রবিবার, ১৬ জুন, ২০১৩

‘চুদুরবুদুর’ জিন্দাবাদ


বাংলা একাডেমীর অভিধানে ‘চুতিয়া’ শব্দটি সংকলকগণ গ্রহণ করলেও বহুল ব্যবহৃত ‘চুদুরবুদুর’ শব্দটিকে অগ্রহণীয় বলে বিবেচনা করেছেন। গ্রহণ-বর্জনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থাকা বাঞ্ছনীয়। যদিও সে রকম কোন কিছু পাওয়া যায় না। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে ‘চুদুরবুদুর’ শব্দটির অস্তিত্ব রয়েছে। এই শব্দটি বিশেষ দু’একটি জিলায় ব্যবহারের কথা অভিধানটিতে উল্লেখিত হলেও আসলে বাংলাদেশের প্রায় সবকটি জেলায়ই এই শব্দের ব্যবহার কম বেশি হয় বৈকি। রাগ বা গোস্যা প্রশমনের হাতিয়ার হিসাবেই নিক্ষিপ্ত হয় এই শব্দটি। যার অর্থ বলা হয়েছে চালাকি, বাড়াবাড়ি, ধূর্তসভাবজাত আচরণ। ‘চুতিয়া’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে আহাম্মক, মুর্খ। উল্লেখিত শব্দ দু’টির কোনটির সাথেই অশ্লীলজাত কোন সং¯্রব আবিষ্কৃত হয়নি আজ অবধি। এরপরও শব্দটির (চুদুরবুদুর) সাথে অশ্লীলতার কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে কেউ কেউ। হঠাৎ করে ‘চুদুরবুদুর’ জাতীয় সংসদের মতো অভিজাত এলাকায় প্রবেশ করে ফেলায় যত বিপত্তি। পত্র-পত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সংসদ সদস্যদের অনেকে আপত্তি তুলেছেন শ্লীল-অশ্লীলের সীমা-সহরত নিয়ে। কার্যবিবরণী থেকে শব্দটি বাদ দেয়ার সুপারিশও করেছেন কোন কোন সদস্য। স্পিকারকে সাধুবাদ, তিনি তা কানে তুলেননি। বলেছেন অনুসন্ধানের পর বিষয়টির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। অনুসন্ধান নাকি চলছে? পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠীও শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আবিষ্কারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যারা হিন্দির কাছে ষষ্ঠাংগে প্রণতি জানায় দিবস-রজনী, বাংলাদেশের বাংলা শব্দের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ তাদের ‘চুদুরবুদুর’ চরিত্রই উন্মোচিত করল নতুন করে।
বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজনীতির অঙ্গনটি যেন ‘চুদুরবুদুর’ শব্দটির কাছেই আত্মসমর্পিত। কি ক্ষমতাবান কি ক্ষমতাহীন উভয়ের স্বভাবে একই রীতি-নীতির গন্ধ উড়ছে কমবেশি। ঠগ-বাটপারি আর হার্মাদিজাত শব্দগুলোর সাথে রাজনীতি বিষয়টি জড়িয়ে গেছে ইদানীং। বর্তমানে অপস্বভাবের মানুষজনদের চিহ্নিত করা হয় রাজনীতিবাজ বলে। হয়তো এ জন্যেই ‘চুদুরবুদুর’ শব্দটি রাজনীতির মূল ঘরেই হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিয়েছে। দেখা যাক ‘চুদুরবুদুর’ জাতীয় সংসদে প্রবেশের শানেনজুল কি।  রাজনীতির প্রাঙ্গণ এমনিতে উত্তপ্ত থাকে বাংলাদেশে। ক্ষমতাবানদের বিদায় বেলা ঘনিয়ে আসলেতো এই উত্তাপ আরো সঙ্গীন হয়ে উঠে। বর্তমানে তেমনটাই আন্দাজ করা যাচ্ছে। কেয়ারটেকার সরকার নিয়ে বহাস চলছে উভয়পক্ষে। ‘কেহ কারে নাহি পারে সমানে সমান।’ কদিন আগে মনে হয়েছিল ক্ষমতাবানদের কণ্ঠ কতকটা নি¤œগামী। মন্ত্রী-নেতা পাতি নেতা এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীরও মোলায়েম কণ্ঠ অনুভূত হচ্ছিল। হঠাৎ দক্ষিণের বাতাস উত্তরে প্রবাহিত হতে শুরু করল। রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে কেয়ারটেকার নিয়ে বসাবসি উধাও হয়ে গেল। ক্ষমতাবানদের মনে হচ্ছে আরো ক্ষমতাধর। তারা হঠাৎ ব্রেক কসল চলন্ত গাড়িতে। তাই যাত্রীগণের একে অন্যের উপর গড়িয়ে পড়ার জোগাড়। নেপথ্যে ভিন্ন কোন খেলোয়াড়ের অনুপ্রবেশ ঘটল কি না কে জানে। কান পাতলে ম্যারাডোনা বা মেসির পদশব্দ শোনা গেলে যেতেও পারে। হয়তো এ জন্যেই ‘চুদুরবুদুর’ জাতীয় শব্দের সংসদের মতো অভিজাত কক্ষে হুটহাট প্রবেশ। শ্লীল-অশ্লীলের বিভাজন যে বা যারাই করতে উদ্ধত হোক না কেন। একবার যখন অনুমতিহীন ঢুকেই পড়েছে আগামীতে অবাধ চলাফেরা করবে হয়তো দ্বিধাহীন। তাছাড়া ক্ষমতাবানদের চরিত্রের যে বৈপরীত্য তাকে চুদুরবুদুর শব্দ ব্যতিরেক আর কোন্্ শব্দে বিশেষায়িত করা সম্ভব? এজন্যে বোধ হয় অভিধান চষতে হবে। সে অভিধান আঞ্চলিক হোক বা নাগরিক শব্দেরই হোক। আপাত নজরে চুদুরবুদুর শব্দটিই জুতসই বলে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে, ভিন্ন কোন শব্দ আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত।
চুদুরবুদুর এখন শানশওকতের সাথে সবখানেই বিরাজমান। অফিস-আদালত, থানাপুলিশ কোথায় নাই এর অস্তিত্ব। চুদুরবুদুর করলেও বিশ্বজিৎকে যারা খুন করেছে তাদের মতো অন্য আরো খুনি হারমাদ জামাইবাবুর মতো পান-তামুক এস্তেমাল করে ফুরফুরে হাওয়া লাগায় শরীরে। এমনটা হয় খুঁটির জোরে। থানা-পুলিশ এখন গ্রেফতার বাণিজ্যে রমরমা। তাদের চুদুরবুদুরের দু’একখানা খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করলেও ‘মাথার উপর জ্বলিছেন রবি’ এই রবির উত্তাপে সব চুদুরবুদুর তাবা। এখানে কোন চুদুরবুদুর খাটে না। কেউ যদি খাটাতে চায় তাকেই পিটিয়ে তক্তা। নতুবা অস্ত্র আইন-গাড়ি পোড়ার অপরাধে পাকড়াও। কি চমৎকার দৃশ্য! এই দৃশ্য এখন দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। দৃশ্যপটে জনগণ, দুর্নীতি-দুঃশাসনে পীড়িত। বাজারে গেলে ব্যবসায়ীদের চুদুরবুদুরের শিকার এরা। দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকলে আটকে যাচ্ছে মানুষ। মধুমাসে ফলের রসনায় তৃপ্ত হবে দেশবাসী। সেখানেও উপায়হীন, মধুর বদলে বিষ। খবরদারি বলতে যা বুঝায় সেরকমের তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণে অপারগ কর্তৃপক্ষ। যে কারণে প্রতি বছর ফল নিয়ে ফালাফালা হচ্ছে দেশবাসী। বিষে বিষে হচেছ নীল কণ্ঠ। এখানে খুনিব্যবসায়ী এবং কর্তৃপক্ষের কর্তা কর্মচারী একাকার হয়ে যান। কয়েক ঝুড়ি ফল ধ্বংস করেই জনগণকে বুঝ দেয়ার ব্যবস্থা হয় মাত্র। এমন না হলে তো ফি বছর একই দৃশ্য একই অভিনয় চলতে পারে না। তাই ঘুরে ফিরে প্রতি ফল মওসুমে চুদুরবুদুর নিপতিত হয় জনগণের শিরে।
ইতিহাসেও এজাতীয় চুদুুরবুদুরের নজির পাওয়া যায়। যেমন ১৯০৫ সালে বাংলাকে ভাগ করে দুটি প্রদেশ করা হয়েছিল। একটি পূর্ববঙ্গ অন্যটি পশ্চিমবঙ্গ। ঢাকা পেয়েছিল দ্বিতীয়বারের মতো রাজধানী হওয়ার মর্যাদা। তখনই প্রতিবেশী সমাজ এবং তাদের বাবু সম্প্রদায় শুরু করল চুদুরবুদুর। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বোমা পর্যন্ত ফুটানো হলো। হত্যা-গুম-দাঙ্গা এক এলাহী কা-। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করলো ওরা। চুদুরবুদুর এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকলো শেষাবধি ভাঙ্গা বাংলা আবার জোড়া লাগলো ১৯১১ সালে। ভারত ভাগের যখন সময় ঘনিয়ে এলো তখন বাবু সম্প্রদায়ের পশ্চাৎদেশে আবার চুলকানির সূত্রপাত। বিরামহীন চুদুরবুদুর। ভারতবাসীকে অবাক করে দিয়ে তারা জিগির তুললো বাংলা ভাগের। লালা লাজপত রায় প্রস্তাব তুললেন হিন্দু বাংলা এবং মুসলিম বাংলার। ১৯২৫ সালের কথা এটি। এই চুদুরবুদুরে প-িত জওহর লাল নেহেরুও যোগ দিলেন। এই উদ্যোগের বিষয়টিকে কঠিন ভাষায় প্রতিবাদ করেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। অবশেষে লাজপত এবং নেহেরুর চুদুরবুদুরই জয়যুক্ত হয়েছিল। যে কারণে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের দেহ এমন কৃষ্ণকায়। সুলতানী আমলে বাংলাদেশের একটা সীমা নির্ধারিত হয়। এর নামকরণ হয় সুবে বাঙ্গালাহ। সুলতানরা বিশ্বময় নিজেদের পরিচিত করে শাহ-এ-বাঙ্গালাহ অভিধায়। সে বাঙ্গালাহর যদি অস্তিত্ব বর্তমানেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো তাহলে মানচিত্রে বাংলাদেশের এক বিশাল বপু প্রত্যক্ষ করতো বিশ্ববাসী। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের নসীব মন্দ, বাবু সম্প্রদায়ের চুদুরবুদুরের যন্ত্রণায় এ মুল্লুকটি এখন ক্ষীণদেহী।
সাম্প্রতিক সময়ে চুদুরবুদুর এবং রাজনীতি একে অন্যের পরিপূরক। চুদুরবুদুর না জানলে রাজনীতিতে পটল তুলতে হয়। তাই ঝানু রাজনীতিবিদগণ এই শব্দটিকে বুকের জেবে অতীবযতেœ লুকিয়ে রাখতে অভ্যস্ত। প্রায়শই এরা চুদুরবুদুর শব্দটি প্রদর্শন করে থাকেন। এতে দ্বিধাবোধ করেন না। কি ঝানু কি অঝানু, রাজনীতির মাঠে চুদুরবুদুর-এর কাছে অনুগত থাকতেই হয়। বিশেষ করে ক্ষমতালিপ্সুদের। ভোটাভুটির নিদানকালেতো চুদুরবুদুরই একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায় প্রার্থীর কাছে। ইদানীং বাংলাদেশের রাজনীতি চুদুরবুদুরময়। যে কারণে শব্দটি সংসদে পর্যন্ত প্রবেশের অনুমতি পেয়ে গেল। তাই ঘোষণা করতেই হয় চুদুরবুদুর জিন্দাবাদ। এই সাথে যিনি সংসদের মতো অভিজাত এলাকায় চুদুরবুদুর শব্দটিকে প্রবেশে সহযোগিতা করলেন সেই সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানুর প্রতিও সাধুবাদ, জিন্দাবাদ। এ জন্যে যে তিনি তার ফেনীর আঞ্চলিক ভাষা বলেছিলেন ‘কেয়ারটেকার সরকার নিয়ে চুদুরবুদুর চইলত ন’।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads