বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০১৩

সংবিধান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বালখিল্যতা


গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে, আগামী ২৫ অক্টোবর ৯ম জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক উল্লেখিত সময়ে  জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হবে কী-না তা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা আছে। আর থাকাটাই স্বাভাবিক। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্নমত থাকবে, আলোচনা-সমালোচনা থাকবে। এসব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার শুরু থেকেই জাতীয় ইস্যুতে প্রায় ক্ষেত্রেই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। মনে হয় দেশ ও জাতির কাছে তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। যেন দেশটা রীতিমত দুগ্ধবতী গাভী। মনের আনন্দে যত দোহন করা যায় ততই লাভ। আর এই দায়িত্বহীনতা বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষে এসে আরো বেড়েছে। এমন কী খোদ প্রধানমন্ত্রীর চলনে-বলনেও তা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মূলত রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে দলীয় ইস্তেহারে পরিণত করেছে। নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত ও চিরস্থায়ী করার জন্য ১৯৭৫ সালে তারা একইভাবে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করেছিল। আর এ জন্য আওয়ামী লীগকে অনুশোচনা ও বেশ মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু হালে তারা আবার বাকশাল বন্দনা শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ তো মুখ ফসকে বলেই ফেলেছেন তারা নাকি এখনও বাকশাল কনসেপ্টে বিশ্বাস করেন। কয়েক দিন আগে মন্ত্রী ফারুক খান তো এক টকশোতে বলেই ফেললেন, বাকশালের নাকি সমালোচনা করার কোন সুযোগ নেই। কারণ, এটি জাতীয় সংসদে পাস হয়েছিল। যাক এসব বিষয় নিয়ে চর্বিত চর্বন করে আর সময় নষ্ট করতে চাইনা।
আসলে সংবিধান স্থিতিশীল নয় বরং তা গতিশীল। তাই কালের বিবর্তনে ও সময়ের প্রয়োজনে জনগণের কল্যাণে তা পরিবর্তনশীল। তাই হ্যারল্ড ম্যাকবেল তার খরারহম ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হং ও মানরো তার ঞযব মড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব টহরঃবফ ঝঃধঃবং গ্রন্থে বলেছেন, আমেরিকার সংবিধান ইংল্যান্ডের সংবিধানের মতই পরিবর্তনীয় ও নমনীয়। শুধু আমেরিকা ও ইংল্যান্ড কেন স্বাধীনতার চার দশকে আমাদের দেশের সংবিধানও তো পঞ্চদশ বারের মত সংশোধিত হয়েছে। সংবিধান সংশোধনে কোন বাধা নেই কিন্তু সে সংশোধনী হতে হবে গণমানুষের কল্যাণে এবং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। একটি উত্তম ও জনকল্যাণমুখী সংবিধানের কতিপয় লক্ষণ উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। এতে বলা হয়েছে একটি উত্তম সংবিধানে নি¤েœাক্ত লক্ষণসমূহ থাকা খুবই জরুরি- (১) সুস্পষ্টতা, (২) সংক্ষিপ্ততা, (৩) নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সন্নিবেশ, (৪) রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও মূলনীতির উল্লেখ, (৫) মধ্যমপন্থা অনুসরণ, (৬) সময়োপযোগিতা, (৭) পরিবর্তনের পদ্ধতি সন্নিবেশ, (৮) লিখিত, (৯) ভারসাম্য সংরক্ষণ ও (১০) জনগণের ধ্যান-ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণতা। আসলে আওয়ামী লীগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতিকে যে সংবিধান উপহার দিয়েছে তাতে এসব লক্ষণসমূহ উপস্থিত কী না তা আলোচনা সময় সাপেক্ষ, আর এতে আলোচ্য নিবন্ধের পরিসরও বেশ বৃদ্ধি পাবে। তাই বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সচেতন মানুষ মাত্রই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে, সংশোধিত সংবিধানে এ লক্ষণগুলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত এবং গৃহীত সংবিধানে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।
মূলত সর্বশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ ও দীর্ঘ মেয়াদে নির্বিঘেœ ক্ষমতায় থাকতে পারে। আর সেজন্যই আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দলীয় সরকারের  অধীনে নির্বাচন করার খোয়াব দেখছে। সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে দেশের উচ্চ আদালত কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করলেও পঞ্চদশ সংশোধনীতে নানান বৈপরীত্য রয়েছে। সংবিধানের মূল চেতনায় ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সংযোজন করা হলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও বহাল তবিয়তে আছে। সংশোধিত সংবিধানকে অসাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া হলেও পবিত্র কুরআনের আয়াত ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’-এর অনুবাদ সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে। যদিও এ অনুবাদকে দেশের আলেম সমাজ বিকৃত বলে আখ্যা দিচ্ছেন। যদি কখনো জাতীয় জীবনে পালাবদলের হাওয়া লাগে তখন কেউ এই সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ করে বসলে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করতে খায়রুল হক মার্কা বিচারপতির প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না।
আসলে সংবিধানের  পঞ্চদশ সংশোধনী এমনভাবে আনা হয়েছে যাতে আওয়ামী লীগকে আর কখনোই ক্ষমতার প্রভাব বলয়ের বাইরে যেতে না হয়। তারা শুধু কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিলই করেনি বরং চলমান জাতীয় সংসদ বহাল রেখেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। আর কোন কারণে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে না পারলে বা প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকার  নির্বাচন করা না গেলে অনির্দিষ্ট মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় বহাল রাখার আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে গৃহীত সংশোধনীতে। এতে একথা বলার অবশ্যই সুযোগ থাকে যে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার ব্যাপারে সন্দিহান হয় তাহলে তারা দেশে যে কোন ধরনের নির্বাচন হতে দেবে না। তারা তাদের ক্ষমতা ঝুঁকির মধ্যে রেখে কোন নির্বাচন করতে চায় না। অভিজ্ঞমহল মনে করছে আওয়ামী লীগই হয়তো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাঞ্চাল করবে। প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকার নির্বাচন না হওয়ার অজুহাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকবে। তাদের এই উর্বর মস্তিষ্কের স্বপ্নবিলাস কতখানি সফল হবে তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।
মূলত আজকের আলোচনার বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রীর সর্বসাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে। তারা তো মনের মাধুরী মিশিয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছে। কিন্ত এতেও আওয়ামী লীগ সন্তুষ্ট হতে পারেনি বা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেনি। বর্তমান জাতীয় সংসদ বহাল রেখে সংসদ নির্বাচনের কথা সংবিধানে সংযোজিত হলে সরকার দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। ফলে এক সময় প্রধানমন্ত্রী সমালোচনার তীব্রতা কমাতে ঘোষণা দেন যে, নির্বাচনের নব্বই দিন আগে জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হবে। কিন্তু একথাতেও তিনি স্থির থাকতে পারেননি বরং তারপর থেকে বরাবরই বলে এসেছেন যে, বর্তমান সরকার ও বর্তমান সংসদের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নতুন সরকার ও নতুন সংসদ দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত বিদায়ী সংসদ ও সরকার বহাল থাকবে। কিন্তু সে কথার উপরও সরকার বা সরকার প্রধান ঠিক থাকতে পারেননি বরং খোদ প্রধানমন্ত্রী  আগামী ২৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদ বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি এ ঘোষণা দিতে পারেন কী-না বা সংসদ বিলুপ্তি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারভূক্ত কী-না তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। মূলত আমাদের সংবিধান জাতীয় সংসদের মেয়াদ ৫ বছর নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সংবিধানের ৭২ (৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে  প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে ৫ বছর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে’। নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি। সে মতে আগামী বছরের ২৪ জানুয়ারি সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মতে রাষ্ট্রপতি ২৫ অক্টেবর সংসদ ভেঙ্গে দিলে মেয়াদ শেষের তিন মাস আগেই সংসদ বিলুপ্ত হবে। এখন প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গুলি হেলনেই কী সংসদের আয়ুষ্কাল নির্ধারিত হবে?
আমাদের দেশের সংবিধানে দু’টি কারণে জাতীয় সংসদ বিলুপ্তির নির্দেশনা রয়েছে। প্রথমত সংবিধানের ৭২ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ অবসানজনিত কারণে; দ্বিতীয়ত ৫৭ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে এবং অন্য কাউকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন হিসাবে পাওয়া না গেলে। ৫৭ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন কিংবা সংসদ ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দান করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শ দান করিলে রাষ্ট্রপতি অন্য কোন সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন নহেন এই মর্মে সন্তষ্ট হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেবেন’। তাই সংসদ ভেঙ্গে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর কোন স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা নয়। তিনি কেবল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারালেই রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙ্গে দিতে বলবেন। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারানোর কথা লিখিতভাবে জানাতে হবে। বর্তমান জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংসদ সদস্য রয়েছে। ফলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারানোর কোন সম্ভাবনা নেই। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার কথা বললেই রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙ্গে দিতে পারে না বা তিনি বাধ্যও নন। যতদিন সংসদের মেয়াদ আছে ততদিনের জন্য অন্য কোন সংসদ সদস্যের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন আছে কী-না তা তাকে অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। বর্তমান ক্ষেত্রে হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে চাইবেন সংসদ সদস্যরা সেভাবেই সমর্থন দেবেন। কিন্তু সেটি হবে সংবিধানের একটি বিধান উপেক্ষা করার শামিল। সংবিধান সংরক্ষণ, সমর্থন, ও নিরাপত্তা বিধান করা হবে এই মর্মে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীগণ শপথ গ্রহণ করেছেন।
মূলত আওয়ামী লীগ সরকার জুলুম-নির্যাতন, অপশাসন, দুঃশাসনের কারণে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে এখন ক্ষমতা হারানোর ভয়ে প্রমাদ গুণতে শুরু করেছে। তারা জনগণের কাছ থেকে যতই বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন ততই তাদের ফ্যাসিস্ট তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিকে অসাংবিধানিক বললেও এটি তাদের শুধুই অজুহাত মাত্র। তারা সংবিধানের জন্য মায়াকান্না জুড়ে দিলেও ২০০৬ সালে তারাই বিচারপতি কে এম হাসানকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মানেননি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি কে এম হাসানই কেয়ারটেকার সরকার প্রধান হওয়ার কথা ছিল। এমন কী কে এম হাসান দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অধীনে কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হয়েছিল। সে সরকারে আওয়ামী লীগের দেয়া তালিকা থেকে উপদেষ্টাও নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তারা সে সাংবিধানিক সরকারকে মানেননি। এখন তারা আগামী নির্বাচনে তাদের লজ্জাজনক পরাজয় এড়ানোর জন্যই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও আদালতের রায়ের ধূয়া তুলে কেয়াটেকার সরকারের গণদাবি পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে। তারা যদি আদালতের রায়ের প্রতি এতই শ্রদ্ধাশীল হবেন তাহলে তো আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করলেন না কেন? কারণ, দেশের উচ্চ আদালত তাকে প্রকারান্তরে ‘রং হেডেড’ আখ্যা দিয়েছেন। শেখ হাসিনা রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে দেশের সংবিধান ও উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করছেন।
আসলে আওয়ামী লীগ নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্যই ফ্যাসিস্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ফ্যাসিস্ট দলের কর্মপদ্ধতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘বাধ্য হও, বিশ্বাস কর এবং যুদ্ধ কর’ (ঙনবু, নবষরবাব ধহফ ভরমযঃ) মূলত সকল মত ও পথকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পদানত  কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্য করা এবং চরম পরিণতিকে  যুদ্ধ-বিগ্রহের এবং সশস্ত্র পন্থায় ভিন্নমতকে উৎখাত করাই হচ্ছে ফ্যাসিবাদের মুলমন্ত্র। আসলে ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্র, আইন ও সাংবিধানিক শাসন বিরোধী। এ মতবাদে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত হয়না এবং শান্তিও কামনা করে না। ফ্যাসিবাদে নীতি-নৈতিকতার কোন স্থান নেই। যে কোন পন্থায় হীন আত্মস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করা ফ্যাসিবাদের মূল উদ্দেশ্য। তাই মুসোলিনিকে বলতে শোনা যেত, ‘ডধৎ রং ঃড় ঃযব সধহ যিধঃ সধঃবৎহরঃু রং ঃড় ড়িসধহ’ (মহিলাদের নিকট যেমন মাতৃত্ব, পুরুষদের জন্য তেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ )
অবশ্য কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিলুপ্তির ঘোষণাকে ইতিবাচকও মনে করছেন। তারা বলতে চাচ্ছেন যে আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে দেশে মারাত্মক রাজনৈতিক সংকট চলছে। এ ইস্যুতে সরকার এতদিন হার্ড লাইনে থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষণায় সংকট সমাধানের একটি মোক্ষম সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, এতে উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের একটি মোক্ষম সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু এতে উভয়পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট খুবই প্রকট। আর সরকার যে সাংবিধানিক বাধ্য-বাধকতার কথা বলে আসছে তাতেও বিরোধী দলের চাহিদা মোতাবেক নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও অনির্বাচিত কোন সরকার গঠনের কোন সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর সর্বসাম্প্রাতিক ঘোষণায় মহল বিশেষ আশান্বিত হলেও বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা সংবিধানে নেই। তাই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সংবিধান সংশোধনের কোন বিকল্প নেই। ফলে  সংসদ অবলুপ্ত করে এ সমস্যার সমাধান হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বরং তা তীব্র হতে তীব্রতর হওয়ারই ইঙ্গিত বহন করছে। এছাড়াও সংবিধান যেভাবে সংশোধন করা হয়েছে তাতে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হলেও সংসদ সদস্যরা তাদের পদে বহাল থাকবেন। ফলে তারা সংসদ সদস্য হিসাবেই নির্বাচনে অংশ নেবেন। এছাড়াও সংবিধানে উল্লেখ আছে যে, প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তিনি স্বপদে বহাল থাকবেন। অতএব অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী কী করবেন তা স্পষ্ট নয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা  তাদের পদে থেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে (ক) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে  নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই বিধানের কারণেই সংসদ বহাল রেখেই  নির্বাচন কমিশনকে আরেকটি সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। নির্বাচনে সংসদ সদস্যরা তাদের দায়িত্বে থাকবেন। এমন কী চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন সংসদের নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে (ক) উপদফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপদফায় উল্লেখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্য রূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না। ফলে কোন আসনে দু’জন সংসদ সদস্যও  দেখা যাবে। এদের একজন পরিচিত হবেন নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরূপে, অপরজন বিদায়ী সদস্য হিসাবে। বোদ্ধা মহল মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী সংসদ বিলুপ্তির কথা বললেও সংবিধান অনুযায়ী তাদের সবকিছুই বহাল থাকছে। তাই এতে সরকার পক্ষের কোন প্রকার ঝুঁকি বা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বরং সরকার তাদের পূর্ণ প্রভাব বলয় এবং প্রাধান্যের মধ্যেই আগামী নির্বাচন করার সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
মূলত আওয়ামী লীগ এমন কিছু করতে চাচ্ছে না যাতে আগামী নির্বাচনে তাদের ক্ষমতা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। তারা নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সাংবাধানিক বাধ্যবাধকতা ও আদালতের রায়ের কথা বললেও আওয়ামী লীগ বিগত ৪ বছরে নিজেদের সুবিধামত সংবিধানকে যেভাবে তছনছ করেছে তা বিশ্বের তাবৎ সাংবিধানিক শাসনের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। দলীয় স্বার্থে ও নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য আওয়ামী লীগ সংবিধানের অপব্যাখ্যাও কম করেনি। এমন কী খোদ প্রধানমন্ত্রীও সংবিধান ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলেছেন। কখনো বলেছেন বর্তমান সরকার ও সংসদ বহাল রেখেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আবার কখনো বলেছেন সংসদ ভেঙ্গে দিয়েই নির্বাচন হবে। আসলে সরকার আগামী নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংকট নিয়ে কী ভাবছে তা নিয়ে দেশের মানুষের কাছে রীতিমত ধূ¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও দায়িত্বশীলতার পরিবর্তে সংবিধান ও নির্বাচন নিয়ে বালখিল্যতায় লিপ্ত হয়েছেন। যা কখনো কাম্য হতে পারে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads