সি রা জু র র হ মা ন
এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যা ও গুম করার ঘটনাগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীগুলোর কোনো কোনোটি জড়িত। বিএনপি নেতা এবং ভারতের পানি আগ্রাসন, বিশেষ করে টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ সংগ্রামী ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া নিয়ে সরকারের সমর্থক পত্রিকাগুলোতেও যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিচ্ছেন তাঁরাও নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন। এটাও সন্দেহাতীত প্রমাণ করে যে অন্তত একটি তথাকথিত নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী এই গুম করার ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ সেটা বিশ্বাস করতে চান না। একটা কারণ তাঁরা আওয়ামী লীগের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। বড় কারণটা এই যে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে যা যা ঘটেছে সেটা তাঁদের জানতে দেয়া হয়নি। ‘সঠিক ইতিহাসের’ নামে তাঁদের ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত ইতিহাস শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দিব।’ প্রকৃতই লাল ঘোড়া, অর্থাত্ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) হাজার হাজার কর্মী ও সমর্থককে তখন আওয়ামী লীগের ঘাতক রক্ষীবাহিনী গুম ও হত্যা করেছিল। নিহতদের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদার। রক্ষীবাহিনী সে তিন-সাড়ে তিন বছরে মোট ৪০ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল। জাসদের বর্তমান নেতা হাসানুল হক ইনুকে এককালে আমি চিনতাম ও শ্রদ্ধা করতাম। তিনি কী করে হত্যার রাজনীতির হোতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারেন ভেবে আমি সত্যি অবাক হই।
সুদূর বিদেশ থেকে অনলাইন লেখা পড়ে যতদূর বুঝতে পারি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাটি সরকারবিরোধী নয়। এ পত্রিকায় একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের বয়ান ছাপা হয়েছে। তিনি ছিনতাইয়ের ঘটনাকালে ছিনতাইকারীদের একজনের শার্টের কলার চেপে ধরেছিলেন। সে লোকটি তার আইডি কার্ড দেখিয়ে দাবি করে যে সে একটি নিরাপত্তা বাহিনীর (র্যাবের কি?) লোক এবং তারা একটা অপারেশন চালাচ্ছে। একজন ডাব-বিক্রেতাও ঘটনাটি দেখেছিলেন। এখন তাঁরা কোথায়? ইলিয়াস আলী আওয়ামী লীগের চিহ্নিত শত্রু। বৃহত্তর সিলেটে তিনি বিএনপির সংগঠনের কাজ এতদূর এগিয়ে নিয়েছিলেন যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সেখানে আওয়ামী লীগের ভোট পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভারতেরও তিনি চক্ষুশূল। টিপাইমুখে বাঁধ তৈরির প্রতিবাদে সবচাইতে সোচ্চার প্রতিবাদ তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রমাণ নষ্ট করা ছাড়া তাঁর ড্রাইভারকেও গুম করার অন্য কী কারণ থাকতে পারে?
অথবা দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক সমকাল। যতদূর বুঝতে পারি এ দুটি পত্রিকা সরকার ও আওয়ামী লীগের সমর্থক। উভয় পত্রিকাই খবর ছেপেছিল যে ইলিয়াস আলীকে জীবন্ত মুক্তিদানের জন্য দশটি শর্ত দেয়া হয়েছে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল যে মুক্তি পেলে ইলিয়াস আলীকে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করতে হবে যে বিএনপি নেত্রীর নির্দেশে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অন্তর্ধানের যে কারণটি নির্দেশ করেছিলেন) এবং ইলিয়াস আলীকে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হবে। ইলিয়াস আলীকে কে বা কারা কী কারণে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দিয়েছে সে সম্বন্ধে এখনও কি কারও সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে?
সাহারা ঘাতক বাহিনীকে লেলিয়ে দিচ্ছেন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন গত শনিবার ১৮ দলের জোটের দ্বিতীয় দফা হরতাল ঘোষণার পর বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা একা পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়; হরতাল প্রতিহত করতে তিনি আওয়ামী লীগ কর্মীদেরও মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছেন। গত সাড়ে তিন বছরে পুলিশ বাহিনীর কলেবর বিরাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের বহু সদস্যকেও এ বাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো পুলিশ বাহিনীতে পদোন্নতির একটা বড় যোগ্যতা। গত বছরের ৬ জুলাই সংসদ ভবনের চত্বরে বিএনপির প্রধান হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে অমানুষিক পেটানোর জন্য দায়ী মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনারকে গত কয়দিনে পদোন্নতি দিয়ে একটি জেলার পুলিশ সুপার করা হয়েছে।
তাছাড়া সরকারের র্যাব বাহিনী তো আছেই। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর পক্ষে কেন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়? অনেক কারণ আছে তার। একটা কারণ এই যে, এই বাহিনীগুলোকে এখন গণবিরোধী ভূমিকায় নামানো হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক অধিকার দলন এং গণতন্ত্র হত্যা কখনোই পুলিশের ভূমিকা হওয়া উচিত নয়। ব্রিটিশরা এবং পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরতন্ত্রও বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রস্পৃহাকে হত্যা করতে পারেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও গত সাড়ে তিন বছরে তাদের ফ্যাসিস্ট পদ্ধতি দিয়ে দেশের মানুষের প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। পুলিশকে অনৈতিক কাজ করতে বলা হলে তারা কখনোই সে কাজে সফল হতে পারবে না।
আরেকটা কারণ এই যে র্যাব ও পুলিশকে সরকারের প্রতিপক্ষের গণতন্ত্রের আন্দোলন নির্মূল করার কাজে এতই ব্যস্ত রাখা হচ্ছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সময় তারা পায় না। দেশের সব মানুষ এখন বিশ্বাস করে যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের খুন ও গুম করার জন্য মূলত র্যাব দায়ী। এ সরকারের সূচনা থেকেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং শেখ হাসিনার সশস্ত্র ক্যাডাররা বিরোধী দলের আন্দোলন-হরতালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পরিবর্তে এই হানাদারদের সংরক্ষণ দিতেই বেশি ব্যস্ত। ইলিয়াস আলীকে গুম করার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বনাথে প্রতিবাদ বিক্ষোভে গুলিবর্ষণে তিনজন মারা গেছে। জানা গেছে, ময়না তদন্তে দেখা গেছে যে, যে ধরনের গুলিতে তারা নিহত হয়েছে সে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশ পুলিশের কাছে নেই।
গৃহযুদ্ধের উস্কানি?
এ ব্যাপারটা কোনো কোনো ভারতীয় পত্রপত্রিকার খবর উল্লেখ করে শ্রীলঙ্কার একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের বিশ্বাসযোগ্যতাই তুলে ধরে। সে খবরে বলা হয়েছে যে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ক্রুসেডার নামে পরিচিত ১০০ জন আওয়ামী লীগ ঘাতককে ভারতের দেরাদুন মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ খবরটি দুটি কারণে বিশেষ উদ্বেগের কারণ। প্রথমত, বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ও অস্ত্র সরবরাহ করে ভারত আমাদের দেশে একটা গৃহযুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ক্রুসেডের বিশেষ একটা সংশ্লেষ আছে। ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে ইউরোপীয় রোমান ক্যাথলিক রাজারা জেরুসালেম দখল এবং মুসলিম আধিপত্য বিনষ্ট করার জন্য এই ক্রুসেড চালিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের যেসব কর্মীকে দেরাদুনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ তারা কি তাহলে বাংলাদেশে ইসলামকে ধ্বংস করার প্রশিক্ষণ পেয়ে এসেছে? এখন এ সন্দেহ করার বিশেষ কারণ ঘটেছে, বিশ্বনাথে তিন ব্যক্তিকে যে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে সে অস্ত্র নব্য ক্রুসেডাররা ভারতের কাছ থেকেই পেয়েছে। সাহারা খাতুন কি হরতাল ঠেকানোর নামে বিরোধী ১৮ দলের নেতাকর্মীদের রক্তপাতের নির্দেশই দিয়েছেন আওয়ামী লীগ কর্মীদের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ক্রুসেডারদের?
আমরা আগেও বহুবার বলেছি যে হরতাল জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু হরতাল কথাটা রাজনীতির অভিধানে ঐতিহাসিক কাল থেকেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা গোড়া থেকেই স্বীকার করেছেন, হরতাল রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের প্রথম নয়, সর্বশেষ হাতিয়ার হওয়া উচিত। অর্থাত্ অন্য সব পন্থায় গণতন্ত্র রক্ষা করা না গেলে শেষ চেষ্টা হিসেবে হরতালকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। আমরা মনে করি বাংলাদেশে এখন সে অবস্থাই এসে গেছে। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার একটা সম্প্রসারণকামী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় গণতন্ত্র ধ্বংস করে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিটির পদাবনত একটা ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে চায়। আগেই বলেছি গণতন্ত্র বাংলাদেশের মানুষের মজ্জাগত। গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের আত্মদানের ইতিহাস নতুন নয়। শেখ হাসিনার সরকার গত সাড়ে তিন বছরে বহু হাজার হত্যা ঘটিয়েছে। গুম করার ‘ঐতিহ্য‘ তারা স্থাপন করেছিল রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর কর্মীদের দিয়ে।
বিরোধী দলগুলো গোড়ায় সেটা নীরবে সহ্য করে গেছে। আস্কারা পেয়ে ঘাতকরা এখন অনেক ওপরে হাত বাড়াতে শুরু করেছে। ইলিয়াস আলী তার প্রমাণ। বিরোধী নেতারাও এখন শঙ্কিত। সমানেই শঙ্কিত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন বলেছেন তিনি নিজেও গুম হওয়ার ভয়ে শঙ্কিত। তারপরেও শাসক দলের জোটে অন্তর্ভুক্ত থাকতে কেন তাঁর গা-ঘিন ঘিন করে না ভাবছি।
দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ
দেশে এখন একটা ত্রাসের রাজত্ব চলছে। এ অবস্থায় কারোরই নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি নেই। সেজন্যই ১৮ দলের জোটের নেতারা অবশেষে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। হরতাল সেজন্যই। তাঁরা বুঝে গেছেন এখন প্রতিরোধ করা না হলে চিরস্থায়ী ক্ষমতা তাদের হাতে চলে যাবে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দেয়ার কাজ শুরু করেছে সাড়ে তিন বছর আগে থেকেই। অর্থাত্ ইলিয়াস আলীর মুক্তির দাবিতে যে হরতাল ও আন্দোলন হচ্ছে সে আন্দোলন আর সে হরতাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনও বটে। একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগের হিসাব করেনি। তারা স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বর্তমানেও তাদের মনে করতে হবে যে তারা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে নেমেছে, ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসাব করার সময় এখন নয়।
বিএনপি দ্বিতীয় দফায় রবি ও সোমবার হরতাল ডেকেছে। বিরোধী ১৮ দলের জোট বলেছে, সোমবারের মধ্যে ইলিয়াস আলীকে মুক্তি দেয়া না হলে মঙ্গলবার মে দিবস বাদ দিয়ে আবারও হরতাল ডাকবে তারা। আগামী সপ্তাহের শনিবার ৫ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারতের অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশে আসছেন। ১৮ দল বলেছে যে তাঁদের সফরের দিন তারা হরতাল করবে না। বিদেশি ভিআইপিদের প্রতি সৌজন্য স্বরূপ তাঁদের উপস্থিতিতে হরতাল না করা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। কূটনৈতিক মহলে বলাবলি হচ্ছে আগামী বছরে সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে চলতি বছরের মধ্যেই মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় এই দেশদুটি খুবই আগ্রহী।
খুবই ভালো কথা। কিন্তু ১৮ দলের জোটের নেতাদের কিছু কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ২০০৭ -২০০৮ সালে বাংলাদেশে যা কিছু ঘটেছে সে ব্যাপারে এ দুটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বীণা সিক্রি ও কালা জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টম্যাস মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনেও হোতা ছিলেন মনে করা হয়। অন্যথায় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হতেন না, বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা নিয়েও এখন প্রশ্ন দেখা দিত না। প্রণব মুখার্জি আর হিলারি ক্লিনটনের চাপে ১৮ দলের জোট যদি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির দাবি ত্যাগ করে তাহলে মারাত্মক ভুল করা হবে। একইসঙ্গে দুই বিদেশি মন্ত্রীর চাপে পড়ে ইলিয়াস আলীর মুক্তি ছাড়া হরতালের অস্ত্র ছেড়ে দিতে রাজি হলেও নেতারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন। খুব সম্ভবত সে ক্ষেত্রে জনতা তাঁদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি হবে না।
(লন্ডন, ৩০.০৪.১২)
নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ সেটা বিশ্বাস করতে চান না। একটা কারণ তাঁরা আওয়ামী লীগের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। বড় কারণটা এই যে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে যা যা ঘটেছে সেটা তাঁদের জানতে দেয়া হয়নি। ‘সঠিক ইতিহাসের’ নামে তাঁদের ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত ইতিহাস শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দিব।’ প্রকৃতই লাল ঘোড়া, অর্থাত্ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) হাজার হাজার কর্মী ও সমর্থককে তখন আওয়ামী লীগের ঘাতক রক্ষীবাহিনী গুম ও হত্যা করেছিল। নিহতদের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদার। রক্ষীবাহিনী সে তিন-সাড়ে তিন বছরে মোট ৪০ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল। জাসদের বর্তমান নেতা হাসানুল হক ইনুকে এককালে আমি চিনতাম ও শ্রদ্ধা করতাম। তিনি কী করে হত্যার রাজনীতির হোতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারেন ভেবে আমি সত্যি অবাক হই।
সুদূর বিদেশ থেকে অনলাইন লেখা পড়ে যতদূর বুঝতে পারি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাটি সরকারবিরোধী নয়। এ পত্রিকায় একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের বয়ান ছাপা হয়েছে। তিনি ছিনতাইয়ের ঘটনাকালে ছিনতাইকারীদের একজনের শার্টের কলার চেপে ধরেছিলেন। সে লোকটি তার আইডি কার্ড দেখিয়ে দাবি করে যে সে একটি নিরাপত্তা বাহিনীর (র্যাবের কি?) লোক এবং তারা একটা অপারেশন চালাচ্ছে। একজন ডাব-বিক্রেতাও ঘটনাটি দেখেছিলেন। এখন তাঁরা কোথায়? ইলিয়াস আলী আওয়ামী লীগের চিহ্নিত শত্রু। বৃহত্তর সিলেটে তিনি বিএনপির সংগঠনের কাজ এতদূর এগিয়ে নিয়েছিলেন যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সেখানে আওয়ামী লীগের ভোট পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভারতেরও তিনি চক্ষুশূল। টিপাইমুখে বাঁধ তৈরির প্রতিবাদে সবচাইতে সোচ্চার প্রতিবাদ তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রমাণ নষ্ট করা ছাড়া তাঁর ড্রাইভারকেও গুম করার অন্য কী কারণ থাকতে পারে?
অথবা দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক সমকাল। যতদূর বুঝতে পারি এ দুটি পত্রিকা সরকার ও আওয়ামী লীগের সমর্থক। উভয় পত্রিকাই খবর ছেপেছিল যে ইলিয়াস আলীকে জীবন্ত মুক্তিদানের জন্য দশটি শর্ত দেয়া হয়েছে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল যে মুক্তি পেলে ইলিয়াস আলীকে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করতে হবে যে বিএনপি নেত্রীর নির্দেশে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অন্তর্ধানের যে কারণটি নির্দেশ করেছিলেন) এবং ইলিয়াস আলীকে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হবে। ইলিয়াস আলীকে কে বা কারা কী কারণে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দিয়েছে সে সম্বন্ধে এখনও কি কারও সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে?
সাহারা ঘাতক বাহিনীকে লেলিয়ে দিচ্ছেন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন গত শনিবার ১৮ দলের জোটের দ্বিতীয় দফা হরতাল ঘোষণার পর বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা একা পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়; হরতাল প্রতিহত করতে তিনি আওয়ামী লীগ কর্মীদেরও মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছেন। গত সাড়ে তিন বছরে পুলিশ বাহিনীর কলেবর বিরাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের বহু সদস্যকেও এ বাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো পুলিশ বাহিনীতে পদোন্নতির একটা বড় যোগ্যতা। গত বছরের ৬ জুলাই সংসদ ভবনের চত্বরে বিএনপির প্রধান হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে অমানুষিক পেটানোর জন্য দায়ী মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনারকে গত কয়দিনে পদোন্নতি দিয়ে একটি জেলার পুলিশ সুপার করা হয়েছে।
তাছাড়া সরকারের র্যাব বাহিনী তো আছেই। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর পক্ষে কেন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়? অনেক কারণ আছে তার। একটা কারণ এই যে, এই বাহিনীগুলোকে এখন গণবিরোধী ভূমিকায় নামানো হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক অধিকার দলন এং গণতন্ত্র হত্যা কখনোই পুলিশের ভূমিকা হওয়া উচিত নয়। ব্রিটিশরা এবং পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরতন্ত্রও বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রস্পৃহাকে হত্যা করতে পারেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও গত সাড়ে তিন বছরে তাদের ফ্যাসিস্ট পদ্ধতি দিয়ে দেশের মানুষের প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। পুলিশকে অনৈতিক কাজ করতে বলা হলে তারা কখনোই সে কাজে সফল হতে পারবে না।
আরেকটা কারণ এই যে র্যাব ও পুলিশকে সরকারের প্রতিপক্ষের গণতন্ত্রের আন্দোলন নির্মূল করার কাজে এতই ব্যস্ত রাখা হচ্ছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সময় তারা পায় না। দেশের সব মানুষ এখন বিশ্বাস করে যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের খুন ও গুম করার জন্য মূলত র্যাব দায়ী। এ সরকারের সূচনা থেকেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং শেখ হাসিনার সশস্ত্র ক্যাডাররা বিরোধী দলের আন্দোলন-হরতালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পরিবর্তে এই হানাদারদের সংরক্ষণ দিতেই বেশি ব্যস্ত। ইলিয়াস আলীকে গুম করার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বনাথে প্রতিবাদ বিক্ষোভে গুলিবর্ষণে তিনজন মারা গেছে। জানা গেছে, ময়না তদন্তে দেখা গেছে যে, যে ধরনের গুলিতে তারা নিহত হয়েছে সে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশ পুলিশের কাছে নেই।
গৃহযুদ্ধের উস্কানি?
এ ব্যাপারটা কোনো কোনো ভারতীয় পত্রপত্রিকার খবর উল্লেখ করে শ্রীলঙ্কার একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের বিশ্বাসযোগ্যতাই তুলে ধরে। সে খবরে বলা হয়েছে যে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ক্রুসেডার নামে পরিচিত ১০০ জন আওয়ামী লীগ ঘাতককে ভারতের দেরাদুন মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ খবরটি দুটি কারণে বিশেষ উদ্বেগের কারণ। প্রথমত, বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ও অস্ত্র সরবরাহ করে ভারত আমাদের দেশে একটা গৃহযুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ক্রুসেডের বিশেষ একটা সংশ্লেষ আছে। ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে ইউরোপীয় রোমান ক্যাথলিক রাজারা জেরুসালেম দখল এবং মুসলিম আধিপত্য বিনষ্ট করার জন্য এই ক্রুসেড চালিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের যেসব কর্মীকে দেরাদুনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ তারা কি তাহলে বাংলাদেশে ইসলামকে ধ্বংস করার প্রশিক্ষণ পেয়ে এসেছে? এখন এ সন্দেহ করার বিশেষ কারণ ঘটেছে, বিশ্বনাথে তিন ব্যক্তিকে যে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে সে অস্ত্র নব্য ক্রুসেডাররা ভারতের কাছ থেকেই পেয়েছে। সাহারা খাতুন কি হরতাল ঠেকানোর নামে বিরোধী ১৮ দলের নেতাকর্মীদের রক্তপাতের নির্দেশই দিয়েছেন আওয়ামী লীগ কর্মীদের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ক্রুসেডারদের?
আমরা আগেও বহুবার বলেছি যে হরতাল জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু হরতাল কথাটা রাজনীতির অভিধানে ঐতিহাসিক কাল থেকেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা গোড়া থেকেই স্বীকার করেছেন, হরতাল রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের প্রথম নয়, সর্বশেষ হাতিয়ার হওয়া উচিত। অর্থাত্ অন্য সব পন্থায় গণতন্ত্র রক্ষা করা না গেলে শেষ চেষ্টা হিসেবে হরতালকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। আমরা মনে করি বাংলাদেশে এখন সে অবস্থাই এসে গেছে। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার একটা সম্প্রসারণকামী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় গণতন্ত্র ধ্বংস করে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিটির পদাবনত একটা ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে চায়। আগেই বলেছি গণতন্ত্র বাংলাদেশের মানুষের মজ্জাগত। গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের আত্মদানের ইতিহাস নতুন নয়। শেখ হাসিনার সরকার গত সাড়ে তিন বছরে বহু হাজার হত্যা ঘটিয়েছে। গুম করার ‘ঐতিহ্য‘ তারা স্থাপন করেছিল রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর কর্মীদের দিয়ে।
বিরোধী দলগুলো গোড়ায় সেটা নীরবে সহ্য করে গেছে। আস্কারা পেয়ে ঘাতকরা এখন অনেক ওপরে হাত বাড়াতে শুরু করেছে। ইলিয়াস আলী তার প্রমাণ। বিরোধী নেতারাও এখন শঙ্কিত। সমানেই শঙ্কিত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন বলেছেন তিনি নিজেও গুম হওয়ার ভয়ে শঙ্কিত। তারপরেও শাসক দলের জোটে অন্তর্ভুক্ত থাকতে কেন তাঁর গা-ঘিন ঘিন করে না ভাবছি।
দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ
দেশে এখন একটা ত্রাসের রাজত্ব চলছে। এ অবস্থায় কারোরই নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি নেই। সেজন্যই ১৮ দলের জোটের নেতারা অবশেষে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। হরতাল সেজন্যই। তাঁরা বুঝে গেছেন এখন প্রতিরোধ করা না হলে চিরস্থায়ী ক্ষমতা তাদের হাতে চলে যাবে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দেয়ার কাজ শুরু করেছে সাড়ে তিন বছর আগে থেকেই। অর্থাত্ ইলিয়াস আলীর মুক্তির দাবিতে যে হরতাল ও আন্দোলন হচ্ছে সে আন্দোলন আর সে হরতাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনও বটে। একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগের হিসাব করেনি। তারা স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বর্তমানেও তাদের মনে করতে হবে যে তারা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে নেমেছে, ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসাব করার সময় এখন নয়।
বিএনপি দ্বিতীয় দফায় রবি ও সোমবার হরতাল ডেকেছে। বিরোধী ১৮ দলের জোট বলেছে, সোমবারের মধ্যে ইলিয়াস আলীকে মুক্তি দেয়া না হলে মঙ্গলবার মে দিবস বাদ দিয়ে আবারও হরতাল ডাকবে তারা। আগামী সপ্তাহের শনিবার ৫ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারতের অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশে আসছেন। ১৮ দল বলেছে যে তাঁদের সফরের দিন তারা হরতাল করবে না। বিদেশি ভিআইপিদের প্রতি সৌজন্য স্বরূপ তাঁদের উপস্থিতিতে হরতাল না করা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। কূটনৈতিক মহলে বলাবলি হচ্ছে আগামী বছরে সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে চলতি বছরের মধ্যেই মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় এই দেশদুটি খুবই আগ্রহী।
খুবই ভালো কথা। কিন্তু ১৮ দলের জোটের নেতাদের কিছু কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ২০০৭ -২০০৮ সালে বাংলাদেশে যা কিছু ঘটেছে সে ব্যাপারে এ দুটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বীণা সিক্রি ও কালা জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টম্যাস মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনেও হোতা ছিলেন মনে করা হয়। অন্যথায় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হতেন না, বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা নিয়েও এখন প্রশ্ন দেখা দিত না। প্রণব মুখার্জি আর হিলারি ক্লিনটনের চাপে ১৮ দলের জোট যদি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির দাবি ত্যাগ করে তাহলে মারাত্মক ভুল করা হবে। একইসঙ্গে দুই বিদেশি মন্ত্রীর চাপে পড়ে ইলিয়াস আলীর মুক্তি ছাড়া হরতালের অস্ত্র ছেড়ে দিতে রাজি হলেও নেতারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন। খুব সম্ভবত সে ক্ষেত্রে জনতা তাঁদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি হবে না।
(লন্ডন, ৩০.০৪.১২)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন