বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সরকার



হারুন জামিল ও জাকির হোসেন লিটন
ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সরকার। সুশাসনের অভাব, ভঙ্গুর মানবাধিকার পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়ন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে নির্বিচারে গুম-খুনের সুযোগ দেয়ার অভিযোগ সরকারকে দিশেহারা করে ফেলছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতির বিস্তার, বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব খাটানো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করা, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অতীতের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়াসহ আরো নানা অভিযোগ। এসব কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে সরকার ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বমিডিয়ায় বাংলাদেশের ক্রমাবনতিশীল চিত্র সবিস্তার প্রকাশ পাচ্ছে। এসব ঘটনায় সরকার নিরুদ্বিগ্ন ভাব প্রকাশ করলেও বাস্তবতা ভিন্ন বলে জানা গেছে। সরকার এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বিশ্বের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আমেরিকার প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস, অ্যাসোসিয়েটস প্রেস অব আমেরিকা, দি টেলিগ্রাফ, আলজাজিরা, সৌদি গেজেটসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে মাসাধিক কাল ধরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে তা দেশের ইমেজকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করছে। এসব গণমাধ্যমে সরকারের কাজ ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে। রিপোর্টে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন, আইনের শাসনের দুর্বলতা, নির্বিচারে মানুষ খুন, দুর্নীতির সবিস্তার তুলে ধরা হয়েছে। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের টাকার বস্তা নিয়ে এপিএস আটক হওয়া ও ইলিয়াস আলীসহ কয়েকজনের গুমের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। এসবের রেশ কাটতে না কাটতেই বুধবার ২৭টি দেশের ঐক্যবদ্ধ সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইইউ সাফ জানিয়েছে, খুন-গুম-দুর্নীতির বিস্তার বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতায় প্রভাব ফেলবে। সংস্থাটি বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া ও গার্মেন্টশ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাে র ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণপত্র জমা দিয়েছে। সরকার দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করলেও এ ব্যাপারে অকাট্য কোনো প্রমাণ এখনো উপস্থাপন করতে পারেনি। এ অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি না পেলে তা সরকারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। 
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে বিরোধী দলের রাজনীতি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি ‘কারো সাথে শত্রুতা নয়Ñ সকলের সাথে বন্ধুত্ব’ থেকে সরে এসে সরকার প্রতিবেশী একটি দেশের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়তে শুরু করে। বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো এতে ুব্ধ হলেও সরকার তা আমলে নেয়নি। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্ব জোরদারের যে নীতি এতকাল অনুসৃত হয়ে আসছিল তা-ও উপেক্ষিত হতে থাকে। তিন দশক ধরে বাংলাদেশে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও বদলে যেতে থাকে। বিষয়টি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেললেও সরকার নির্বিকার ভূমিকা নেয়। 
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। সরকারের বিভিন্ন কর্মকাে উন্নয়ন সহযোগীদের অসন্তোষ দেশের ইমেজ সঙ্কটকে প্রকটভাবে ফুটিয়ে তুলছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে ভীতিকর রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরেছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে ওই সব দেশের নাগরিকদের সাবধানে চলাচল করা এবং রাতে প্রয়োজন ছাড়া চলাফেরা না করার পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন বিদেশী কূটনীতিক খুন হলেও সরকার দীর্ঘ সময়েও ঘটনার কোনো কিনারা করতে পারেনি। এখন সরকারের ভেতরকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, তা পরিস্থিতির ভয়াবহতাকেই ফুটিয়ে তুলেছে। 
এ দিকে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কথাবার্তা ও উগ্র আচরণ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 
বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন : দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তত্ত্বাধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান নয়া দিগন্তকে বলেছেন, আমরা আগেও সঙ্ঘাতে ছিলাম এখনো আছি এবং মনে হচ্ছে ভবিষ্যতেও থাকব। আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা যা বলছে তার কোনো প্রভাবও সরকারের আচরণে দেখা যাচ্ছে না। এভাবে আর চলতে পারে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথই হচ্ছে সংলাপ। সে জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে দুই পক্ষকেই সংলাপে বসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারপক্ষের দায়িত্ব অনেক বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে দেশ। এভাবে চলতে থাকলে দেশের অথনীতি আরো বিপর্যস্ত হবে। অন্য কোনো শক্তি এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতাকে গুম করে আবার ওই দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যেভাবে চার্জশিট দেয়া হলো তাতে মনে হচ্ছে সরকার বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। কিন্তু তাদের বোঝা উচিত এত দিনে পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। এখন বিএনপি শুধু একা নয়, তাদের সাথে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ আছে। তাই সরকার এসব করে চরম ভুল করছে। এভাবে দেশকে এক অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথই হচ্ছে সংলাপের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল। সেটা নতুনভাবে অন্তর্বর্তী সরকার নামেও হতে পারে। কারণ নির্বাচিত সরকারের অধীনে হয়তো কোনো কোনো দল নির্বাচনে যেতে পারে কিন্তু বড় দলগুলো নির্বাচনে যাবে না। এতে গণতন্ত্র আরো মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের সুশীলসমাজ ও মিডিয়ার আরো সক্রিয় ভূমিকা দরকার। কারণ দমন-পীড়নের রাজনীতি কেবল জঙ্গলেই হতে পারে সভ্য কোনো দেশে নয়। 
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার অনেকটা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এ কোন অবস্থার দিকে যাচ্ছে দেশ তা আমরাও বুঝি না। তবে এতটুকু বুঝি বর্তমানে যা চলছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, রজনৈতিক গুম, হত্যা, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এসব চরম অরাজকতার সমাধান দরকার। এসবের কেন্দ্রবিন্দুই হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার সমাধানও তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আর এভাবে দমন-পীড়নের মাধ্যমে নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমস্যার সমাধান আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই করতে হবে। সেটাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনা বা সংলাপ করে সমাধানে আসতে হবে তার কোনো বিকল্প নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads