সোমবার, ১০ জুন, ২০১৩

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শকুনের চোখ


গত সপ্তাহে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশে একটি ঝটিকা সফরে এসে তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নেন। ফলে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আলোচনার সম্ভাবনা তৈরী হয়। কিন্তু তারানকো চলে যাওয়ার পরপরই নিজেদের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায় এই দু’দল। কিন্তু কেন নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সংলাপে হঠাৎ ব্যাপক আগ্রহী সরকার আবার পিছু হটছে? সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে বিরোধী দলকে চিঠি পাঠানোর ঘোষণা দিয়েও তারা হার্ডলাইনে ফেরার কারণটাই বা কি?। তার আগে বলে নেই জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ও রাজনৈতিক বিষয়ক বিভাগের প্রধান অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো কি উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। তিনি এসেছেন নাকি বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে উৎসাহিত করতে। যদি এই ব্যাপারটা সত্য হয়ে থাকে তাহলে খুবই ভাল কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। আমাদের নেতা নেত্রীরা বুঝলেন না দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সংলাপ প্রয়োজন। তাদের বুঝাতে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশে আসতে হল। জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। এক পর্যায়ে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো আরও বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘ কোনো ফর্মুলা দিতে পারছে না। বাংলাদেশ না চাইলে কোনো ফর্মুলা দেয়ার এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই। আমি বুঝতে পারছি না এই প্রসঙ্গটা আসলো কেন? তাহলে কেউ কি তার কাছে কোন ফর্মুলা চেয়েছিল? যদি চেয়ে থাকে তাহলে কে সে? অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো আরও বলেছেন, এই মুহূর্তে জাতিসংঘ নির্বাচনী ফর্মুলার পরিবর্তে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরাধী দল বিএনপির মধ্যে একটি ফলপ্রসূ সংলাপ প্রত্যাশা করে। চলমান সংঘাতের রাজনীতি দীর্ঘস্থায়ী হোক, সেটা তারা চায় না। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় দেশটির দ্রুত সামনের দিকে ধাবিত হওয়া দেখতে চায় তারা। এ উদ্দেশ্যে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রত্যাশা করে জাতিসংঘ। এই চাওয়াগুলো এদেশের সকল সাধারণ মানুষের। তাহলে কেন অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে এসে এই কথাগুলো বলতে হলো?
এরও আগে গত ২ মে এক অনুষ্ঠানে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে সংসদের ভেতরে বাইরে যে কোনো জায়গায় আলোচনায় বসতে আগ্রহ প্রকাশ করে সংলাপের আহ্বান জানান। একই দিন বিকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফও ঘোষণা দেন দুই একদিনের মধ্যে সংলাপের প্রস্তাব সংবলিত চিঠি বিএনপিকে প্রেরণের। কিন্তু তিনি আজও সেই চিঠি প্রেরণ করেননি। জাতির সামনে ঘোষণা দিয়ে পালন না করা কিসের লক্ষণ? যদিও প্রস্তাব উত্থাপনের দুদিন পরই সংলাপের প্রস্তাবকে ‘নাটক’ আখ্যায়িত করে নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নিতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। তারপরও সৈয়দ আশরাফ সাহেবের উচিৎ ছিল জাতির সামনে ঘোষণার প্রতিফলন ঘটানো। খালেদা জিয়া না জেনেই সত্য বলেছে। কারণ আসলেই সংলাপ হল অভিনেতা ও অভিনেত্রীবৃন্দ কথোপকথনের জন্য যেই কথামালা ব্যবহার করেন। অভিনেতা বা অভিনেত্রী যা বলেন তা-ই সংলাপ। সাধারণত কোন নাট্যকার পা-ুলিপি আকারে যেই নাটক রচনা করেন, তার অন্যতম প্রধান অংশ হয় সংলাপ। আর আপনাদের এই নাটকের রচয়িতা হল জাতিসংঘ।
শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে হাজারও। প্রশ্ন আছে লিবিয়া, প্যালেস্টাইনের বিষয়েও। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘের ভূমিকা হতাশাজনক। এমন আরও অনেক ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বারবার। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জাতিসংঘ তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। আমেরিকা, চীনসহ অধিকাংশ রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার জন্য জাতিসংঘকে পরামর্শ দেয়। মুক্তিযুদ্ধের এ সঙ্কটকালে সোভিয়েত রাশিয়া তার ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে না এলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যুদস্ত হতো এবং বাংলাদেশ হতো আর এক ভিয়েতনাম। সেই জাতিসংঘ এসেছে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সংলাপে উদ্বুদ্ধ করতে। এটাকে নাটক ছাড়া কি অন্য কিছু বলা সম্ভব?
জাতিসংঘ মূলত বিশ্বের জাতিসমূহের একটি সংগঠন, যার লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। ১৯৪৫ সালে ৫১টি রাষ্ট্র জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসংঘ সনদ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তীতে লুপ্ত লীগ অফ নেশন্সের স্থলাভিষিক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী মিত্রশক্তি পরবর্তীকালে যাতে যুদ্ধ ও সংঘাত প্রতিরোধ করা যায়, এই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়। তখনকার বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি জাতিসংঘের বা রাষ্ট্রসংঘের সাংগঠনিক কাঠামোতে এখন প্রতিফলিত হচ্ছে। জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্য (যাদের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, গণচীন হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৫টি বিজয়ী দেশ। বাস্তবে দেখা যায় জাতিসংঘকে তার বিপরীত কাজে বেশি ব্যস্ত থাকতে। বিশেষ করে আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তির ফায়দা হাসিলে জাতিসংঘ সদা সর্বদা নিয়োজিত আছে। সেই জাতিসংঘের বাংলাদেশের ওপর বিশেষ দৃষ্টি পড়েছে এবং অনেক বেশি তৎপর দেখাচ্ছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। এটা আতঙ্কের বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads