রবিবার, ২ জুন, ২০১৩

সংকটাপন্ন ব্রিটেনের তারুণ্য ও আমাদের যুবসমাজ


ব্রিটেনে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। আশির দশকের প্রথমার্ধের তুলনায় প্রায় এক মিলিয়নের বেশি তরুণ রয়েছে বর্তমানে, যার ব্যাপক অংশ বেকার। ২০১১ সালে লন্ডনসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে দাঙ্গার সময় অগ্নিকা-, লুটপাট ও মৃত্যুর ঘটনা এতটাই অভাবিত ছিল যে, কখনো কখনো একে অবিশ্বাস্যও মনে হয়েছে। তাদের সভ্যতায়, অহংবোধে ধাক্কা লেগেছে। ৬, ৭, ৮ ও ৯ আগস্টের দাঙ্গা এবং লুটপাটে তাদের মূল্যবোধ ধূলিসাৎ হয়েছে।
উদ্বিগ্ন ব্রিটিশ নাগরিকের ধর্ম-বর্ণভেদে প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়াই দেখিয়ে তারা হতবাক। বিস্ময়ের পাশাপাশি তাদেরও প্রশ্ন : কেন এমন হল? এই ভয়াবহ দাঙ্গার কারণ কী? এই প্রশ্ন কেবল সাধারণ নাগরিকদের নয়, ব্রিটিশ গণমাধ্যমের প্রতিবেদক থেকে বিশ্লেষকÑ সবারই। ব্রিটেনের সমাজতত্ত্ববিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও হতবাক, তরুণ যুব সমাজের এ কা- দেখে।
মত বিশ্লেষণ যাই থাক তার মূলে রয়েছে বেকারত্ব, আর্থিক এবং সামাজিক বৈষম্য, যা ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে। সামাজিক অবক্ষয়ের বিষাক্ত বাতাস গ্রাস করছে ব্রিটেনকে। রাজনৈতিক নেতৃত্ববিহীন হঠাৎ জ্বলে ওঠা তরুণদের সাম্প্রতিক নৈরাজ্য বিশ্ববাসীর জন্য একটি অশনিসংকেত। শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ একটি গোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার প্রান্তে। এদের কাজ নেই। বাধ্যতামূলক শিক্ষার জন্য এ গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে; কিন্তু আধুনিক সমাজে এরা বেড়ে উঠতে পারছে না প্রকৃত প্রযুক্তিমুখী সুশিক্ষার আলো নিয়ে।
২০০১ সালে একাধিক দাঙ্গার পর সরকারি-বেসরকারি কমিশন প্রতিবেদনে তরুণদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিনির্ভর করে কর্মমুখী করার সুপারিশ করা হয়েছিল; কিন্তু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। লক্ষ্য করা গেছে, তরুণরা লুটের জন্য যেসব দোকানপাট ভাংচুর করেছে, তার অধিকাংশ ছিল ইলেক্ট্রনিক্স সরঞ্জামের, ডিজাইনার পোশাকের, ফার্নিচারের, মোবাইল ফোনের, স্পোর্টস ওয়্যার ইত্যাদির। এসব দোকানের পণ্য তাদের কেনার সাধ্যের বাইরে। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিয়ে এ ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাটে নির্বিকারভাবে ঘরের ভেতরে থেকেছেন।
পৃথিবী সৃষ্টির প্রান্তলগ্ন থেকে মানবজাতি বন্যা, খরা, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, তুষারপাত, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে। পরিবার, গোষ্ঠী, জাতি বা দেশের ক্রান্তিলগ্নে ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করেছে অনেকেই। বিশেষ করে যুব সমাজের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। দুঃসময়ের ত্রাণকর্তাদের সুসময়ে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতবাসী ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।
মুুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছে। যুদ্ধের শেষ প্রান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী, মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে পৃথিবীর ইতিহাসে মুক্ত আকাশের নীচে সর্বপ্রথম পরাজিত জাতিকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করেছে। বিশ্বের বুকে যতদিন লাল সবুজের পতাকা উড়বে ততদিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাঙ্গালি জাতি স্মরণ করবে। এছাড়া বিদেশী যে সব দেশ, সংস্থা ও নাগরিক বাঙ্গালির বিপদে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদেরকে একে একে জাতীয়ভাবে সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে।
ব্রিটিশ জাতি বিশ্বশাসন করছে সহস্র বছর। তাদের মধ্যে রয়েছে গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ। তারা অনুধাবন করতে পেরেছে সংকটাপন্ন ব্রিটেনে এশীয়রা নিরাপদ। তাদের হাতে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করা যায়। গত শতাব্দীতে ব্রিটিশ রাজকীয় সেনাবাহিনীর দায়িত্ব শ্রীলঙ্কার গুর্খা জনগোষ্ঠীর হাতে ন্যস্ত করেছিল। ৮০’র দশকে বিশ্ববাসী অবলোকন করেছে ফকল্যান্ড যুদ্ধে গুর্খা সৈন্যদের বিরোচিত কর্মকা-।
ইতোমধ্যে ইংরেজদের সমাজনীতি, বাণিজ্যনীতি, রাষ্ট্রনীতিতে এশীয়দের বিশেষভাবে অগ্রাধিকার প্রদান করছে। জনগুরুত্বপূর্ণ পদে এশীয়দের নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করে এশিয়া থেকে জনশক্তি আমদানি করছে। তবে তারা প্রশিক্ষিত, দক্ষ, কর্মঠ যুবশক্তিকে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করে থাকে।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে ধারণা পাওয়া যায় আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যুবক আর তাদের ৪০ ভাগই বেকার। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর ১৮ লাখ নতুন মানুষ কাজের জন্য মুখিয়ে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে দেশে বেকারের সংখ্যা কত তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে অনুমান করা যায় দেশে প্রায় ২.৫ কোটি শিক্ষিত বেকার রয়েছে। বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, দেশের অর্ধেক লোকের স্থায়ী কোন কর্মসংস্থান নেই।
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ জাতীয় অর্থনীতি উন্নয়নের প্রধান উৎস এতে সন্দেহ নেই। এদেশের অধিকাংশ মানুষ যারা বিদেশে যায়, যেতে আগ্রহী তাদের সকল প্রচেষ্টা একান্তই ব্যক্তিগত। সরকারি সাহায্য সহযোগিতায় বা সরকারি উদ্যোগ নিয়ে বিদেশে জনশক্তি রফতানি করার দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য নয়। প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রশিক্ষণ বা কর্মদক্ষতা না থাকায় বাংলাদেশীরা বিদেশে সম্মানজনক কোন পেশায় চাকরি লাভ থেকে বঞ্চিত। লেবার, রাজমিস্ত্রীর হেলপার, গ্যারেজ, ঝাড়–দার, অফিস পিয়ন, হোটেল রেস্তোরাঁর বয় ইত্যাদ কাজে এদেশের মানুষ হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে বিদেশে অর্থ উপার্জন করে। গুণগত মানহীন শিক্ষা ও উপযুক্ত ডিপ্লোমা শিক্ষার অভাবে প্রবাসে শারীরিক পরিশ্রম ছাড়া অন্য কোনো কাজ তাদের ভাগ্যে জোটে না।
সমস্যার অন্তরালে সম্ভাবনা লুকায়িত। সংকটাপন্ন ব্রিটেনে জনশক্তি রফতানি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে হলে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, মিসর, ভিয়েতনাম, কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ, বুদ্ধিমত্তা, মেধায় শারীরিক ও মানসিক সমান যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তরুণ যুবকদের পণ্য, কর্ম ও বিষয়ভিত্তিক ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তবেই দক্ষ প্রশিক্ষিত তরুণ যুব সমাজ অহংবোধের ধাক্কায় বিধ্বস্ত ব্রিটিশ সমাজে গর্বিত অভিবাসীর মর্যাদার আসন দখলে সক্ষম হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads