্রসঙ্গে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, শেয়ারবাজার ও হলমার্ক কেলেঙ্কারি, রেলের কালো বিড়াল, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন দুর্নীতির কথা উল্লেখ করা যায়। এছাড়া যুদ্ধাপরাধ, শাহবাগ মঞ্চ ও হেফাজতে ইসলাম ইস্যুতে সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনা ও চাতুর্যের কৌশলে জনগণের বিরক্তির মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। সম্প্রতি সন্ত্রাস দমন বিল পাসের যে ঘটনা সরকার ঘটিয়েছে তাকে প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করছে জনগণ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসে যদি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া না হয়, তাহলে তো জনরোষে পড়তে হয় সরকারকে। জনগণকে তুষ্ট না করে রুষ্ট করলে কোনো সরকারের পরিণতিই ভালো হয় না। এমন অবস্থায় সরকার আবারো ক্ষমতায় আসতে চাইছে। এমন চাওয়া জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে রচিত হলে ভালো হতো। কিন্তু সরকার এখন যেন জনগণকে ভয় করছে। চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবির পর তাদের জনভীতি আরো বেড়ে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যেতে নারাজ। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইলে নির্বাচনই হবে না। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যকে জনগণ মেনে নিতে পারছে না। আর এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য গণতন্ত্রের জন্য অশনি-সংকেত, তার বক্তব্যে আমরা স্বৈরাচারী ভাষা দেখতে পাচ্ছি।
দেশের মানুষ মৌলিক অধিকারের জন্য, উন্নত জীবনের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল। লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য তারা বেছে নিয়েছে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। রাজনীতিবিদরাও গণতন্ত্রের কথা বলেই ক্ষমতায় যান। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ক্ষমতায় যাওয়ার পর শাসকরা নানা ছলনা ও চাতুর্যে গণতন্ত্রকে জীর্ণশীর্ণ করে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার অতি ব্যবহারে তারা যে বিবর্ণ হয়ে উঠছেন সে বিষয়টিও উপলব্ধি করতে পারেন না। অথচ জনগণ ঠিকই দেখতে পায় তাদের বিবর্ণ চেহারা। এমন বিবর্ণ রাজনীতিকদের প্রতি তো মানুষের সমর্থন থাকতে পারে না। মানুষ চায় কথা ও কাজের মিল। মানুষ চায় আদর্শ ও কর্মনিষ্ঠায় প্রাণচঞ্চল বর্ণাঢ্য শাসক। কারণ এমন শাসকরাই তাদের স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। আমাদের শাসক ও রাজনীতিবিদরা জনগণের এমন আকাক্সক্ষাকে কতটা মূল্য দিতে সক্ষম হনÑ সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads