বুধবার, ২৩ মে, ২০১২

সরকারের দুর্নীতির চর্চা দেশে বিদেশে




বাংলাদেশের দুর্নীতি এখন দেশে-বিদেশে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কোন কোন প্রকল্পে দুর্নীতি হচ্ছে, দুর্নীতির টাকা কোথায় কোথায় পাচার হচ্ছে কিংবা এ টাকা দিয়ে কে কোন ব্যবসা করছে—এসবই আলোচনার বিষয়। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আইডিবি অনুদান স্থগিত করেছে। সরকার দুর্নীতির এ অভিযোগ তদন্ত না করায় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফান্ড প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। আইএমএফও দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছে। জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুইয়া ওকাদা ঢাকা সফরে এসে সরকারের দুর্নীতির বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিষয়টা সুরাহা না করলে জাপানের পক্ষে ঋণদান সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সফরকালে ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দুর্নীতির কারণে দেশটা পিছিয়ে পড়ছে। ইউরোপীয় দেশগুলোর ৯ জন রাষ্ট্রদূত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে জোরালো কণ্ঠে বলেছেন, দুর্নীতির ফলে বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছে না। সর্বশেষ খোদ সরকারের অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত ঢাকায় বলেছেন, দেশের সব জায়গায় এখন দুর্নীতি আর দুর্নীতি। পুলিশ প্রশাসন, বিচার প্রশাসন, ভূমি ও শিক্ষা প্রশাসন সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতির কারণে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত রোববার বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া অনশন কর্মসূচি শেষে বক্তব্যে বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতির অনেক প্রমাণ তাদের হাতে আছে। উপযুক্ত সময়ে এ দুর্নীতির বিচার করা হবে। ২২ মে এডিবি বলেছে, বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রধান বাধা দুর্নীতি।
দেশের বিশিষ্টজনরাও দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দৈনিক আমার দেশ-এর সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেন, দুর্নীতির রাহুগ্রাসে এখন বন্দি হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিতকেও আজ দুর্নীতির কথা বলতে হচ্ছে। তবে তিনি একদিকে দুর্নীতির কথা বলছেন, অন্যদিকে দুর্নীতিবাজ মন্ত্রিসভায়ও বহাল তবিয়তে রয়েছেন। দুর্নীতি সহ্য করাও এক ধরনের দুর্নীতি।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সর্বব্যাপী দুর্নীতিতে বহির্বিশ্বে ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশ ভারত ছাড়া এখন আর কাউকে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যাবে—যার কুফল ভোগ করবে সাধারণ মানুষ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিদ্যুত্ খাতে বেশুমার দুর্নীতি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি, কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট, টেলিকম খাতে দুর্নীতি, পুলিশে দুর্নীতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে দুর্নীতি, সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে দুর্নীতি, স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতরে দুর্নীতি, মত্স্য ও প্রাণিসম্পদে দুর্নীতি, জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও বদলিতে দুর্নীতি; কেনাবেচায় দুর্নীতি, টেন্ডারে দুর্নীতি; হাটবাজার, জলমহাল, খাসজমি ইজারা ও বরাদ্দে দুর্নীতি; গৃহায়নে দুর্নীতি এখন মানুষের মুখে মুখে। সরকারি অধিদফতর ও প্রকল্প অফিসগুলোকে বলা যায় দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, আমলা, সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরাও আকুণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এবং লুটপাটে মত্ত। কিন্তু এসব প্রতিকারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নিতে পারছে না সরকার।
বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতি বছর খানা জরিপ প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতির প্রতিবেদন তৈরি করে। টিআইবির-ই এক অনুষ্ঠানে দুর্নীতি দমনের কাজে নিয়োজিত সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছেন, টিআইবি দুর্নীতির যে চিত্র প্রকাশ করে, দেশে এর ব্যাপকতা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, টিআইবি যেসব রিপোর্ট প্রকাশ করে সেখানে দুর্নীতির চিত্র থাকে আংশিক। বিচার ব্যবস্থাসহ বিদ্যমান পদ্ধতির সংস্কার করা না গেলে একটা কেন, ১০টা কমিশন দিয়েও দুর্নীতি দমনে সুফল মিলবে না। যদিও দুদক সরকারের মন্ত্রীদের দুর্নীতির তদন্তের চেয়ে তাদের দুর্নীতিমুক্ত সার্টিফিকেট দিতেই ব্যস্ত। মন্ত্রী সুরঞ্জিতের ছেলেকে এরই মধ্যে দুদক দুর্নীতিমুক্ত সার্টিফিকেট দিয়েছে। হয়তো দেখা যাবে মন্ত্রী সুরঞ্জিতও কিছুদিনের মধ্যে দুর্নীতিমুক্ত সার্টিফিকেট পেয়ে যাবেন। এরপর বুক ফুলিয়েই আবার গিয়ে বসবেন মন্ত্রণালয়ের চেয়ারে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও গত শনিবার বলেছেন, ‘দেশের সব জায়গায় দুর্নীতি। বিচার, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, কর আদায়কারী সংস্থা থেকে শুরু করে থানা পুুলিশে সর্বত্র দুর্নীতি আর দুর্নীতি। গত শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) যৌথভাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সংসদ ও বিচার প্রশাসন, কর আদায়কারী সংস্থায়, জনপ্রশাসনে, পুলিশ বিভাগ এবং ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে।
জনবল নিয়োগে দুর্নীতি ও অর্থ কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে রেল যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পদত্যাগ করেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের আরেক প্রভাবশালী সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। রেলের ‘কালো বিড়াল’ খ্যাতিপ্রাপ্ত সুরঞ্জিত ও তার ছেলের দুর্নীতি নিয়ে দেশে-বিদেশে সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে। যদিও এরই মধ্যে সুরঞ্জিতের করা তদন্ত কমিটি তাকে নির্দোষ ও দুর্নীতি দমন কমিশন ‘দুদক’ তার ছেলেকে বেকসুর আখ্যা দিয়েছে। রেলের নিয়োগবাণিজ্যে শত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির বড় একটি খাত বিদ্যুত্। সেখানে চলছে বেপরোয়া দুর্নীতি। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র দুর্নীতির বড় একটি অস্ত্র। গত সাড়ে ৩ বছরে সরকার এ খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে। এর সিংগভাগই গেছে দলীয় লোকদের পকেটে। এসব নিয়েও দেশে-বিদেশে ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে সরকার।
৫ মে বাংলাদেশ সফরে আসেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। তিনি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বিশেষায়িত মার্কিন সহায়তা তহবিল মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টে (এমসিএ) অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না। তিনি আরও বলেছিলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
হিলারি ঢাকা সফরের আগের দিন ৪ মে ঢাকায় আসেন জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুইয়া ওকাদা। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে তিনি জাপানের দেয়া অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রতি দুর্নীতি দমনে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, জাপান যেসব খাতে বিনিয়োগ করছে বা অর্থ সহায়তা দিচ্ছে, তার সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ ব্যবহারের নিশ্চয়তা চায় জাপানি করদাতারা। আর এজন্য সবার আগে বাংলাদেশে দুর্নীতির রাস টানতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও সরকারের বেশুমার দুর্নীতিতে উদ্বিগ্ন। ৯ মে ইউরোপ ডে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউর সহযোগিতার ৪০ বছর উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ইইউ রাষ্ট্রদূতরা বলেন, দুর্নীতির ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। তারা বলেন, বাংলাদেশ যদি নেগেটিভ ইমেজ কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে অন্য কোনো দেশে নিয়ে যাবে। এটা বাংলাদেশের জন্য হবে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ঢাকায় ইইউ প্রতিনিধি উইলিয়াম হানা বলেন, দুর্নীতির ব্যাপারে আমরা এখানে জিরো টলারেন্স দেখাব। বাংলাদেশের যেসব প্রকল্পে ইইউ অর্থায়ন করছে, সেখানে কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। দুর্নীতি প্রসঙ্গে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ে মিডিয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশি সোচ্চার। আমরা চাই মিডিয়াগুলো প্রতিদিন বিভিন্ন খাতের দুর্নীতির চিত্রগুলো তুলে ধরুক। আমি খুবই অবাক হই, যখন দেখি সরকার দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর কিছুই করছে না। আমাদের জনগণের ট্যাক্সের টাকা কেউ অবৈধভাবে ব্যহার করুক, তা আমরা চাই না।
দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুসহ কয়েকটি প্রকল্পে যে কোনো ধরনের অর্থসহায়তা আগেই বন্ধ করেছে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি তারা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ৬টি প্রকল্পে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ জানতে চেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের চিঠি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জরুরি বৈঠকে বসেন। তবে বৈঠকে তারা কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, জানানো না হলে তাদের পক্ষে পরবর্তী কোনো প্রকল্পে সহায়তা দেয়া সম্ভব হবে না বলে হুমকি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট, ঢাকা বাইপাস প্রকল্প, দেবগ্রাম-প্রগতি সরণি সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প, পোস্ট-লিটারেসি অ্যান্ড কন্টিনিউয়িং এডুকেশন ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী টোল প্লাজা, নকলা-হাটিকুমরুল-বনপাড়া সড়ক প্রকল্প এবং ঢাকা মহানগরী তৃতীয় সড়ক প্রকল্প। বিশ্বব্যাংক পৃথক চিঠিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
দুর্নীতির কারণে ক্ষোভ জানিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তারা জানিয়েছে, দুর্নীতি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অসংলগ্নতার কারণে বাংলাদেশে ব্যবসায় খরচ ও অনিশ্চয়তা বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের বেসরকারি খাত সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য খোলা থাকা সত্ত্বেও সরকার পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা সুবিধা দেয়া, দুর্নীতি, দুর্বল মেধাস্বত্ব আইন, অসামঞ্জস্য আইনি কাঠামো এবং আইনের শাসনের অভাবে বাংলাদেশে ব্যবসায়ে খরচ ও অনিশ্চয়তা বেড়ে যাচ্ছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয় বলে অভিমত জানিয়েছে।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশের (আইবিএফবি) এক অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও আইনের শাসনের অভাব এবং দুর্নীতি বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ভীষণভাবে নিরুত্সাহিত করছে। অনেক মার্কিন কোম্পানি বিনিয়োগের ইচ্ছা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। কিন্তু প্রশাসনিক বেড়াজালে আটকা পড়ে তারা হতাশ হয়ে চলে গেছে। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগকারীদের দূরে সরিয়ে রাখছে। দুর্নীতির কাছে নতি স্বীকার করলে আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে অপরাধের জন্য নিজ দেশে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। তাই দুর্নীতি থেকে দূরে থাকার পদক্ষেপ নিতে গিয়ে আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে।
গত ১ এপ্রিল দুদকে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, দুর্নীতি দমন করতে হলে যথাযথ আইন প্রণয়ন করে সরকারকেই বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে হবে। সরকারি খাতে অপব্যয়ের প্রধান কারণ দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে মানবাধিকার বিঘ্নিত হয়। দুর্নীতির মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। ‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা ফাটাই, কিন্তু তা রোধ করতে গাঁইগুঁই করি। সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি হয় ভাসুর, নয় ভাগ্নে হয়ে যান। তিনি বলেন, এখন সব স্থানে এমনভাবে দুর্নীতি হচ্ছে, যা আগে কল্পনা করাও যেত না। শিক্ষকরাও ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে টিউশনি করছেন। ভর্তি হওয়ার আগেই স্কুল কর্তৃপক্ষকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। সাবেক এই বিচারপতি বলেন, মামলা রুজু ও প্রত্যাহারের ফলে দুর্নীতি কমে না। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিচারকাজ বিলম্বিত হয় সরকারি প্রভাবের কারণেই। নিজের ঘর থেকেই সবাইকে দুর্নীতি প্রতিরোধ শুরু করতে হবে।
একই অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মোজাফ্ফর আহমদ বলেছিলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতি দমনে যা-ই বলুক না কেন, বর্তমানে তাদের যে অবস্থা তার কুফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ। দুঃখের বিষয় অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ২২ মে রাতে ইন্তেকাল করেছেন।
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সমাজ চিন্তক বদরুদ্দীন উমর কঠোর সমালোচনা করে গতকাল আমার দেশ-কে বলেছেন, দুর্নীতির রাহুগ্রাসে বন্দি হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সরকারের তৃণমূল—সর্বত্রই দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। দুর্নীতির কারণেই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়েছে। দাতা সংস্থাগুলোও সরকারের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্র তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। এতে ক্রমান্বয়ে দুর্নীতি ও অপরাধের মাত্রা আরও ব্যাপক হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিষয়টি এখন আর বিদেশিদের মুখে সীমাবদ্ধ নেই; খোদ অর্থমন্ত্রীও বাংলাদেশের অগ্রগতি, উন্নতি ও সুশাসনের পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বব্যাংকের টাকা হরিলুটের কারণে সরকারের মন্ত্রী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণসহ অভিযোগ দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীর কাছেই আমার প্রশ্ন—তিনি কেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগ নেননি। তিনি দুর্নীতির কথা বলছেন আবার দুর্নীতিবাজ সরকারের মন্ত্রিসভায়ও রয়েছেন। দুর্নীতি সহ্য করাও একধরনের দুর্নীতি। মূলত দুর্নীতির কারণেই আমাদের রাষ্ট্রের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত সর্বত্র পচন ধরেছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads