বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০১৩

আলেকজান্ডার ও আজকের ক্ষমতাসীনগণ


আলেকজান্ডার মহাবীর ছিলেন। ছিলেন বিশ্বজয়ী। সিজার, নেপোলিয়ান, চেঙ্গিস খান প্রমুখ ছিলেন বিশ্ববিজেতা। হিটলার, মুসোলিনি নানা কারণে নিন্দিত হলেও, অনেক দেশ বিজয় করেছিলেন। আজকের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের তুলনা চলে না। আজকের ক্ষমতাসীনগণ নিজ দেশের মানুষের মন পর্যন্ত জয় করতে পারেন না। বিরোধী দলকে আস্থায় রাখতে পারেন না। তারা শক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শন করেন নিজের বলয়ে। অথচ ক্ষমতা ও শক্তি কি ঠুনকো বিষয়, সেটা বিখ্যাত বীরগণ জেনে ছিলেন। বীর আলেকজান্ডারের শেষ পরামর্শ আজকের ক্ষমতাসীনদের জন্য খুবই কার্যকরী হবে। তারা এই পরামর্শ থেকে শিক্ষা নিলে নিজেরই উপকার করবেন। কেননা, ক্ষমতা সব সময় থাকে না। আলেকজান্ডারের ক্ষমতাও আজকে আর নেই। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা, সুচিন্তা ও বিচক্ষণতার জন্য তার নাম এখনও পৃথিবরি ইতিহাসে রয়ে গেছে। আমরা জানি না, বর্তমান বিশ্বের কয়জন ক্ষমতাসীনের নাম ইতিহাসে থাকবে? আশা করার মতো কোনও কারণ তারা সৃষ্টি করতে পারেননি। হতাশ করার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।    
এ কথা ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন নির্বিশেষে সকলেই মনে রাখা দরকার যে, মানুষ আর বিভিন্ন পশু-পাখি, জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে ফারাক কোথায়? সকলেই তো প্রাণী! তারপরেও মানুষ আলাদা। বিবেকবান এবং মানুষ অমর হতে চায়। পিপিলিকা চায় না। মাছি বা মশারাও চায় না। বিশ্ব ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ নিয়ে ইতিহাসবিদ জোসিয়া ওবের গবেষণা করে অমরেচ্ছু মানুষদের নিয়ে একটি বই লিখেছেন। নাম ‘আই উইশ আই হ্যাভ বিন দেয়ার’। ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘আমি আশা করি তোমাদের মধ্যে বেঁচে থাকব’। বইটিতে আলেকজান্ডারের কাহিনীটি চমকপ্রদ। মহাবীর আলেকজান্ডার যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। এত অল্প বয়সে সিংহাসন ও রাজকার্য সামলানো তার পক্ষে কঠিন হয়নি। কারণ, লিওনিদাসের মতো একজন যোগ্য প্রশিক্ষকের কাছ থেকে তিনি শরীর বিষয়ে দীক্ষা লাভ করেছিলেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে দর্শন, নীতি শাস্ত্র, যুক্তি শিখেছিলেন মহান গ্রিক প-িত অ্যারিস্টটলের কাছ থেকে। মূলত এইসব সুশিক্ষার কারণেই আলেকজান্ডার প্রচ- শারীরিক দৃঢ়তা ও মানসিক শক্তির পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পরপরই থিবিস আর এথেন্সের গ্রিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে মেসিডোনিয়ার এই তরুণ নৃপতির বিরুদ্ধে। তারুণ্যের প্রাবল্যে আলেকজান্ডার এত দ্রুততার সঙ্গে প্রতিপক্ষকে দমন করতে তাদের দোরগোড়ায়এসে হানা দেন যে, তারা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, স্বয়ং আলেকজান্ডার সদলবলে পৌঁছে গেছেন। এরপর থেকে পরবর্তী ১১ বছর তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য স্বদেশের বহুদূর উষ্ণ সমতল  থেকে সুদূরের হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্যন্ত ধাওয়া করে পৌঁছে যান। অনেক রাজা-বাদশাহ প্রতিরোধের চেষ্টা করে ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে যায় আলেকজান্ডার বাহিনীর আক্রমণে। অনেকেই পালিয়ে সরে যান যে পথ দিয়ে তিনি আসছেন, সে পথ থেকে। আলেজান্ডারের সেনাবাহিনী ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত ২১ হাজার মাইল পথ বিজয়ীর বেশে পরিক্রমণ করে। অবশেষে অনেক রাজ্য জয় করে তিনি নিজ গৃহের দিকে পা বাড়ান। ফিরে যেতে চান প্রিয় স্বদেশে। কিন্তু যাত্রার মাঝখানে প্রচ- জ্বরে আক্রান্ত হলেন তিনি। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহর পথিপার্শ্বের রূপকথার নগরী ব্যাবিলনের রাজপ্রাসাদে। কয়েক দিন আগেই রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তিনি যখন ব্যাবিলনে পৌঁছান, তখন একেবারেই নাজুক তার অবস্থা। রাত জেগে নেশা গ্রহণ ও মদ্যপানের কারণে সম্ভবত রোগের মাত্রা বেড়ে যায়। তিনিও রোগের কবল থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য নেশার কোলে আশ্রয় নেন। এ অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য জ্বর খানিকটা প্রশমিত হলেও, পরে তা প্রকট আকার ধারণ করে। তিনি নড়াচড়া করার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন। তার কথা বলার মতো শক্তিও আর অবশিষ্ট থাকেনি। তবে রাজকীয় সিলমোহর অঙ্কিত আংটিটি তার উত্তরাধিকারী কোনও এক সেনাপতির হাতে পরিয়ে দেয়ার মতো শক্তি তখনও তার শরীরে ছিল। ওই আংটিটি তিনি কাকে পরাতে চান, তা জানতে চাওয়া হলে তিনি নাকি ফিসফিস করে বলতে সক্ষম হয়েছিলেন, ‘যে সবচেয়ে শক্তিশালী’। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিকাল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে কোনও এক সময়ে। তারিখটা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালের ১১ জুন। তখন এই বিশ্বজয়ীর বয়স মাত্র ৩৩ বছর। তার মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত ছিলেন তার সেনাদলের সদস্যগণ, স্ত্রী ও খোজারাÑমেসিডোনিয়া, গ্রিস, পারস্য ও স্থানীয় ব্যাবিলন বা আজকের ইরাকের মানুষ। কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছিল, তা নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয় ম্যালেরিয়া বা টাইফয়েড জ্বরে; মদ বা মাদকের বিষক্রিয়া কিংবা পশ্চিম নীলনদ অঞ্চলের ভাইরাসে। গুজব ছিল মাদকের সঙ্গে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় তাকে। হত্যাকারী হিসেবে অ্যান্টিপাটারের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়। অ্যান্টিপাটার ছিলেন অত্যন্ত নামকরা একজন সেনা অধিকায়ক। আলেকজান্ডার যখন এশিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন, তখন অ্যান্টিপাটারের হাতে মূল রাজ্য মেসিডোনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, অন্তিম সময় টের পেয়ে মৃত্যুশয্যায় আলেকজান্ডার তার সেনাপতিদের ডেকে বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর আমার তিনটি ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে। এতে যেন কোনও ব্যত্যয় না ঘটে। আমার প্রথম অভিপ্রায় হচ্ছে, শুধু আমার চিকিৎসকরাই আমার কফিন বহন করবেন। আমার দ্বিতীয় অভিপ্রায়, আমার কফিন যে পথ দিয়ে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথে আমার কোষাগারে রক্ষিত সোনা, রূপা ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর ছড়িয়ে দিতে হবে। আমার তৃতীয় এবং শেষ অভিপ্রায়, আমার কফিন বহনের সময় আমার দুই হাত কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।’ আলেকজান্ডারের মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত লোকজন মহাবীরের এই অদ্ভূত অভিপ্রায়ে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলেন না কেউ। তখন তার একজন প্রিয় ও বিশ্বস্ত সেনাপতি তার হাতটা তুলে ধরে চুম্বন দিয়ে রাজকীয় সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বলেন, ‘হে মহামান্য, অবশ্যই আপনার সব অভিপ্রায় পূর্ণ করা হবে। কিন্তু কেন আপনি এই বিচিত্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?’ দীর্ঘ একটা শ্বাস গ্রহণ করে আলেকজান্ডার মলিন মুখে মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি দুনিয়ার সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই। আমার চিকিৎসকদের কফিন বহন করতে বলেছি এ কারণে যে, যাতে লোকে অনুধাবন করতে পারে- চিকিৎসকরা আসলে কোনও মানুষকে সারিয়ে তুলতে পারেন না। তারা ক্ষমতাহীন এবং মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম। গোরস্থানের পথে সোনা-দানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা বোঝাতে যে, ওই সোনা-দানার একটি কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি। কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। মানুষ বুঝুক, ধন-সম্পদের পেছনে ছোটা সময়ের মস্ত বড় অপচয় মাত্র। কফিনের বাইরে আমার হাত ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা জানাতে যে, খালি হাতে আমি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম, আবার খালি হাতেই পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি।
অর্ধ বিশ্বজয় করেও আলেকজান্ডার খালি হাতে পৃথিবী থেকে  বিদায় নিয়েছিলেন। খালি হাতে বিদায় নেয়াই পৃথিবীর বিধান। অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতাÑকিছুই সঙ্গে যাবে না। যাবে সুকর্ম কিংবা দুষ্কর্ম। এই কথাটা মনে রাখলে সকলের উপকার হবে। আজকের ক্ষমতাসীনরা যদি অতীতের মহান বীর, বিশ্ববিজেতা ও ক্ষমতাধরদের সম্পর্কে পড়াশোনা করে কিছুটা অবহিত হওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে তারা নিজেরই কল্যাণ নিশ্চিত করবে পারবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads