মন্তব্য প্রতিবেদন : বেপরোয়া ফ্যাসিবাদের পুলিশি অ্যাকশন
মাহমুদুর রহমান
বুধবারের নিয়মিত মন্তব্য প্রতিবেদন গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে মহাজোট সরকারের নজিরবিহীন চণ্ডনীতির প্রেক্ষিতে এগিয়ে আনতে হলো। এ দেশে প্রতি মুহূর্তে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। পুলিশের লাঠি শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ নির্বিশেষে সব প্রতিবাদকারীর মাথায় বেধড়কভাবে বৃষ্টির মতো পড়ছে। ক্ষমতাসীনদের আচরণে পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে, তারা দেশে কিংবা বিদেশে কোনো সমালোচনারই পরোয়া করেন না।
বিরোধী দলের চেয়ারপার্সন ব্যতীত সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় বিএনপির অধিকাংশ শীর্ষ নেতাকে জেলে পোরা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে এক বিরাট অংশকে আবার কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি প্রিজনে বন্দি রাখা হয়েছে। আমি কাশিমপুর-২ জেলখানায় বন্দি থাকার সময় ওই কারাগারটি সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। ওটা নাকি দুর্ধর্ষ সব জঙ্গি, টপটেরর ও ফাঁসির আসামিদের জন্য তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রতিটি সেলে সার্বক্ষণিক সিসিটিভির ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে বন্দিরা ২৪ ঘণ্টা অর্থাত্ টয়লেট সম্পাদনের সময়ও কর্তৃপক্ষের নজরে থাকে। এমন একটি কারাগারে রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি রেখে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে হিটলারীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করছেন। ভেবে অবাক হতে হয় একটি সরকার কতখানি বর্বর হলে একজন রাজনীতিবিদকে গুম করেই ক্ষান্ত হয় না, তার অসহায় স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে অধিকতর আতঙ্কিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে গভীর রাতে নির্লজ্জভাবে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকা পালনকারী পুলিশ তার বাসস্থানে পাঠাতে পারে! বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে আওয়ামীপন্থী ও শেখ হাসিনার চাটুকার ছাড়া অন্যান্য নাগরিকের বসবাস করা ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
বিরোধী দলকে সরকারের গুমের হুমকি
মেয়াদের সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে গণতন্ত্রের শতছিন্ন নেকাবটিও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার। ক্ষমতার হোয়াইট ওয়াইন (সৈয়দ আশরাফের প্রিয় সোমরস) পানে মত্ত আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বিরোধী দলকে এবার ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দিয়েছেন। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির নেতৃবৃন্দসহ ১৮ দলীয় জোটভুক্ত ৩৩ নেতার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে সিএমএম আদালত তাদের কারাগারে প্রেরণের দিনেই এক এগারোর আগে দেশবাসীর কাছে অপরিচিত এই আওয়ামী নেতা হুঙ্কার ছেড়েছেন। মন্ত্রীর চেয়ারে বসে এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করা যায় কীনা, সেই প্রশ্ন কোনো আওয়ামী লীগারকে করে একেবারেই ফায়দা নেই। অন্যদের কথাবার্তা ধর্তব্যের মধ্যে না এনে কেবল দলটির সভানেত্রীর সংসদের ভেতরে-বাইরে বচন শুনলেই কানে আঙুল দিতে হয়।
তাই শালীনতার প্রসঙ্গ টেনে না এনে আমি বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছি। আইন প্রতিমন্ত্রীর হুমকি প্রদানের দিনেই সাহারা খাতুনের পুলিশ উচ্চ আদালতের এক রুলের জবাবে সোজা বলে দিয়েছে দেশপ্রেমিক, লড়াকু বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী তাদের হেফাজতে নেই। অর্থাত্ ইলিয়াস আলীর পরিণতিও চৌধুরী আলমের মতোই হতে চলেছে। কামরুল ইসলামের হুমকির সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই জবাব গভীরভাবে সম্পর্কিত। ঔদ্ধত্যএবং অশালীন আচরণ ও কথাবার্তার জন্য দেশবাসীর কাছে সবিশেষ পরিচিত আইন (!) প্রতিমন্ত্রী তার বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন মতের সব নাগরিকের ইলিয়াস আলীর ভাগ্য বরণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে তিনি অবশ্যই জানেন র্যাব ও বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক একমাস আগে অপহৃত ইলিয়াস আলীর ভাগ্যে এতদিনে কী ঘটেছে। আইন প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ্যে প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলকে গুমের হুমকি দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক আইনে (Rome Statute of the International Criminal Court) গুম (enforced disappearance) একটি গুরুতর অপরাধ। ২০০২ সালের ১ জুলাই এই আইনটি গৃহীত হয়েছে। তাছাড়া ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রে গুম প্রতিরোধে International Convention for the Protection of all Persons from Enforced Disappearance শিরোনামে কঠোর নীতিমালা গ্রহণ করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশে গুমের ভয়াবহতার বিষয়ে এ বছর ২০ এপ্রিল বিবিসি “Enforced disappearances haunt Bangladesh” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (Human Rights Watch)’র ২০১২ সালের রিপোর্টের নিম্নোক্ত লাইনগুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে,
Although the numbers of RAB killings has dropped following domestic and international criticism, there was a sharp increase in enforced disappearances, leading to concerns that security agencies have replaced one form of abuse with another.
(অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে র্যাব কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা হ্রাস পেলেও, গুমের ঘটনার লক্ষ্যণীয় বৃদ্ধি ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে, নিরাপত্তা সংস্থাসমূহ এক ধরনের গর্হিত আচরণকে অন্য প্রকার গুরুতর অন্যায় দ্বারা বদল করেছে।)
আইন প্রতিমন্ত্রীর সর্বশেষ হুমকি বাংলাদেশের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ রূপে এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালতসমূহে তুলে ধরা যেতে পারে। নানারকম আন্তর্জাতিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসীন মহাজোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রের নজিরবিহীন অত্যাচার, নির্যাতনের মধ্যে বসবাস করেও আমি আশাবাদী যে ইন্শাআল্লাহ্, একদিন ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারকদের মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। গুম হয়ে যাওয়া যে কোনো নাগরিকের পরিবারের সদস্য এই মামলা দায়ের করতে পারেন এবং পারবেন। এটা কখনও তামাদি হবে না। ভিন্ন মতাবলম্বীদের ভয়াবহ পরিণতির হুমকিদাতারা বিষয়টি স্মরণে রাখলে উপকৃত হবেন।
মানবাধিকার লঙ্ঘনে আদালতের দায়
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাংলাদেশে চরম নিবর্তনমূলক একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ চালু করেছিলেন। একই বছরের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে তার হত্যার সঙ্গেই সেই চরমভাবে গণধিকৃত শাসন ব্যবস্থার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। একজন স্বৈরশাসকের মতোই ১৯৭৪ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশের তাবত্ সংবাদপত্র আইন করে তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে একটি বিষয়ে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করতে হবে। তিনি আদালতের কার্যক্রমের ওপর হস্তক্ষেপ করেননি। ফলে রক্ষীবাহিনী অধ্যুষিত বাংলাদেশের জরুরি আইনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতেও উচ্চআদালত অনেক সাহসী রায় দিয়ে খানিকটা হলেও ফ্যাসিবাদের রাশ টানার চেষ্টাটা অন্তত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্য সেই সময়ের সম্মানিত বিচারপতিরা উচ্চ মানবিকতাবোধ ও বিবেকসম্পন্ন হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করাও তত্কালীন দুর্বিনীত শাসকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন।
মাজদার হোসেন মামলা নিয়ে এদেশে এক সময় প্রচুর গলাবাজি শুনেছি। সেই মামলার রায়ের আলোকে ভারতপন্থী ও আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং সেনাবাহিনী সমর্থিত মইন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ প্রশাসন থেকে পৃথকীকরণের ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণা নিয়ে সেই সময়ের সুশীল (?) পত্রিকাসমূহের প্রচারণা চোখে পড়ার মতো ছিল। তাদের প্রচারণায় মনে হচ্ছিল, আইনের শাসন কায়েম হয়ে বাংলাদেশ যেন পুরাণের ‘সত্যযুগে’ ফিরে গেছে। বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একাধিক প্রকল্পও গৃহীত হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে আজকের বিচার বিভাগ বাংলাদেশের ইতিহাসের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক মাত্রায় দলীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ। দেশের বিবেকসম্পন্ন সব বিশিষ্ট আইনজীবী একবাক্যে বলছেন, এদেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন, হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালার বালাই নেই। কেবল দলীয় বিবেচনায় গত সাড়ে তিন বছরে উচ্চআদালতে রেকর্ডসংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন। সব বেঞ্চেই সিনিয়র বিচারপতিদের সঙ্গে একজন করে সম্প্রতি নিয়াগপ্রাপ্ত জুনিয়র বিচারককে জুড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে বিভক্ত রায় দেয়ার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড করে বাংলাদেশের নাম গিনেস বুকে ওঠানোর বন্দোবস্ত সম্পন্ন প্রায়। অধিকাংশ রাজনৈতিক মামলায় পূর্বেকার রীতিনীতি (Convention) ভঙ্গ করে জুনিয়র বিচারপতিরা যাদের চাকরি এখনও ‘কনফার্মড্’ (Confirmed) হয়নি, তারাও অম্লান বদনে সিনিয়র বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে চলেছেন। কোর্ট রিপোর্টারদের কাছ থেকে শুনেছি, এসব মামলায় বিশেষ চিরকুট পকেটে নিয়েই নাকি এ নবীন বিচারপতিরা এজলাসে ওঠেন। শুনানি শেষে সিনিয়র বিচারপতির রায় প্রদান সমাপ্ত হলে সেই চিরকুট দেখে বিভক্ত রায় ঘোষণা করা হয়।
গত সপ্তাহে সিএমএম আদালতে যে কাণ্ড ঘটল, তার মাধ্যমেও বিচার বিভাগের তথাকথিত স্বাধীনতার স্বরূপ পুনর্বার উন্মোচিত হয়েছে। যে মামলায় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী, বিএনপি দলীয় এমপি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে সিএমএম কোর্ট আগেই জামিন দিয়েছে, সেই একই মামলায় বিস্ময়করভাবে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ৩৩ জন অভিযুক্তের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মধ্যরাতের টক শো’তে নিয়মিত অতিথি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা সংক্রান্ত এক মন্তব্য করায় তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত হয়ে হাইকোর্টে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। সুশীলরা (?) মোটামুটি তার পক্ষে থাকায় এখনও জেলে যেতে না হলেও নিয়মিত উচ্চআদালতে হাজির হয়ে নানা রকম অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন জনপ্রিয় এই অধ্যাপক, কলামিস্ট ও টেলিভিশন স্টার। অথচ মহাজোট সরকারের নেতা ও মন্ত্রীরা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই অহরহ এই অভিযোগ আনছেন যে, তারা নাকি ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে অসাংবিধানিক কোনো তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় আনার চক্রান্ত করছে।
মাত্র দু’দিন আগে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তো দেশে এক এগারোর চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু, সেসব মহাশক্তিধরের বিরুদ্ধে কোনো আদালত এখন পর্যন্ত সুয়োমোটো রুল জারি করেননি। আইন সব নাগরিকের জন্য সমান, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখন শুধু কল্পকথাই। এদেশে চেহারা দেখে যে আইনের প্রয়োগ হয়, সেটা ব্যক্তিগতভাবে আমি আদালত অবমাননা মামলাতেই প্রত্যক্ষ করেছি। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এমএ মতিনের ‘below contempt’ তত্ত্ব এখনও কানে বাজে। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির দায় তাই বিচার বিভাগ এড়িয়ে যেতে পারে না। বিচার বিভাগের দায়িত্বহীনতার কারণেই শ্রমিক নেতা বাকির হোসেন অন্যায়ভাবে জেলে বন্দী অবস্থায় বিনা চিকিত্সায় মৃত্যুবরণ করেছেন, সুুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এমইউ আহমেদকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে, রিমান্ডের নামে দলবাজ র্যাব-পুলিশ কর্মকর্তারা নির্যাতনের লাইসেন্স পেয়েছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শত শত বানোয়াট মামলায় একচেটিয়া জামিন নামঞ্জুর করা হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগকেও এসব কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি ভবিষ্যতে করতে হবে।
মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের ডিজিটাল কায়দা
যাই হোক, পিতা ও কন্যার শাসন পদ্ধতির তুলনায় ফিরে যাই। কন্যা বুঝতে পেরেছেন, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সব সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করা সম্ভব নয়। তিনি তাই উদাহরণ সৃষ্টি করে অন্যদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে বেশুমার পত্রিকা ও চ্যানেলের মধ্য থেকে মাত্র একটি-দুটি পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলকে বেছে নিয়েছেন। আমার দেশ বন্ধ করেছিলেন, শীর্ষ কাগজ ও চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দিয়েছেন, যমুনা টিভিকে লাইসেন্স দেননি, একুশে টিভির ওপর নানা পদ্ধতিতে আক্রমণ এখনও চলছে। আমিসহ মাত্র চারজন ভিন্ন মতাবলম্বী সম্পাদককে জেল ও রিমান্ডে নিয়েছেন। তাতেই দেখুন, কাজের কাজটি হয়ে গেছে। বিটিআরসি কর্তৃক সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার আশঙ্কায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কয়েকটি টকশো ব্যতীত প্রবলভাবে সরকারের তোষামোদ করে চলেছে। সেই টকশোগুলোতে আবার অতিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা বিনা প্রতিবাদে পালন করা হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে বাংলাভিশনের এক মজার গল্প বলি। সেই চ্যানেলে মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ফ্রন্ট লাইন নামে এক আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকেন। বাংলাভিশনের একজন প্রযোজক মাস তিনেক আগে আমাকে টেলিফোনে সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন। সঙ্গে আরও বললেন, আমার বিপরীতে থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং নব্য ব্যাংকার ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। নির্ধারিত রেকর্ডিংয়ের দিন সকালে আকস্মিকভাবে আমাকে জানানো হলো উপস্থাপক মতিউর রহমান চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ থাকায় রেকর্ডিং করা যাচ্ছে না। প্রচুর বিনয় সহকারে ভদ্রলোক আমাকে জানালেন, পরের সপ্তাহেই অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করা হবে। বলাই বাহুল্য সেই পরের সপ্তাহ আজ পর্যন্ত আসেনি। আরও তাজ্জবের বিষয় হলো ‘অসুস্থ’ উপস্থাপককে আমি কিন্তু নির্ধারিত দিনে অন্য দুই অতিথি নিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে দেখেছি।
সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে মিডিয়া বন্ধ না করেও কতটা কার্যকরভাবে সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এই মেয়াদে তার চমত্কার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রেও আদালত তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে চলেছে। টেলিভিশনে সরকারকে সমালোচনা করতে গেলেই কথা বলার সময় মাথার ওপর সুয়োমোটো রুলের ঝুলন্ত তরবারির কথা স্মরণ করে অতিথিবৃন্দকে কথা গিলে ফেলতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ড. আসিফ নজরুলের উদাহরণ খানিক আগেই দিয়েছি। একুশের উপস্থাপক অঞ্জন রায় এবং বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খানও উচ্চ আদালতে অনুরূপ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছেন। সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে নিজ, পৈতৃক ও শ্বশুরের পরিবারসহ অতিঘনিষ্ঠ, দেশের জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদও তার উপন্যাসে কী লিখবেন, সে বিষয়ে আদালত রুল জারি করেছে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদপত্রে রিপোর্টিংয়ের বিষয়েও একই স্থান থেকে নির্দেশনা এলেও সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে নির্দেশ প্রদানকারীরা শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছিলেন। অর্থাত্ তথাকথিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে চিন্তা, লেখা, কথা বলা এবং গণমাধ্যমের আর কোনো স্বাধীনতা অবশিষ্ট নেই।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনদের এমন নগ্ন ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠার কথা ছিল, সেটি এখন পর্যন্ত হয়নি। সুশীল (?) সমাজের আপসকামিতা ও জনগণের ভীরুতার পাশাপাশি বিরোধী দলের বিভ্রান্তিকর রাজনীতিও এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী। বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেই আজকের লেখায় ইতি টানব।
বিরোধী নেতৃবৃন্দের পলায়ন কৌশল
যে বানোয়াট মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারাগারে গেছেন, সেই মামলাটি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মাত্র চারদিন আগে দায়ের করা হয়েছিল। ইলিয়াস আলী গুমের প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ায় সার্বিক পরিস্থিতি তখন ক্রমেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ে তিন বছরের অপশাসনে পিষ্ট জনগণ ঊনসত্তরের মতো গণআন্দোলনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা এমন সময় বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে হিলারি ক্লিনটনের সফরকালে আন্দোলন স্থগিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। বিরোধী দলীয় নেত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দও মার্কিন সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাকে আন্দোলন সাময়িকভাবে বন্ধের পরামর্শ দেন।
বিএনপি’র তখন শাঁখের করাত অবস্থা। নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়ে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতারের আশঙ্কা। আর গ্রেফতার হলে হরতাল না দিলে ইজ্জত থাকে না। ওদিকে আবার আন্দোলন বন্ধের বিদেশি চাপ। সুতরাং, দল থেকে সিদ্ধান্ত হলো দলবেঁধে পলায়নই উত্তম। বাঘা বাঘা আইনজীবীরা ভরসা দিলেন, উচ্চ আদালত থেকে জামিন প্রাপ্তি এক-দু’দিনের ব্যাপার মাত্র। আর উচ্চ আদালত একবার জামিন দিলে কি নিম্ন আদালত সেটা কাটার সাহস দেখাবে? এসব বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও জ্ঞানী আইনজীবী এখনও বোধহয় শেখ হাসিনাকে ঠিকমত চিনে উঠতে পারেননি। রিজভী আহমেদ ব্যতীত সব নেতা পালালেন এবং বিএনপি আন্দোলনে বিরতি দিল।
হিলারি ক্লিনটন এবং প্রণব মুখার্জী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে বিরোধী দলের পুলকিত হওয়ার মতো প্রকাশ্যেই অনেক কিছু বললেন। চেয়ারপার্সনের পরামর্শদাতারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভাবতে লাগলেন, নাগালের মধ্যেই রাষ্ট্র ক্ষমতা। হাইকোর্টে কয়েকদিনের জন্য আগাম জামিন প্রাপ্তি তাদের সন্তুষ্টির পারদ আরও ওপরে তুলল। শেষ হাসি অবশ্য হাসলেন মাহবুবুল আলম হানিফ, কামরুল ইসলাম, সাহারা খাতুন, শামসুল হক টুকু এবং অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পলায়নের রাজনৈতিক কৌশল সরকারের আদালতি কৌশলের কাছে চরমভাবে মার খেল। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ঠিকই শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে ভাত খেতে হচ্ছে। উপরি হিসেবে কপালে জুটছে নানা মহলের কটাক্ষ ও নিন্দাবাদ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করার পরিণতিতে বিএনপিকে আবার গোড়া থেকে আন্দোলন শুরু করতে হবে। মাঝখান থেকে দেশ-বিদেশে প্রবল সমর্থনপ্রাপ্ত ইলিয়াস গুম ইস্যুকে পেছনে ঠেলে সামনে আনতে হচ্ছে দলীয় নেতা-কর্মীদের জামিন ও মামলা থেকে অব্যাহতির দাবি। কত নির্যাতন, কত জেল-জুলুম, কত প্রাণ বিসর্জন, কত রক্ত ক্ষয়ের বিনিময়ে ইলিয়াসকে ফিরিয়ে দেয়ার ন্যায্য আন্দোলন দানাবেঁধে ওঠার পর কেবল বিদেশিদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সেই আন্দোলনের গতি শ্লথ করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বিএনপি’র জন্য শেষ পর্যন্ত কতটা বিপর্যয়কর হয়, সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে। মামলা দায়েরের পর যদি বিএনপি নেতৃবৃন্দ দলের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান গ্রহণ করে তাদের গণগ্রেফতারের জন্য সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতেন, তাহলে ক্ষমতাসীনদের গদি নড়ে ওঠার সম্ভাবনাই অধিক ছিল বলে আমার ধারণা। হিলারি ক্লিনটনের সফরের সময় দেশের অবস্থা স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব সরকারের ছিল, বিরোধী দলের নয়। এ কথাটা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলে বিএনপির তাতে কোনো ক্ষতি হতো না। আজকের ক্ষমতাসীনরা বিএনপি জোট সরকারের আমলে তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েলের সফরের দিনে হরতাল পালন করেছিল। তাতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে একতরফা মার্কিন সমর্থন পেতে আওয়ামী লীগের কোনো অসুবিধা হয়নি। যে বিদেশিরা আন্দোলন স্থগিত করার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে চাপ দিয়েছিলেন, তারা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তির জন্য পর্দার আড়াল থেকে কোনোরকম কার্যকর ভূমিকা রাখছেন কীনা, তা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি বারিধারার দূতাবাসসমূহে ধর্না দেয়ার চেয়ে জনগণ ও আল্লাহ্র শক্তির ওপর নির্ভর করতেই পছন্দ করি।
সর্বব্যাপী হতাশার মধ্যেও আমি দীর্ঘ মেয়াদে চূড়ান্ত বিজয়ের আশা ছাড়তে রাজি নই। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, সব স্বৈরশাসককে তার অপকর্মের জন্য এক সময় মূল্য দিতে হয়। তারা শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই নিক্ষিপ্ত হন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবারের ট্র্যাজেডির জন্য দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে জনসমক্ষে অবিরত অশ্রুপাত করে চলেছেন। সেই ট্র্যাজেডির সঙ্গে সম্পৃক্তদের ফাঁসি দেয়ার পরও তার অশ্রুর বন্যা শেষ হয়নি। এই সেদিনও তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩১তম বার্ষিকীতে নিহত পিতা-মাতা, ভাইদের কথা স্মরণ করে তাকে কাঁদতে দেখলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যেও অনেককেই চোখ মুছতে দেখা গেল। অথচ এই একই শেখ হাসিনা সাগর-রুনির হত্যা এবং ইলিয়াস আলীর গুম নিয়ে যখন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, তখন রবাট লুই স্টিভেনসনের লেখা কালজয়ী ইংরেজি উপন্যাস ড. জেকিল অ্যান্ড মি. হাইড (Dr. Jekyll and Mr. Hyde)-এর কথা স্মরণে এসে যায়। তিনি সাগর-রুনির এতিম পুত্র, ছয় বছরের মেঘ এবং ইলিয়াসের সাত বছরের কন্যা সাইয়ারা নাওয়ারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে চান, অথচ খুনিকে খোঁজার ব্যাপারে তার কোনো উত্সাহ নেই কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি ইলিয়াসকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো নির্দেশও তার কাছ থেকে আসে না। উল্টো ইলিয়াসের পরিবারকেই এখন মধ্যরাতে পুলিশ পাঠিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারের বিশেষ খুনেবাহিনী একের পর এক গুম করবে, আর দয়াশীল প্রধানমন্ত্রী এতিমদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে থাকবেন, এমন বীভত্স রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমরা বসবাস করতে চাই না। মাত্র দু’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী দম্ভোক্তি করেছেন, বিরোধী দলকে কীভাবে সোজা করতে হয় আমি জানি। তিনি আরও বলেছেন, তার সহ্য করার ক্ষমতাকে যেন দুর্বলতা মনে করা না হয়। বিগত সাড়ে তিন বছরের গুম, হত্যা, নির্যাতনের শাসনকাল যদি সহ্যের নমুনা হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশকে কি মৃত্যুপুরীতে পরিণত করার আয়োজন চলছে? আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় সন্ত্রাসী হামলা কি প্রধানমন্ত্রীর হুমকির বাস্তবায়ন? শেকসিপয়রের নাটক রিচার্ড-থ্রি (Richard-III) থেকে একটি ক্ষুদ্র অথচ অসাধারণ বাক্য উদ্ধৃত করে দেশের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে হৃদয়ভরা বেদনা নিয়ে আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন সমাপ্ত করছি। শেকসিপয়র লিখেছেন— “Bloody thou art, bloody will be thy end.”
(যত তুমি রক্ত ঝরাবে
অন্ত তোমার ততই রক্তাক্ত হবে)।
বিরোধী দলের চেয়ারপার্সন ব্যতীত সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় বিএনপির অধিকাংশ শীর্ষ নেতাকে জেলে পোরা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে এক বিরাট অংশকে আবার কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি প্রিজনে বন্দি রাখা হয়েছে। আমি কাশিমপুর-২ জেলখানায় বন্দি থাকার সময় ওই কারাগারটি সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। ওটা নাকি দুর্ধর্ষ সব জঙ্গি, টপটেরর ও ফাঁসির আসামিদের জন্য তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রতিটি সেলে সার্বক্ষণিক সিসিটিভির ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে বন্দিরা ২৪ ঘণ্টা অর্থাত্ টয়লেট সম্পাদনের সময়ও কর্তৃপক্ষের নজরে থাকে। এমন একটি কারাগারে রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি রেখে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে হিটলারীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করছেন। ভেবে অবাক হতে হয় একটি সরকার কতখানি বর্বর হলে একজন রাজনীতিবিদকে গুম করেই ক্ষান্ত হয় না, তার অসহায় স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে অধিকতর আতঙ্কিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে গভীর রাতে নির্লজ্জভাবে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকা পালনকারী পুলিশ তার বাসস্থানে পাঠাতে পারে! বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে আওয়ামীপন্থী ও শেখ হাসিনার চাটুকার ছাড়া অন্যান্য নাগরিকের বসবাস করা ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
বিরোধী দলকে সরকারের গুমের হুমকি
মেয়াদের সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে গণতন্ত্রের শতছিন্ন নেকাবটিও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার। ক্ষমতার হোয়াইট ওয়াইন (সৈয়দ আশরাফের প্রিয় সোমরস) পানে মত্ত আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বিরোধী দলকে এবার ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দিয়েছেন। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির নেতৃবৃন্দসহ ১৮ দলীয় জোটভুক্ত ৩৩ নেতার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে সিএমএম আদালত তাদের কারাগারে প্রেরণের দিনেই এক এগারোর আগে দেশবাসীর কাছে অপরিচিত এই আওয়ামী নেতা হুঙ্কার ছেড়েছেন। মন্ত্রীর চেয়ারে বসে এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করা যায় কীনা, সেই প্রশ্ন কোনো আওয়ামী লীগারকে করে একেবারেই ফায়দা নেই। অন্যদের কথাবার্তা ধর্তব্যের মধ্যে না এনে কেবল দলটির সভানেত্রীর সংসদের ভেতরে-বাইরে বচন শুনলেই কানে আঙুল দিতে হয়।
তাই শালীনতার প্রসঙ্গ টেনে না এনে আমি বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছি। আইন প্রতিমন্ত্রীর হুমকি প্রদানের দিনেই সাহারা খাতুনের পুলিশ উচ্চ আদালতের এক রুলের জবাবে সোজা বলে দিয়েছে দেশপ্রেমিক, লড়াকু বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী তাদের হেফাজতে নেই। অর্থাত্ ইলিয়াস আলীর পরিণতিও চৌধুরী আলমের মতোই হতে চলেছে। কামরুল ইসলামের হুমকির সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই জবাব গভীরভাবে সম্পর্কিত। ঔদ্ধত্যএবং অশালীন আচরণ ও কথাবার্তার জন্য দেশবাসীর কাছে সবিশেষ পরিচিত আইন (!) প্রতিমন্ত্রী তার বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন মতের সব নাগরিকের ইলিয়াস আলীর ভাগ্য বরণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে তিনি অবশ্যই জানেন র্যাব ও বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক একমাস আগে অপহৃত ইলিয়াস আলীর ভাগ্যে এতদিনে কী ঘটেছে। আইন প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ্যে প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলকে গুমের হুমকি দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক আইনে (Rome Statute of the International Criminal Court) গুম (enforced disappearance) একটি গুরুতর অপরাধ। ২০০২ সালের ১ জুলাই এই আইনটি গৃহীত হয়েছে। তাছাড়া ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রে গুম প্রতিরোধে International Convention for the Protection of all Persons from Enforced Disappearance শিরোনামে কঠোর নীতিমালা গ্রহণ করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশে গুমের ভয়াবহতার বিষয়ে এ বছর ২০ এপ্রিল বিবিসি “Enforced disappearances haunt Bangladesh” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (Human Rights Watch)’র ২০১২ সালের রিপোর্টের নিম্নোক্ত লাইনগুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে,
Although the numbers of RAB killings has dropped following domestic and international criticism, there was a sharp increase in enforced disappearances, leading to concerns that security agencies have replaced one form of abuse with another.
(অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে র্যাব কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা হ্রাস পেলেও, গুমের ঘটনার লক্ষ্যণীয় বৃদ্ধি ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে, নিরাপত্তা সংস্থাসমূহ এক ধরনের গর্হিত আচরণকে অন্য প্রকার গুরুতর অন্যায় দ্বারা বদল করেছে।)
আইন প্রতিমন্ত্রীর সর্বশেষ হুমকি বাংলাদেশের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ রূপে এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালতসমূহে তুলে ধরা যেতে পারে। নানারকম আন্তর্জাতিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসীন মহাজোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রের নজিরবিহীন অত্যাচার, নির্যাতনের মধ্যে বসবাস করেও আমি আশাবাদী যে ইন্শাআল্লাহ্, একদিন ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারকদের মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। গুম হয়ে যাওয়া যে কোনো নাগরিকের পরিবারের সদস্য এই মামলা দায়ের করতে পারেন এবং পারবেন। এটা কখনও তামাদি হবে না। ভিন্ন মতাবলম্বীদের ভয়াবহ পরিণতির হুমকিদাতারা বিষয়টি স্মরণে রাখলে উপকৃত হবেন।
মানবাধিকার লঙ্ঘনে আদালতের দায়
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাংলাদেশে চরম নিবর্তনমূলক একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ চালু করেছিলেন। একই বছরের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে তার হত্যার সঙ্গেই সেই চরমভাবে গণধিকৃত শাসন ব্যবস্থার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। একজন স্বৈরশাসকের মতোই ১৯৭৪ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশের তাবত্ সংবাদপত্র আইন করে তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে একটি বিষয়ে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করতে হবে। তিনি আদালতের কার্যক্রমের ওপর হস্তক্ষেপ করেননি। ফলে রক্ষীবাহিনী অধ্যুষিত বাংলাদেশের জরুরি আইনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতেও উচ্চআদালত অনেক সাহসী রায় দিয়ে খানিকটা হলেও ফ্যাসিবাদের রাশ টানার চেষ্টাটা অন্তত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্য সেই সময়ের সম্মানিত বিচারপতিরা উচ্চ মানবিকতাবোধ ও বিবেকসম্পন্ন হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করাও তত্কালীন দুর্বিনীত শাসকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন।
মাজদার হোসেন মামলা নিয়ে এদেশে এক সময় প্রচুর গলাবাজি শুনেছি। সেই মামলার রায়ের আলোকে ভারতপন্থী ও আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং সেনাবাহিনী সমর্থিত মইন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ প্রশাসন থেকে পৃথকীকরণের ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণা নিয়ে সেই সময়ের সুশীল (?) পত্রিকাসমূহের প্রচারণা চোখে পড়ার মতো ছিল। তাদের প্রচারণায় মনে হচ্ছিল, আইনের শাসন কায়েম হয়ে বাংলাদেশ যেন পুরাণের ‘সত্যযুগে’ ফিরে গেছে। বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একাধিক প্রকল্পও গৃহীত হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে আজকের বিচার বিভাগ বাংলাদেশের ইতিহাসের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক মাত্রায় দলীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ। দেশের বিবেকসম্পন্ন সব বিশিষ্ট আইনজীবী একবাক্যে বলছেন, এদেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন, হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালার বালাই নেই। কেবল দলীয় বিবেচনায় গত সাড়ে তিন বছরে উচ্চআদালতে রেকর্ডসংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন। সব বেঞ্চেই সিনিয়র বিচারপতিদের সঙ্গে একজন করে সম্প্রতি নিয়াগপ্রাপ্ত জুনিয়র বিচারককে জুড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে বিভক্ত রায় দেয়ার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড করে বাংলাদেশের নাম গিনেস বুকে ওঠানোর বন্দোবস্ত সম্পন্ন প্রায়। অধিকাংশ রাজনৈতিক মামলায় পূর্বেকার রীতিনীতি (Convention) ভঙ্গ করে জুনিয়র বিচারপতিরা যাদের চাকরি এখনও ‘কনফার্মড্’ (Confirmed) হয়নি, তারাও অম্লান বদনে সিনিয়র বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে চলেছেন। কোর্ট রিপোর্টারদের কাছ থেকে শুনেছি, এসব মামলায় বিশেষ চিরকুট পকেটে নিয়েই নাকি এ নবীন বিচারপতিরা এজলাসে ওঠেন। শুনানি শেষে সিনিয়র বিচারপতির রায় প্রদান সমাপ্ত হলে সেই চিরকুট দেখে বিভক্ত রায় ঘোষণা করা হয়।
গত সপ্তাহে সিএমএম আদালতে যে কাণ্ড ঘটল, তার মাধ্যমেও বিচার বিভাগের তথাকথিত স্বাধীনতার স্বরূপ পুনর্বার উন্মোচিত হয়েছে। যে মামলায় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী, বিএনপি দলীয় এমপি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে সিএমএম কোর্ট আগেই জামিন দিয়েছে, সেই একই মামলায় বিস্ময়করভাবে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ৩৩ জন অভিযুক্তের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মধ্যরাতের টক শো’তে নিয়মিত অতিথি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা সংক্রান্ত এক মন্তব্য করায় তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত হয়ে হাইকোর্টে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। সুশীলরা (?) মোটামুটি তার পক্ষে থাকায় এখনও জেলে যেতে না হলেও নিয়মিত উচ্চআদালতে হাজির হয়ে নানা রকম অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন জনপ্রিয় এই অধ্যাপক, কলামিস্ট ও টেলিভিশন স্টার। অথচ মহাজোট সরকারের নেতা ও মন্ত্রীরা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই অহরহ এই অভিযোগ আনছেন যে, তারা নাকি ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে অসাংবিধানিক কোনো তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় আনার চক্রান্ত করছে।
মাত্র দু’দিন আগে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তো দেশে এক এগারোর চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু, সেসব মহাশক্তিধরের বিরুদ্ধে কোনো আদালত এখন পর্যন্ত সুয়োমোটো রুল জারি করেননি। আইন সব নাগরিকের জন্য সমান, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখন শুধু কল্পকথাই। এদেশে চেহারা দেখে যে আইনের প্রয়োগ হয়, সেটা ব্যক্তিগতভাবে আমি আদালত অবমাননা মামলাতেই প্রত্যক্ষ করেছি। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এমএ মতিনের ‘below contempt’ তত্ত্ব এখনও কানে বাজে। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির দায় তাই বিচার বিভাগ এড়িয়ে যেতে পারে না। বিচার বিভাগের দায়িত্বহীনতার কারণেই শ্রমিক নেতা বাকির হোসেন অন্যায়ভাবে জেলে বন্দী অবস্থায় বিনা চিকিত্সায় মৃত্যুবরণ করেছেন, সুুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এমইউ আহমেদকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে, রিমান্ডের নামে দলবাজ র্যাব-পুলিশ কর্মকর্তারা নির্যাতনের লাইসেন্স পেয়েছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শত শত বানোয়াট মামলায় একচেটিয়া জামিন নামঞ্জুর করা হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগকেও এসব কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি ভবিষ্যতে করতে হবে।
মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের ডিজিটাল কায়দা
যাই হোক, পিতা ও কন্যার শাসন পদ্ধতির তুলনায় ফিরে যাই। কন্যা বুঝতে পেরেছেন, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সব সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করা সম্ভব নয়। তিনি তাই উদাহরণ সৃষ্টি করে অন্যদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে বেশুমার পত্রিকা ও চ্যানেলের মধ্য থেকে মাত্র একটি-দুটি পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলকে বেছে নিয়েছেন। আমার দেশ বন্ধ করেছিলেন, শীর্ষ কাগজ ও চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দিয়েছেন, যমুনা টিভিকে লাইসেন্স দেননি, একুশে টিভির ওপর নানা পদ্ধতিতে আক্রমণ এখনও চলছে। আমিসহ মাত্র চারজন ভিন্ন মতাবলম্বী সম্পাদককে জেল ও রিমান্ডে নিয়েছেন। তাতেই দেখুন, কাজের কাজটি হয়ে গেছে। বিটিআরসি কর্তৃক সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার আশঙ্কায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কয়েকটি টকশো ব্যতীত প্রবলভাবে সরকারের তোষামোদ করে চলেছে। সেই টকশোগুলোতে আবার অতিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা বিনা প্রতিবাদে পালন করা হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে বাংলাভিশনের এক মজার গল্প বলি। সেই চ্যানেলে মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ফ্রন্ট লাইন নামে এক আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকেন। বাংলাভিশনের একজন প্রযোজক মাস তিনেক আগে আমাকে টেলিফোনে সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন। সঙ্গে আরও বললেন, আমার বিপরীতে থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং নব্য ব্যাংকার ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। নির্ধারিত রেকর্ডিংয়ের দিন সকালে আকস্মিকভাবে আমাকে জানানো হলো উপস্থাপক মতিউর রহমান চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ থাকায় রেকর্ডিং করা যাচ্ছে না। প্রচুর বিনয় সহকারে ভদ্রলোক আমাকে জানালেন, পরের সপ্তাহেই অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করা হবে। বলাই বাহুল্য সেই পরের সপ্তাহ আজ পর্যন্ত আসেনি। আরও তাজ্জবের বিষয় হলো ‘অসুস্থ’ উপস্থাপককে আমি কিন্তু নির্ধারিত দিনে অন্য দুই অতিথি নিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে দেখেছি।
সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে মিডিয়া বন্ধ না করেও কতটা কার্যকরভাবে সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এই মেয়াদে তার চমত্কার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রেও আদালত তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে চলেছে। টেলিভিশনে সরকারকে সমালোচনা করতে গেলেই কথা বলার সময় মাথার ওপর সুয়োমোটো রুলের ঝুলন্ত তরবারির কথা স্মরণ করে অতিথিবৃন্দকে কথা গিলে ফেলতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ড. আসিফ নজরুলের উদাহরণ খানিক আগেই দিয়েছি। একুশের উপস্থাপক অঞ্জন রায় এবং বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খানও উচ্চ আদালতে অনুরূপ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছেন। সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে নিজ, পৈতৃক ও শ্বশুরের পরিবারসহ অতিঘনিষ্ঠ, দেশের জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদও তার উপন্যাসে কী লিখবেন, সে বিষয়ে আদালত রুল জারি করেছে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদপত্রে রিপোর্টিংয়ের বিষয়েও একই স্থান থেকে নির্দেশনা এলেও সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে নির্দেশ প্রদানকারীরা শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছিলেন। অর্থাত্ তথাকথিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে চিন্তা, লেখা, কথা বলা এবং গণমাধ্যমের আর কোনো স্বাধীনতা অবশিষ্ট নেই।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনদের এমন নগ্ন ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠার কথা ছিল, সেটি এখন পর্যন্ত হয়নি। সুশীল (?) সমাজের আপসকামিতা ও জনগণের ভীরুতার পাশাপাশি বিরোধী দলের বিভ্রান্তিকর রাজনীতিও এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী। বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেই আজকের লেখায় ইতি টানব।
বিরোধী নেতৃবৃন্দের পলায়ন কৌশল
যে বানোয়াট মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারাগারে গেছেন, সেই মামলাটি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মাত্র চারদিন আগে দায়ের করা হয়েছিল। ইলিয়াস আলী গুমের প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ায় সার্বিক পরিস্থিতি তখন ক্রমেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ে তিন বছরের অপশাসনে পিষ্ট জনগণ ঊনসত্তরের মতো গণআন্দোলনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা এমন সময় বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে হিলারি ক্লিনটনের সফরকালে আন্দোলন স্থগিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। বিরোধী দলীয় নেত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দও মার্কিন সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাকে আন্দোলন সাময়িকভাবে বন্ধের পরামর্শ দেন।
বিএনপি’র তখন শাঁখের করাত অবস্থা। নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়ে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতারের আশঙ্কা। আর গ্রেফতার হলে হরতাল না দিলে ইজ্জত থাকে না। ওদিকে আবার আন্দোলন বন্ধের বিদেশি চাপ। সুতরাং, দল থেকে সিদ্ধান্ত হলো দলবেঁধে পলায়নই উত্তম। বাঘা বাঘা আইনজীবীরা ভরসা দিলেন, উচ্চ আদালত থেকে জামিন প্রাপ্তি এক-দু’দিনের ব্যাপার মাত্র। আর উচ্চ আদালত একবার জামিন দিলে কি নিম্ন আদালত সেটা কাটার সাহস দেখাবে? এসব বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও জ্ঞানী আইনজীবী এখনও বোধহয় শেখ হাসিনাকে ঠিকমত চিনে উঠতে পারেননি। রিজভী আহমেদ ব্যতীত সব নেতা পালালেন এবং বিএনপি আন্দোলনে বিরতি দিল।
হিলারি ক্লিনটন এবং প্রণব মুখার্জী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে বিরোধী দলের পুলকিত হওয়ার মতো প্রকাশ্যেই অনেক কিছু বললেন। চেয়ারপার্সনের পরামর্শদাতারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভাবতে লাগলেন, নাগালের মধ্যেই রাষ্ট্র ক্ষমতা। হাইকোর্টে কয়েকদিনের জন্য আগাম জামিন প্রাপ্তি তাদের সন্তুষ্টির পারদ আরও ওপরে তুলল। শেষ হাসি অবশ্য হাসলেন মাহবুবুল আলম হানিফ, কামরুল ইসলাম, সাহারা খাতুন, শামসুল হক টুকু এবং অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পলায়নের রাজনৈতিক কৌশল সরকারের আদালতি কৌশলের কাছে চরমভাবে মার খেল। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ঠিকই শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে ভাত খেতে হচ্ছে। উপরি হিসেবে কপালে জুটছে নানা মহলের কটাক্ষ ও নিন্দাবাদ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করার পরিণতিতে বিএনপিকে আবার গোড়া থেকে আন্দোলন শুরু করতে হবে। মাঝখান থেকে দেশ-বিদেশে প্রবল সমর্থনপ্রাপ্ত ইলিয়াস গুম ইস্যুকে পেছনে ঠেলে সামনে আনতে হচ্ছে দলীয় নেতা-কর্মীদের জামিন ও মামলা থেকে অব্যাহতির দাবি। কত নির্যাতন, কত জেল-জুলুম, কত প্রাণ বিসর্জন, কত রক্ত ক্ষয়ের বিনিময়ে ইলিয়াসকে ফিরিয়ে দেয়ার ন্যায্য আন্দোলন দানাবেঁধে ওঠার পর কেবল বিদেশিদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সেই আন্দোলনের গতি শ্লথ করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বিএনপি’র জন্য শেষ পর্যন্ত কতটা বিপর্যয়কর হয়, সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে। মামলা দায়েরের পর যদি বিএনপি নেতৃবৃন্দ দলের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান গ্রহণ করে তাদের গণগ্রেফতারের জন্য সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতেন, তাহলে ক্ষমতাসীনদের গদি নড়ে ওঠার সম্ভাবনাই অধিক ছিল বলে আমার ধারণা। হিলারি ক্লিনটনের সফরের সময় দেশের অবস্থা স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব সরকারের ছিল, বিরোধী দলের নয়। এ কথাটা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলে বিএনপির তাতে কোনো ক্ষতি হতো না। আজকের ক্ষমতাসীনরা বিএনপি জোট সরকারের আমলে তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েলের সফরের দিনে হরতাল পালন করেছিল। তাতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে একতরফা মার্কিন সমর্থন পেতে আওয়ামী লীগের কোনো অসুবিধা হয়নি। যে বিদেশিরা আন্দোলন স্থগিত করার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে চাপ দিয়েছিলেন, তারা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তির জন্য পর্দার আড়াল থেকে কোনোরকম কার্যকর ভূমিকা রাখছেন কীনা, তা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি বারিধারার দূতাবাসসমূহে ধর্না দেয়ার চেয়ে জনগণ ও আল্লাহ্র শক্তির ওপর নির্ভর করতেই পছন্দ করি।
সর্বব্যাপী হতাশার মধ্যেও আমি দীর্ঘ মেয়াদে চূড়ান্ত বিজয়ের আশা ছাড়তে রাজি নই। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, সব স্বৈরশাসককে তার অপকর্মের জন্য এক সময় মূল্য দিতে হয়। তারা শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই নিক্ষিপ্ত হন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবারের ট্র্যাজেডির জন্য দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে জনসমক্ষে অবিরত অশ্রুপাত করে চলেছেন। সেই ট্র্যাজেডির সঙ্গে সম্পৃক্তদের ফাঁসি দেয়ার পরও তার অশ্রুর বন্যা শেষ হয়নি। এই সেদিনও তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩১তম বার্ষিকীতে নিহত পিতা-মাতা, ভাইদের কথা স্মরণ করে তাকে কাঁদতে দেখলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যেও অনেককেই চোখ মুছতে দেখা গেল। অথচ এই একই শেখ হাসিনা সাগর-রুনির হত্যা এবং ইলিয়াস আলীর গুম নিয়ে যখন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, তখন রবাট লুই স্টিভেনসনের লেখা কালজয়ী ইংরেজি উপন্যাস ড. জেকিল অ্যান্ড মি. হাইড (Dr. Jekyll and Mr. Hyde)-এর কথা স্মরণে এসে যায়। তিনি সাগর-রুনির এতিম পুত্র, ছয় বছরের মেঘ এবং ইলিয়াসের সাত বছরের কন্যা সাইয়ারা নাওয়ারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে চান, অথচ খুনিকে খোঁজার ব্যাপারে তার কোনো উত্সাহ নেই কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি ইলিয়াসকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো নির্দেশও তার কাছ থেকে আসে না। উল্টো ইলিয়াসের পরিবারকেই এখন মধ্যরাতে পুলিশ পাঠিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারের বিশেষ খুনেবাহিনী একের পর এক গুম করবে, আর দয়াশীল প্রধানমন্ত্রী এতিমদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে থাকবেন, এমন বীভত্স রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমরা বসবাস করতে চাই না। মাত্র দু’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী দম্ভোক্তি করেছেন, বিরোধী দলকে কীভাবে সোজা করতে হয় আমি জানি। তিনি আরও বলেছেন, তার সহ্য করার ক্ষমতাকে যেন দুর্বলতা মনে করা না হয়। বিগত সাড়ে তিন বছরের গুম, হত্যা, নির্যাতনের শাসনকাল যদি সহ্যের নমুনা হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশকে কি মৃত্যুপুরীতে পরিণত করার আয়োজন চলছে? আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় সন্ত্রাসী হামলা কি প্রধানমন্ত্রীর হুমকির বাস্তবায়ন? শেকসিপয়রের নাটক রিচার্ড-থ্রি (Richard-III) থেকে একটি ক্ষুদ্র অথচ অসাধারণ বাক্য উদ্ধৃত করে দেশের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে হৃদয়ভরা বেদনা নিয়ে আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন সমাপ্ত করছি। শেকসিপয়র লিখেছেন— “Bloody thou art, bloody will be thy end.”
(যত তুমি রক্ত ঝরাবে
অন্ত তোমার ততই রক্তাক্ত হবে)।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন