রবিবার, ২ জুন, ২০১৩

জনগণ এবং সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা : কিছু প্রশ্ন

একটা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা যদি শূন্যের কোঠায় চলে যায় তাহলে সে দেশ চলবে কী করে? প্রতিটি েেত্রই যদি সরকার মিথ্যার আশ্রয় নেয় বা নিজের দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়, তাহলে সরকারের কোনো কথাই আর মানুষ বিশ্বাস করবে না। এমনকি যা সত্য তাও বিশ্বাস করতে চাইবে না। যেমন কিছু দিন আগে রাতভর টেলিভিশনের পর্দায় সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসাবশেষ থেকে রেশমাকে উদ্ধারের দৃশ্য দেখে শিহরণ এবং মেয়েটির সৌভাগ্য দেখে বিস্ময় ও আনন্দ বোধ করছিলাম। কিন্তু সকালে ফেসবুক খুলে দেখলাম, বিতর্ক ও অবিশ্বাসের ঝড়। এটা সরকারের একটা সাজানো নাটক বলে অভিমত দিয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ পোস্ট এবং তাদের ব্যাখ্যাও বহুবিধ। বেশির ভাগেরই ধারণা, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেয়া বা তা থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্যই এই ঘটনার অবতারণা। কারো কারো মতে, সাভারের অন্ধকার কূপ থেকে লাশ নয়, সরকারের ভাবমূর্তিকে কিছুটা টেনে তোলাই এর উদ্দেশ্য ছিল। কিছু কথা যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য মনে হচ্ছিল। যেমন, রেশমার পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড়ের ব্যাপারে সন্দেহ প্রসঙ্গে অনেক দিন পর বলা হলো, একটি আন্ডারগ্রাউন্ড দোকান থেকে সে এই কাপড় নিয়েছিল। রেশমা বলেছিল, তার আশপাশে কয়েকজন মারা গিয়েছিল। কিন্তু তাকে উদ্ধার করার সময় পাশে কোনো লাশ পাওয়া যায়নি বলে জানা যায়। এতে মনে করা যায়, এর আগে ওইসব লাশ উদ্ধারের সময় রেশমা সেখানে ছিল না। প্রথমে রেশমা বলেছিল, সে শুধু পানি খেয়ে বেঁচেছিল, পরে অবশ্য সেনা উদ্ধারকর্মীদের সাথে সুর মিলিয়ে বিস্কুটের কথাও বলেছে। ১৭ দিনে চারটি বিস্কুট খেয়েছে। ওই ১৭ দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার পর যে রকম মুমূর্ষু অবস্থা হওয়ার কথা ছিল তার, সে তুলনায় রেশমাকে যথেষ্ট সুস্থ মনে হচ্ছিল। এ ধরনের অনেক কথাই ফেসবুকে, এমনকি কিছু পত্রিকায়ও এসেছে।

এসব প্রশ্ন জনসাধারণের মনে হয়তো আসত না, যদি দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক  থাকত। বরং আমি মনে করি, ১৭ দিন পর একটি মেয়েকে উদ্ধার করে সরকার নিজের কিছু সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে, বিশেষ করে উদ্ধারকার্য সংক্রান্ত বিদেশী সাহায্য গ্রহণ না করে। এখন সবার কাছে এটাই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে, দু-তিন দিনের মধ্যে পাশ্চাত্যের উন্নত প্রযুক্তি সংবলিত কারিগরি সাহায্য এলে আরো কয়েক শ লোক বাঁচানো যেত। শাহীনারও অত্যন্ত করুণ মৃত্যু হতো না। জাতিসঙ্ঘের মানবিক সাহায্যবিষয়ক উপদেষ্টা গার্সন ব্র্যান্ডাও রানা প্লাজা ধসের পরই নাকি একাধিকবার ফোন করেছিলেন বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের প্রধান আহমেদ আলীকে। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপরে অনুমতির কথা বলে তিনি শুধু কালপেণ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত কোনো উত্তর দেননি, অর্থাৎ অনুমতি পাননি ওপরের। জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তারা এতে দারুণ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য এই প্রস্তাব উন্মুক্ত রেখেছেন। উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে ভারতের গুজরাট ও তুরস্ক, হাইতি ইত্যাদি স্থানে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হওয়ার পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বিদেশী উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছে গেছেন। আমাদের সরকার জাতির মানসম্মানের কথা বিবেচনা করে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতি না বলে শুধু সরকার বললে আপত্তি ছিল না। কারণ সরকারের অযোগ্যতা, অদতা এবং এই দুর্ঘটনায় সরকারি দলের সম্পৃক্ততা লুকানোর জন্যই সরকার এই অযৌক্তিক ও অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সবার ধারণা। আর মানসম্মান? সে তো সরকার নিজেই ভূলুণ্ঠিত করেছে। শুধু জাতির কাছে নয়, গোটা বিশ্বের কাছে পদ্মা সেতুর নজিরবিহীন দুর্নীতিসহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে তা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
একই ভাবে, হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে যেসব নাটক করা হয়েছে, তাও এখন জনগণের কাছে খোলাসা হয়ে গেছে। পিলখানার হত্যাকাণ্ডকে নিয়েও প্রথমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল এই বলে যে, এটা মৌলবাদীরা ঘটিয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা এবং সরকারের পতন ঘটানোর জন্য। পরে দেখা গেল, ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টো। পিলখানার সেই ঘটনার জের ধরেই আজ আমাদের দেশের এই দুরবস্থা। অত্যাচার ও অবিচার সব সীমা অতিক্রম করে গেছে, কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। হেফাজতের দ্বিতীয় সমাবেশের আগেই যে, সব পরিকল্পনা আঁটা হয়ে গিয়েছিল, তা একটু সচেতন লোকেরই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অনেকের বিশ্বাস, পরিকল্পনা অনুযায়ী পল্টনের পরিবর্তে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে কিছু হেফাজত নেতার মুখে বলানো হলো, সন্ধ্যার পর শাপলা চত্বরে তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না এবং আগুন লাগিয়েছে শিবির আর ছাত্রদলের ছেলেরা। সেখানে পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের এবং সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোর অনেক ক্যামেরা ও ভিডিও সারাণ ছবি তুলেছে; কিন্তু এক যুবলীগ কর্মী ছাড়া কারো নাম তো এ পর্যন্ত পাওয়া গেল না। এই যুবকটির নাম মানবজমিনসহ একাধিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, কিন্তু মামলা করা হয়েছে শুধু বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ারের বিরুদ্ধে। আর যদি শিবির ও ছাত্রদলের কর্মীদের পুলিশের ক্যামেরায় শনাক্ত করা যেত তাহলে সরকার মহা-আনন্দে তাদের পরের দিনই গ্রেফতার করে ফেলত এবং এর প্রচারমূল্যও হতো অনেক বেশি। কারণ এখন তো সরকারকে অনেক মিথ্যাকে সত্য বানিয়েও প্রচার করতে হচ্ছে।
এটা কে বোঝে না যে, কোনো দিন হেফাজতে ইসলাম মতায় এলেও তাদের ১৩ দফা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় একবিংশ শতাব্দীতে। অথচ প্রথম সমাবেশের পর হেফাজতের এসব দাবির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমর্থন জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সমাবেশের পর আরেক দিন শাপলা চত্বরে থাকতে দিলেই হেফাজতিরা কান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যেত। কিন্তু সরকার বেশ কিছু ফায়দা লোটার উদ্দেশ্যে এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। প্রথমত, দোকানপাট, ব্যাংক, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পুড়ে যাওয়ায় তারা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সমর্থন নিতে চাইল, কুরআন পোড়ানোর ঘটনা দ্বারা মুসলমানদের, বিশেষ করে কিছু ধর্মীয় সংগঠনকে উসকানি দিলো এবং হেফাজত নেতাকর্মীদের আরো থাকতে দিলে আরো জ্বালাও-পোড়াও হতো বলে প্রচার করা হলো। এসব ধংসাত্মক কাজের অপবাদে তাদের নৃশংসভাবে দমন করে কোমর ভেঙে দিলো এবং বিরোধী দলগুলোকেও সতর্ক করে দেয়া হলো। সংলাপের বাধ্যবাধকতা থেকেও কিছু দিনের জন্য বেরিয়ে এলো, যা আওয়ামী লীগের জন্য এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা তাদের জন্য মৃত্যুর শামিল। গত নির্বাচনের মতো, পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে অনুকূলে না আসা পর্যন্ত শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই নির্বাচনে যাবেন না। আর বিএনপিও নিশ্চয়ই তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে গিয়ে ভুলের প্নুরাবৃত্তি করবে না। জনগণের একটিই দাবি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। একদল চাইছে নির্বাচন সুষ্ঠু হোক, আরেক দল চাইছে নিজেদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে হোক। একদল জনগণের ওপর নির্ভরশীল, আরেক দল পেশিশক্তি ও বিদেশী শক্তির ওপর। এ কারণে পরিস্থিতি খুবই নাজুক। তবে অনেক মূল্য দিয়ে হলেও নিশ্চয়ই একদিন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে; এটাই এখন সবার প্রত্যাশা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads