রবিবার, ২৩ জুন, ২০১৩

সংসদে হেফাজত সম্পর্কিত বক্তব্য প্রসঙ্গে


গত ১৯ জুন জাতীয় সংসদে প্রদত্ত এক অনির্ধারিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ মে রাতের বেলা হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে উচ্ছেদ করার ব্যাপারে কিছু নতুন তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, ‘সেদিন রাতে শাপলা চত্বরে কোন গোলাগুলীর ঘটনা ঘটেনি। যাদের মাদরাসা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল তাদের বাসে লঞ্চে তুলে দেয়া হয়েছে। যারা লুকিয়ে ছিল তাদের বের করে প্রত্যেককে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, আড়াই হাজার-তিন হাজার মানুষ মারলে এতগুলো লাশ কি পাখির মত উড়ে গেল? দেখা গেছে গায়ে লাল রং লাগিয়ে পড়ে আছে, আর পুলিশ যখন টান দিচ্ছে তখন উঠে দৌঁড়াচ্ছে। দেখা গেল লাশ দৌড় মারল। এই ধরনের নাটকও সেইদিন করা হয়েছে।’ ঐ দিনের ঘটনার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের কাছে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যটিকে আমরা সত্যের অপলাপ বলে মনে করি।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে হেফাজতে ইসলাম তাদের ১৩ দফা দাবি পূরণের লক্ষ্যে সরকারকে এক মাস সময় বেঁধে দিয়ে ইতঃপূর্বে গত ৫ মে ঢাকা অবরোধের ঘোষণা দিয়েছিল এবং তাদের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সারা দেশ থেকে হেফাজতের  লাখ লাখ নেতা-কর্মী ঢাকার ৬টি প্রবেশ পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। প্রথম অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সিনিয়র নেতাদের অনেকেই হেফাজতের ১৩ দফার কিছু দফা মেনে নেয়ার আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন এবং আইন মন্ত্রণালয় থেকে এই দাবিসমূহের দফাওয়ারী একটি বিশ্লেষণ দিয়ে বলা হয় যে, হেফাজতের দাবিসমূহের সবগুলোই সংবিধান পরিপন্থী এবং গ্রহণযোগ্য নয়। এই অবস্থায় অবরোধের দিন হেফাজত বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে মহাসমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে  সরকারের নিকট একটি আবেদন করেছিল। সরকার বায়তুল মোকাররমের পরিবর্তে শাপলা চত্বরে এই সমাবেশ করার জন্য তাদের অনুমতি দেন। এই প্রেক্ষিতে শাপলা চত্বরেই তারা সমাবেশের কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর থেকে ঐদিনের ঘটনা সারাদিনই সারা দুনিয়ার মানুষ টিভি চ্যানেলসমূহের সরাসরি সম্প্রচারে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছে। ‘শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশে হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর সমাপনী বক্তব্য রাখার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের নির্দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে সমাবেশস্থলে আসতে দেননি এবং এই অবস্থায় হেফাজত নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাসমাবেশে আগত লাখ লাখ লোক সেইদিন শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। অবস্থানকালে রাতের বেলা তারা অনেকেই সেখানে আল্লাহর জিকিরে মগ্ন ছিলেন এবং কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কোনো প্রকার সমস্যার সৃষ্টি করতে দেখা যায়নি। যদিও বায়তুল মোকাররম, পুরানা পল্টন ও গুলিস্তান এলাকায় হেফাজত কর্মীদের ওপর সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নেতৃত্বে ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা গিয়েছিল এবং ফুটপাতের দোকানপাট লাইব্রেরি এবং কিছু কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে এসব সন্ত্রাসীরা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। প্রায় প্রত্যেকটি টিভি চ্যানেল কর্তৃক এসব খবর ও তার ছবি সম্প্রচার করা হয়েছে এবং পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী সরকার গভীর রাতে যখন শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত নেতা-কর্মীদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন তা কার্যকর করার জন্য সশস্ত্র পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ১২ থেকে ১৫ হাজার সদস্যের একটি বাহিনী গঠন করা হয় এবং তারা বেপরোয়া গুলীবর্ষণ এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে করতেই সমাবেশস্থলের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। বলাবাহুল্য এ অপারেশন শুরু করার আগে সমাবেশস্থল ত্যাগ করার জন্য হেফাজতে ইসলামকে সরকার কিংবা পুলিশ বাহিনী কোনো প্রকার আল্টিমেটাম অথবা সময়ও বেঁধে দেয়নি। তারা তাৎক্ষণিকভাবেই উৎখাত অভিযান শুরু করেন এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই উৎখাত অভিযানে প্রায় ১৫ লক্ষাধিক রাউন্ড গুলীবর্ষিত হয়েছে। রাত পৌনে ২টা থেকে রাত সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল এই  অপারেশন তৎপরতা সরাসরি সম্প্রচার করেছে  এবং কোনো কোনো চ্যানেলে মৃত লাশ ট্রাকে তুলে নিয়ে যাবার দৃশ্যও দেখানো হয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় কত লোক নিহত হয়েছে তার সঠিক হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে সরকার তার নিষেধ সত্ত্বেও অপারেশন তৎপরতা সরাসরি সম্প্রচার করার অপরাধে দু’টি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার ঐদিন রাত থেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন। এখনও সেগুলো বন্ধ রয়েছে। হেফাজতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে হেফাজতের উপর সেদিন যে গণহত্যা চালানো হয়েছে তার নিন্দা করা হয়েছে এবং এর উপর  বিচার বিভাগীয় তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকার তা করেননি। তারা প্রশাসনিকভাবেও এ ব্যাপারে কোনো তদন্ত করেননি। হেফাজত এবং বিদেশী কয়েকটি মিডিয়া এই ঘটনায় আড়াই থেকে তিন হাজার হেফাজত কর্মী নিহত হয়েছে বলে খবর প্রচার করেছে। বিভিন্ন মাদরাসা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে যে, এখনও তাদের হাজার হাজার ছাত্র ও শিক্ষক নিরুদ্দেশ রয়েছেন। কিন্তু সরকারি নির্যাতনের ভয়ে তারা এ তথ্য প্রকাশ করতে পারছেন না। আমরা মনে করি, অবস্থা যাই ঘটুক সরকারের উচিত ছিল একটি নিরপেক্ষ ও বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য জাতির সামনে তুলে ধরা। কিন্তু তা না করে এতোদিন সরকারের মন্ত্রী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং শীর্ষ কর্মকর্তারা দেশবাসীর সামনে নানা তথ্য উপস্থাপন করেছেন যা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। এখন প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে যে তথ্য প্রকাশ করেছেন তা শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, হাস্যাস্পদও বটে। হেফাজতের লোকেরা গায়ে লাল রং মেখে পড়েছিল এবং পুলিশ টান দেয়ার পর তারা উঠে দৌড়ে পালিয়েছে। এ ধরনের কথা আমরা আগে শুনিনি এবং সরকারও তাদের যার যার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রী যে কথা সংসদকে জানিয়েছেন তাও সম্পূর্ণভাবে নতুন একটি তথ্য এবং এই তথ্যের কোনো ভিত্তি আমরা খুঁজে পাই না। একজন সরকার প্রধান এ ধরনের অসত্য তথ্য দিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে পারেন তা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন বলে মনে হয়। হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শফী প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এবং হেফাজতে ইসলাম শুধু নয় সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে বর্তমানে যে আচরণ করছেন তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অথবা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের কাঠামো কোনটার মধ্যেই পড়ে না। এরমধ্যে আবার যদি মিথ্যাচার দিয়ে সরকারের কোনো শীর্ষ ব্যক্তি সত্যকে ঢাকার চেষ্টা করেন তখন তা মেনে নেয়া যায় না।
দেশে রাজনৈতিক শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠা এই সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, গত ৪ বছরে সরকার ও তার নেতৃবৃন্দ শুধু এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গই করেননি শিষ্টাচার বহির্ভূত কর্মকা-ের নতুন রেকর্ডও সৃষ্টি করেছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসাজনিত কারণে সাম্প্রতিক সিঙ্গাপুর সফরকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের যে তথ্য দেশবাসীকে শুনাচ্ছেন তাতে সরকারের ভাবমর্যাদা বাড়ছে বলে আমরা মনে করি না। আবার একজন মায়ের সাথে তার সন্তানরা দেখা করতে গেলে (যদি আদৌ গিয়ে থাকেন) তাতে কারোর গায়ে জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি হওয়ার কারণও আমরা দেখি না। এটিকে আমরা নিছক বিদ্বেষ প্রসূত একটি প্রতিক্রিয়া বলেই মনে করি। এর অবসান হওয়া দরকার এবং যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads