শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

গুম খুনের আর্তি সবই আছে নেই শুধু চৌধুরী আলম



সবই আছে নেই শুধু চৌধুরী আলম


সবই আছে। সাজানো সংসার, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-পরিজন, বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী। নেই শুধু চৌধুরী আলম। প্রায় দুই বছর ধরে নিখোঁজ তিনি। বড় ছেলে আবু সাঈদ চৌধুরী হিমু বললেন, ‘যে স্থানে তাকে মেরে ফেলে দেয়া হয়েছে অন্তত সেই স্থানটি দেখিয়ে দেয়া হোক। সেখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করব বাবার জন্য।’ চৌধুরী আলমের স্ত্রী বললেন, ‘কেউ তাকে মেরে ফেললেও তো লাশ ফেরত পেতাম। আমাদেরকে লাশটি ফেরত দিত। কান্নাকাটি করে তা দাফন দিতাম।’ তিনি বলেন, চৌধুরী আলম নিখোঁজের কাহিনী সবাই জানে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখনো বাসায় আসেন মালামাল ক্রোকের জন্য।
দুই বছরেও চৌধুরী আলম ফিরে না আসায় এখন পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত যে তিনি বেঁচে নেই। গতকাল তার খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ার বাসায় গিয়ে দেখা যায় সবই আছে। নেই শুধু চৌধুরী আলম। বাড়ির নিচতলায় তার অফিস কক্ষের চেয়ারটি পড়ে আছে। ওই চেয়ারে এখন আর কেউ বসে না। চৌধুরী আলমের স্ত্রী হাসিনা চৌধুরী বলেন, তার স্বামীকে যে এই সরকার গুম করেছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার নতুন চার্জশিটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই চার্জশিটে নতুন অনেকের নামই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যে স্থানে ঘটনাটি ঘটেছে সেই স্থানটি ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে। আর ওই ওয়ার্ডেরই নির্বাচিত কমিশনার ছিলেন চৌধুরী আলম। চৌধুরী আলম বেঁচে থাকলে তার নামটিও ওই নতুন চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত হতো বলে তার বিশ্বাস। আর বেঁচে নেই বলেই তার নামটি ইচ্ছে করেই সরকার ওই চার্জশিট থেকে বাদ দিয়েছে বলে তার ধারণা। হাসিনা বলেন, চৌধুরী আলম সর্বশেষ জেল থেকে বের হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো তার বাসায় যায় মালামাল ক্রোকের জন্য। হাসিনা বলেন, চৌধুরী আলমতো কোনো ক্রিমিনাল ছিলেন না। রাজনৈতিক কারণে তার বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। তিনি জেল খেটেছেন। তিনি বলেন, তাকে কেন ধরে নেয়া হলো, কেন তিনি নিখোঁজ সেই কারণ এখনো জানতে পারেননি। একটি লোককে ধরে নিয়ে গুম করা হবে, তার কারণটিও স্ত্রী-সন্তানরা জানতে পারবেন না এটা ভাবাও যায় না। তিনি বলেন, রাস্তাঘাটে কেউ যদি তাকে মেরে ফেলতো অন্তত লাশটি তো পাওয়া যেত। কান্নাকাটি করে দাফন করতাম। সন্তানরা বাবার কবরের কাছে গিয়ে হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারত। এখন তো তা-ও পারবে না। তিনি মরে গেছেন, না বেঁচে আছেন কিভাবে বুঝবো।
চৌধুরী আলমের বড় ছেলে হিমু বলেন, ‘ভাবতেই কষ্ট হয়, আমরা বাবার কবর জিয়ারতও করতে পারবো না’। তিনি বলেন, আমাদেরকে অন্তত ওই স্থানটি দেখিয়ে দেয়া হোক, যেখানে লাশটি ফেলে দেয়া হয়েছে। ওই স্থানটিকেই আমরা বাবার কবর হিসেবে ধরে নিবো। সেখানে গিয়ে আল্লাহর কাছে হাত তুলে বাবার জন্য দোয়া করবো।
চৌধুরী আলমের এক সময়ের সহকারী সাইদুজ্জামান মাসুদ বলেন, ‘আমরা এক সময় চৌধুরী ভাইয়ের সাথে যেতাম তার বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করতে। মাঝে মধ্যেই তিনি তার বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করতে আজিমপুর কবরস্থানে যেতেন। এখন তার ছেলে-মেয়েরা বাবার কবর জিয়ারত করবে তা-ও পারবে না।’ তিনি বলেন, চৌধুরী আলম অসংখ্য মানুষের উপকার করেছেন। যারা এখনো তার জন্য কাঁদে।
২০১০ সালের ২৫ জুন রাতের ঘটনা। এক দিন পর ২৭ জুন ছিলো বিরোধী দল বিএনপির ডাকা প্রথম হরতাল। সন্ধ্যার পর তিনি পার্টি অফিস থেকে বের হন। রাতে রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে চৌধুরী আলমকে সাদা পোশাকধারী কয়েকজন লোক আটক করে। এ সময় তার প্রাইভেট কারটিও নিয়ে যায়। পরদিন সকালে কারওয়ানবাজার ওয়াসা ভবনের সামনে গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২৫ জুন বিকেলে খিলগাঁও থানার এক দারোগা তার বাসায় যায়। ওই দারোগা গিয়ে চৌধুরী আলমকে খোঁজ করলে বাসা থেকে বলা হয় তিনি দলীয় অফিসে। এরপর অন্য একটি গাড়িতে করে চৌধুরী আলম বাসা থেকে বেরিয়ে যান। রাত পৌনে ৮টায় ইন্দিরা রোডে এক আত্মীয়র বাসার কাছাকাছি ৩৮ নম্বর মেট্রো হাউজিংয়ের সামনের গলি থেকে হলুদ টেক্সিক্যাব ও সাদা মাইক্রোবাসে থাকা সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা চৌধুরী আলমকে আটক করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। তাদেরই একজন চৌধুরী আলমের গাড়ির চালককে রাস্তায় ফেলে রেখে তার প্রাইভেট কারটি চালিয়ে নিয়ে যায়। চালক অসীম রাতে বাসায় গিয়ে বিষয়টি জানায়। আত্মীয়স্বজন রাতেই ঘটনাস্থলে গেলে মেট্রো হাউজিংয়ের কেয়ারটেকার জানান, সাদা পেশাকধারী লোকজন টানা-হেঁচড়া করে এক ব্যক্তিকে নিয়ে গেছে। তাদের দেখে সাধারণ লোকজনের মতো মনে হয়নি। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২৫ জুন চৌধুরী আলমকে ধরে নেয়ার চার দিন আগে ২০ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরের কাছে ট্রাফিক সিগন্যালে সাদা পেশাকের ১০-১২ জন ব্যক্তি তার গাড়িটি আটক করে। এ সময় তার গাড়ির পেছনে মোটরসাইকেলে করে দুই ব্যক্তি কাছে আসলে চৌধুরী আলমের সন্দেহ হয় এবং তিনি ট্রাফিক সিগন্যালে দায়িত্ব পালনকারী সার্জেন্ট মোহাম্মদ আলীকে জানান। ওই সার্জেন্ট ধাওয়া করে বেলায়েত নামে একজনকে আটক করে ও অন্যজন পালিয়ে যায়। বেলায়েতকে গুলশান থানায় নেয়ার পর নিজেকে একটি বাহিনীর গোয়েন্দা সদস্য বলে দাবি করে। পরে ওই বাহিনী কর্মকর্তারা থানায় গিয়ে বেলায়েতকে নিয়ে যান বলে একটি সূত্র জানায়। একটি বাহিনীর সদস্য হওয়ায় তখন বিষয়টি নিয়ে থানায় জিডিও হয়নি।
নিখোঁজ হওয়ার পর চৌধুরী আলমের ছেলে আবু সাঈদ শেরেবাংলা নগর থানায় একটি জিডি ও পরে একটি মামলা দায়ের করেন। পরে তিনি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও দায়ের করেন। ওই আবেদনের শুনানি শেষে চৌধুরী আলমকে খুঁজে বের করতে নির্দেশ দেন আদালত। সূত্র জানায়, চৌধুরী আলমকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আটক করার পর আদালতে রিট করায় তাকে খুঁেজ বের করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব, পুলিশের আইজি ও র‌্যাবের ডিজিকে নির্দেশ দিলে প্রথম দিকে আইনশৃংখলা বাহিনী কিছুটা তৎপরতা দেখায়। কিন্তু কিছু দিন পরই পুলিশের তৎপরতা রহস্যজনকভাবে থেমে যায়। মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে বলে জানা যায়। ঘটনার পর দুই বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তদন্তকারীরা চৌধুরী আলমের বাসায় যায়নি। এমনকি, স্ত্রী-সন্তানদের কোন বক্তব্যও এখন পর্যন্ত শোনেনি। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় তদন্তকারীরা কোনরূপ যোগাযোগও রাখছে না। চৌধুরী আলমের স্ত্রী বলেন, এতেই ধারণা করা যায় চৌধুরী আলমকে গুম করা হয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads