সোমবার, ১০ জুন, ২০১৩

জাতীয় বাজেট : একটি পর্যালোচনা


অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত গত ৭ জুন ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। ৬৫,৮৭০ কোটি টাকার এডিপিসহ এই বাজেটের আকার হচ্ছে ২,২২,৪৯১ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ৩০,৫২৫ কোটি টাকা বেশি। বলাবাহুল্য, অর্থমন্ত্রী জনাব মুহিতের পেশ করা এটি হচ্ছে ৭ম জাতীয় বাজেট। এর আগে ১৯৮২-৮৩ ও ৮৩-৮৪ সালে স্বৈরাচারী শাসক জেনারেল এরশাদের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি দুটি বাজেট পেশ করেছিলেন। তার ১ম বাজেটটি ছিল ৪৭৩৮ কোটি টাকার। আবার এই সরকারের আমলে তিনি প্রথম যে বাজেট পেশ করেছিলেন তার আকার ছিলো ১,১৩,৮১৯ কোটি টাকা। বর্তমান বাজেটটি এই সরকারের আমলের প্রথম বাজেটের তুলনায় ১০,৮৬৭২ কোটি টাকা বেশি। এই আমলে তার পেশ করা পূর্ববর্তী চারটি বাজেটের ন্যায় ৫ম বাজেট পেশের প্রাক্কালেও পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন না। বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১,৬৭,৪৫৯ কোটি টাকা যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ২৭,৭৮৯ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে এনবিআর-এর আওতাধীন রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১,৩৬,০৯০ কোটি টাকা যা বর্তমান অর্থবছরের তুলনায় ২১ শতাংশ তথা ২৪,০৯০ কোটি টাকা বেশি। এই অর্থ নতুন শুল্ক ও করের আকারে দেশবাসীকে পরিশোধ করতে হবে। বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ৫৫,০৩২ কোটি টাকা। এখানে মজার বিষয় হচ্ছে এডিপি থেকে ঘাটতির পরিমাণ বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে মাত্র ১০৮৩৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণ করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। উন্নয়ন ও উন্নয়ন বহির্ভূত উভয় বাজেটের ব্যয় বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বরাদ্দের দিক থেকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে জনপ্রশাসন (১৪.৪%)। অগ্রাধিকারের দৃষ্টিকোণে পরের অবস্থান হচ্ছে যথাক্রমে দেশী-বিদেশী ঋণের সুদ (১২.৫%), শিক্ষা ও তথ্য প্রযুক্তি (১১.৭%), পরিবহন ও যোগাযোগ (৯.৩%), বিবিধ খাত (৮.৩%), কৃষি (৭.৯%), স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন (৬.৭%), প্রতিরক্ষা (৬.৫%,  সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ (৫.৬%), বিদ্যুৎ, জ্বালানি (৫.১%), জননিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা (৪.৭%), স্বাস্থ্য (৪.৩%), শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা (১.৪%), গৃহায়ণ (০.৮%), চিত্তবিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম (০.৮%)। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে ধর্মীয় খাতের বাজেট অত্যন্ত নগণ্য। আবার সুদের অবস্থান দ্বিতীয়।
বাজেটে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে মোট ৪৮,৩৬২ কোটি টাকা ঋণ এবং বৈদেশিক অনুদান বাবদ ৬,৬৭০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এর সাথে রাজস্ব প্রাপ্তি বাবদ ১,৬৭,৪৫৯ কোটি টাকা যোগ করলে মোট প্রাপ্তি দাঁড়ায় ১,৭৪,১২৯ কোটি টাকা। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২,২২,৪৯১ কোটি টাকা। ফলে অনুদানসহ ঘাটতি দাঁড়ায় ৫২,০৩২ কোটি টাকা এবং অনুদান বাদে ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ৪৮,৩৬২ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী আয়কর খাতে চলতি বছরের তুলনায় প্রায় ৩৭.৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ৪৮,২৯৭ কোটি টাকা আদায় করতে হবে, ২৭% প্রবৃদ্ধি ধরে ভ্যাট আদায় করতে হবে ৪৯,৯৫০ কোটি টাকা। শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৬,৮৩৭ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর বাবদ আদায় করা হবে ১০০০ কোটি টাকা। আয়কর, ভ্যাট এবং শুল্ক আদায়ের এই প্রবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাজেটে অর্থায়নের যে উৎস বর্ণনা করা হয়েছে তা কার্যকর করা হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর বাবদ আসবে ৬১.২ শতাংশ অর্থ, রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর বাবদ আসবে ২.৩ শতাংশ; কর বহির্ভূত প্রাপ্তি ১১.৮ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৫.৩ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ ৬.৫ শতাংশ এবং বৈদেশিক অনুদান বাবদ ২.৯ শতাংশ। নতুন বাজেটে কিছু পণ্যের উপর থেকে শুল্ক হ্রাস বা প্রত্যাহারের ফলে ঐসব পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি, সোলার বাতি এলইডি ল্যান্স, কম্পিউটার সার্ভার, হেভি ট্রান্সফর্মার পাওয়ার হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি ১০ এমভিএ, ফায়ার এক্সটিংগুইসার, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরির যন্ত্রাংশ, গ্যাস জেনারেটর ও যন্ত্রাংশ, বাইসাইকেল উৎপাদনের এইচআর কয়েল, সীম কার্ড, গাড়ির উইন্ড শীট, অফসেট প্রিন্টিং প্লেট, সৌন্দর্য ও প্রসাধন সামগ্রী, ত্বক ও কেশ পরিচর্যার সামগ্রী প্রভৃতি। এই তালিকায় মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের নিত্যব্যবহার্য কোন সামগ্রী নেই। ফলে বাজেট সাধারণ মানুষের কোন কল্যাণে আসবে বলে মনে হয় না। এতে করে যে বোঝা চাপবে তা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। আবার এই বাজেটে আমদানিকৃত নিউজপ্রিন্টের ওপর করারোপের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা কার্যকর করা হলে সংবাদপত্র শিল্পের ব্যয় ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে গণমাধ্যম বিশেষ করে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ হয়ে পড়বে। কৃষিখাতে ভর্তুকি হ্রাস, খাদ্য উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের উৎসাহিত করবে। নির্মাণ সামগ্রীর উপর করারোপ, রেজিস্ট্রেশন ফি বৃদ্ধি প্রভৃতি স্থির ও মাঝারি আয়ের লোকদের বাড়িঘর তৈরিই শুধু নয়, আবাসন খাতেও নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে।
ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের কর আয়ের সীমা জীবন-যাত্রার ব্যয় ও বিদ্যমান মূল্য কাঠামোর প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন ধরেই তিন লাখ টাকা করার দাবি উঠেছিল। বাজেটে এই সীমা দুই লাখ বিশ হাজার করা হয়েছে। এতে ব্যক্তি শ্রেণীর আয়কর দাতাদের সংকট কিছুটা কমলেও আয়করের সর্বনি¤œ সীমা বেঁধে দিয়ে সরকার তাদের জন্য নতুন সংকট সৃষ্টি করেছেন। এই সরকারের বহুল প্রচারিত পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ থিওরি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এই অবস্থায় বাজেটে পিপিপির অনুকূলে নতুন বরাদ্দকে আমরা পরিহাস বলে মনে করি। এই বরাদ্দ দলীয় ক্যাডারদের উজ্জীবিত করার তহবিল হিসেবে ব্যবহৃত হবার আশঙ্কা রয়েছে। পদ্মাসেতু নির্মাণের জন্যে বাজেটে যে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে তাও আরেকটি পরিহাসের অংশ। এর আগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী এবং জনমতের চাপে সরকার তাদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এখন নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের নামে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ করে পুনরায় তাদেরকেই ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, পদ্মাসেতু নির্মাণ নয় আসলে সরকার ও তার দোসররা এর নামে অর্থ কামাই করতেই তৎপর।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, বাজেট ঘোষণার পর এর আকার এবং তথ্য-উপাত্ত নিয়ে দেশব্যাপী মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী জোট ও তাদের ঘনিষ্ঠজনরা একে অভিনন্দন জানিয়েছেন। পক্ষান্তরে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, পেশাজীবী ও গবেষণা সংস্থাসমূহ, অর্থনীতিবিদ এবং শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা এই বাজেটকে ভোটার ভোলানো বাস্তবায়ন অযোগ্য একটি অবাস্তব দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ তাদের এক মূল্যায়নে বাজেটকে অবাস্তব এবং গতানুগতিক ও ব্যাংকিংখাতের ওপর নির্ভরশীল বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জনগণকে খুশি করে ভোট পেতে এবারের বাজেট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি দলিল হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। বাজেট প্রস্তাবনায় যেসব আশা ও প্রত্যাশার কথা শুনানো হয়েছে এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থায়নের প্রয়োজন সেদিক দিয়ে এটি বাস্তবভিত্তিক নয়। সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন। চলতি অর্থবছরে যেখানে এই হার ৬ শতাংশ সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নির্বাচনী ঢামাঢোলের বছরে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন একটি কল্পনা বিলাস ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। কেননা, দেশে বর্তমানে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের হার অত্যন্ত কম এবং বিনিয়োগ না থাকলে প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভবপর নয়। অন্যদিকে বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছেন। যেখানে বর্তমান বছরেই মূল্যস্ফীতির হার ৮.৩ শতাংশ সেখানে সরকার আগামী অর্থবছরে তার পরিমাণ কিভাবে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনবেন, তার কোন দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করেছেন এবং খাদ্যসহ এমন কোন পণ্য নেই যার দাম বাড়ছে না। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে থাকবে। আবার সরকারের দুঃশাসন, মীমাংসিত বিষয়কে নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, হামলা, মামলা এবং গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার হরণ প্রভৃতি কারণে রাজনৈতিক সহিংসতা দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতির হার কমার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের অধিকহারে ঋণ গ্রহণ মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। এছাড়াও বাজেটে অর্থ সরকারি দলের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয়ের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকার সম্প্রতি এক্ষেত্রে অনেকগুলো দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। রাজশাহীতে বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগের বিষয়টিকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জাতীয় নির্বাচনে সরকারি দল কর্তৃক জাতীয় তহবিলের অর্থ অপচয়ের বিষয়টি পরিস্ফুট হয়ে উঠে। বিদেশের পত্রিকায় সাফল্য প্রচারে সরকারের চাঁদাবাজির ওপর সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য দেশবাসীকে হতবাক করেছে। এ রিপোর্ট অনুযায়ী সরকার এক লক্ষ ৯০ হাজার ডলার ব্যয়ে লন্ডনের একটি পত্রিকায় সাফল্যের ওপর একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন।
এই অর্থ সরকার সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে চাঁদা হিসেবে গ্রহণ করেছেন বলে প্রকাশিত তথ্যে জানানো হয়েছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে দেশ-বিদেশে সরকারি অর্থে এ ধরনের প্রচারণা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং এজন্য বাজেটের অর্থ ব্যয় হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার অপ্রত্যাশিত খাতে ব্যয়ের জন্য যে থোক বরাদ্দ বাজেটে রাখা হয়েছে তাও এই সরকার নির্বাচনে যে ব্যয় করবেন না তার গ্যারান্টি নেই। বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতের সংকটের সাথে দুর্নীতির ব্যাপ্তি, ঋণ প্রবাহের শ্লথ গতি বর্তমানে দেশে সার্বিক বিনিয়োগে স্থবিরতা এনে দিয়েছে। ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। গতিশীল ব্যবস্থাপনার জন্য বাজেটে মুদ্রানীতির ওপর প্রাধান্য দেয়া হলেও তা কোনও কাজে আসবে বলে মনে হয় না, এজন্য আর্থিক নীতির ওপর প্রাধান্য দেয়ার প্রয়োজন ছিল। একই সাথে সরকারের ভ্রান্ত আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত কারণে মূল্যস্ফীতির আরো অবনতি ঘটবে। এর সাথে মুদ্রাস্ফীতি যুক্ত হয়ে এই বাজেট মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে বলে আমার বিশ্বাস। বাজেটের আকার নিঃসন্দেহে বড় তবে  ১৬ কোটি মানুষের জনবহুল এই দেশের জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তথাপিও বাজেট প্রণয়নের প্রাক্কালে সরকার তার সামর্থ্যরে কথা বিবেচনা করেছেন বলে মনে হয় না। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সুশাসন ও দক্ষ ও যোগ্য এবং সৎ জনবল ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যরে প্রয়োজন হয়। বর্তমান সরকারের এর কোনটিই নেই। স্থানীয় সরকারসমূহ বিশেষ করে উপজেলা পরিষদসমূহ এখন পঙ্গু অবস্থায় আছে। উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কাজ করতে পারছেন না। তাদের স্থানীয় এমপি এবং আমলাদের বশংবদ করে রাখা হয়েছে। প্রশাসনের দলীয়করন সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সৎ যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক বিবেচনায় হয় অবসরে পাঠানো হয়েছে কিংবা চাকরিচ্যুত করা হয়েছে অথবা ওএসডি করে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় বিশাল একটি বাজেট বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। আবার বাজেট ও এডিপির অর্থায়নে যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তাও প্রশ্নাতীত নয়। প্রথমত বাজেটটি জনবান্ধব নয়। দ্বিতীয়ত এর মধ্যে নির্বাচনী লক্ষ্য হাসিলের জন্য যে প্রতারণার গন্ধ পাওয়া যায় তাতে বাজেটের বাস্তবায়ন যোগ্যতার ওপর নানা আশঙ্কারও সৃষ্টি হয়।
বাজেটের বিশাল ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি ও তারল্য সংকট বাড়াবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। বাজেটে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে যথাক্রমে ২৩,৭২৯ কোটি ও ৩৩,৯৬৪ কোটি তথা সর্বমোট ৫৭,৬৯৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ২৩,০০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার কথা ছিল কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যে, অর্থবছরের ১১ মাসেই এই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে সরকারকে এই খাত থেকে ২৮৫০০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে। বৈদেশিক খাতের প্রস্তাবিত ঋণ যদি আদৌ পাওয়া যায় তাহলেও দেখা যায় যে, ৫৭,৬৯৩ কোটি টাকার মধ্য থেকে পূর্বে গৃহীত ঋণের সুদবাবদই সরকারকে ২৭,৭৪৩ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। এর অর্থ দাঁড়ায় এক্ষেত্রে সরকার পাচ্ছেন মাত্র ২৯,৯৫০ কোটি টাকা। এ প্রেক্ষিতে সহজেই বলা যায় যে, ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের যে টার্গেট নির্ধারণ করেছেন তা সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। সরকারের দৈনন্দিন খরচ নির্বাহের জন্য ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের প্রবাহ আরও বৃদ্ধি করতে হবে। সেটা করতে গেলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পুঁজি চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাংকের হাতে প্রয়োজনীয় অর্থ নাও থাকতে পারে। বলাবাহুল্য এই সরকারের মেয়াদ আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত ধরা হলে অর্থবছরের বাকি ছয়মাস নতুন সরকারকেই বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এ অবস্থায় নতুন সরকারের  পক্ষে অর্থায়ন, প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মূল্যস্ফীতি রোধের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা দুরূহ হয়ে পড়বে। বাজেটের ঘাটতি হচ্ছে ৫৫,০৩২ কোটি টাকা আবার এডিপি ধরা হয়েছে ৬৫,৮৭০ কোটি টাকা। তদুপরি এডিপিতে সরকারের এমন কিছু নির্বাচনী প্রকল্প যোগ করা হয়েছে যার অর্থায়ন যেমন অনিশ্চিত তেমনি বাস্তবায়ন সম্ভাব্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার যে কেলেঙ্কারি করেছেন তা আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাকে ক্ষুণœ করেছে।
উপরোক্ত অবস্থায় প্রদর্শনীমূলক বাজেটের ধারণা প্রত্যাহার করে বাজেটের আকার হ্রাস, নতুন করারোপ প্রস্তাব বাতিল এবং সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ সমূহ মোকাবিলার লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক দিকদর্শন দিয়ে বাজেট পুনর্গঠন জরুরি বলে আমি মনে করি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads