সৈয়দ আবদাল আহমদ
আওয়ামী লীগ কথায় কথায় নিজেকে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জাহির করে থাকে। সুযোগ পেলেই দলটি তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে এই বলে ঘায়েল করে যে, বিএনপি অগণতান্ত্রিক দল এবং তার জন্ম ক্যান্টনমেন্টের ছত্রছায়ায়। কিন্তু কী ক্ষমতায়, কী বিরোধী দলে—আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট আচরণই যেন দলটির একমাত্র বৈশিষ্ট্য এবং কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের মূল বাণী হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। কিন্তু এর ধারে-কাছেও নেই আওয়ামী লীগ। গণতান্ত্রিক চর্চা বলতে তাদের কাছে আওয়ামী লীগ যা বলবে, যা করবে সেটাই গণতন্ত্র। অন্যরা কী বলল না বলল কিংবা কী করল না করল—সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। বিরোধী মত বা ভিন্নমত বলতে আওয়ামী লীগের কাছে কোনো কিছু নেই। আওয়ামী লীগের প্রয়োজন হয়েছে তাই নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রয়োজন নেই তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরও আর প্রয়োজন নেই। তেমনি আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে হরতাল হবে। অন্যরা বিরোধী দলে থাকলে আবার কিসের হরতাল? তারা কেন হরতাল করবে? তারপরও তারা যদি হরতাল করে তাহলে তাদের জেল-জুলুম, দমন-পীড়নের শিকার হতে হবে। ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ যা ইচ্ছে তা-ই করবে। দুর্নীতি করবে, ঘুষ খাবে, অন্যের জায়গা-জমি দখল করবে, নিজেদের লোকদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেবে, প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ নিজেদের নামে করবে—এ নিয়ে কারও কথা বলার কিছু নেই, অধিকার নেই। দেশের বারোটা বাজলে বাজবে। দেশের উন্নতি, জনগণের উন্নতি করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আওয়ামী লীগের লোকজনের উন্নতি হলেই তো হলো। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম হয়েছে তো কী হয়েছে? শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম গুম হয়েছে তো কী হয়েছে? এ জন্য বিএনপিকে হরতাল করতে হবে কেন? হরতাল করলে জেলে যেতে হবে, পুলিশের মার খেতে হবে।
এমনই আচরণ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। গত বুধবার বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় ৩৩ জন নেতাকে যেভাবে জেলে নেয়া হলো, সে ঘটনা আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট আচরণের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। হরতালের সময় গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে দায়ের করা এক মিথ্যা মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের ৩৩ জন নেতাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের ২৯ জন এবং শরিক চারটি দলের চার শীর্ষ নেতা রয়েছেন। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার ঘটনায় বিএনপিসহ জোট হরতাল করছিল। তাদের শেষ হরতালটি ছিল গত ৩ মে বৃহস্পতিবার। ওই হরতালের আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশে একটি গাড়ি পোড়ানো হয়। ওই গাড়িটি নাকি বিরোধী দলের নেতারা পুড়িয়েছেন। মামলার চার্জশিটে নেতাদের নামে অদ্ভুত অদ্ভুত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। অথচ এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমদ ওইদিন ছিলেন চট্টগ্রামে, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান ছিলেন দিনাজপুরে। রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ওইদিন নাটোরে কোর্টে একটি মামলার হাজিরায় সেখানে ছিলেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের বড় বড় নেতাকে এ মামলায় জড়িয়ে দেয়া হয়। মামলাটা দেয়া হয় দ্রুত বিচার আইনে। তাই নেতারা গ্রেফতার এড়িয়ে জামিন নেয়ার কৌশল হিসেবে কয়েকদিন আত্মগোপন করেছিলেন; কিন্তু সরকার এমন পরিস্থিতি করে যে তারা যেন জামিন নিতে হাইকোর্টে পর্যন্ত যেতে না পারেন। বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনলে হাইকোর্ট এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনা দেন। ফলে নেতারা কোর্টে যান; কিন্তু ন্যায়বিচার তারা পাননি। হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পাওয়া যায়নি। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের আদেশ দেন। সবার আশা ছিল নিম্নআদালতে জামিন পাওয়া যাবে; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনযন্ত্রকে এমনভাবে সন্ত্রস্ত করে রাখে যে, ন্যায়বিচার আর পাওয়া যায়নি। ৩৩ জন নেতাকে অমানবিকভাবে জেলে যেতে হয়েছে। এদের মধ্যে চারটি দলের শীর্ষ নেতা রয়েছেন। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা জাতীয় স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র সদস্য রয়েছেন। দু’জন এমপি রয়েছেন। যে দলটি কয়েকবার বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, দেশ পরিচালনা করেছে, সেই দল বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা হাইকোর্টের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই নিম্ন আদালতে জামিন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু জামিন পাওয়া গেল না। গুরুত্বপূর্ণ ৩৩ জন নেতাকেই প্রিজন ভ্যানে করে জেলে নেয়া হলো। নজিরবিহীন ঘটনা।
বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের ইতিহাসে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ওপর এমন বৈরী রাজনৈতিক আচরণ আগে দেখা যায়নি। এমনকি স্বৈরাচার এরশাদের সময়ও একসঙ্গে এত সিনিয়র রাজনৈতিক নেতাকে জেলে নেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সময় একবার জাসদের রব-জলিলসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে জেলে নেয়া হয়েছিল। এরশাদের সময় ১৯৮৩ সালে ড. কামাল হোসেনের বাসা থেকে কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আর ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সরকারের সময় রাজনৈতিক নেতাদের ঢালাও জেলে নেয়া হয়েছিল। তবে ১৯৯১ সালের পর নির্বাচিত সরকারগুলোর মধ্যে বর্তমান ঘটনাই একমাত্র নজির। শেখ হাসিনার সরকার এ নিয়ে সামান্য ভ্রূক্ষেপও করছে না। সামান্য রাজনৈতিক সহনশীলতাও দেখাচ্ছে না। সহযোগী রাজনৈতিক দলের এত সিনিয়র নেতাকে হয়রানিমূলক জেলে পাঠিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। যেন সব ঠাণ্ডা করে দেয়া হয়েছে। এতে কি রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হবে? না, রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বাড়বে?
অবশ্য আওয়ামী লীগের কাছে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা আশা করার কোনো কারণ নেই। আওয়ামী লীগ ৬৪ বছরের পুরনো রাজনৈতিক দল হলেও ফ্যাসিবাদী চরিত্র নিয়েই দলটি তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। পেশিশক্তি তথা সন্ত্রাস চালিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেই বরাবর রাজনীতি করেছে আওয়ামী লীগ। এদেশের সাধারণ জনগণের দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মতো একটি ফ্যাসিস্ট দল রয়েছে। এই দল একবার ক্ষমতায় যায়, একবার বিরোধী দলে থাকে। কিন্তু জনগণকে সবসময়ই দলটির অত্যাচার সইতে হয়। আরও কতকাল এই অত্যাচার সইতে হবে কে জানে?
শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের টার্গেট হয়ে যান মির্জা ফখরুল
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে এরই মধ্যে সারাদেশের মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেছেন। এর আগে বিএনপির মহাসচিব ছিলেন অ্যাডভোকেট খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। রাজনীতির এক কঠিন সময়ে তাকে বিএনপির মহাসচিব করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। খোন্দকার দেলোয়ার খালেদা জিয়ার সেই বিশ্বাস রেখেছেন। তিনি বিএনপির বিপদে দলটির কাণ্ডারি হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দলটি রক্ষা করেছেন। জরুরি সরকারের অবসানের পর বিএনপির কাউন্সিলে মহাসচিব পরিবর্তনের কথা উঠেছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া তাকেই মহাসচিব রেখে দেন। যদিও তিনি ছিলেন অসুস্থ। অবশ্য বেশিদিন আর তিনি এ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হন। তিনি দায়িত্বে আসার পর তার কথা বলার ভঙ্গি, তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, বক্তব্যে শব্দচয়ন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে ব্যবহার, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া এবং সর্বোপরি তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কণ্ঠ ও তার শারীরিক গড়ন এবং একজন সুদর্শন মানুষ হিসেবে সর্বমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে, মিডিয়ার কাছে, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে তিনি জনপ্রিয় হলেও টার্গেট হয়ে যান আওয়ামী লীগের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছুতেই পছন্দ করছিল না বিএনপির একজন ভালো মহাসচিব ইমার্জ করছেন। তারা নানাভাবে চক্রান্ত করতে থাকে কীভাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ঘায়েল করা যায়। সেই অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই তাকে প্রতিহিংসামূলক মামলায় জড়ানো হয়েছে। এ মামলায় তাকে জেলে নেয়া হয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্য— মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যাতে একটা বড় বাধা পান, তিনি যেন বিএনপির ইফেকটিভ মহাসচিব হিসেবে গড়ে উঠতে না পারেন। তবে মানুষ চিন্তা করে এক, হয় আরেক। হয়তো দেখা যাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির সবচেয়ে আলোচিত এবং যোগ্য মহাসচিব হিসেবে আবির্ভূত হবেন এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে যাবে বিএনপি, সেদিন বেশি দূরে নয়। মাঠের মানুষ সে কথাই বলছে।
সব লাশের কফিনই বইতে হবে শেখ হাসিনাকে
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা নিয়ে রাজনীতি এখন টালমাটাল। বিরোধী দলের হরতালের কারণে শেখ হাসিনার সরকারও মারমুখো। এরই মধ্যে মিথ্যা মামলা দিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জেলে নিয়েছে সরকার। যার জন্য ৩৫ শীর্ষস্থানীয় নেতা আজ জেলে, সেই ইলিয়াস আলীর এখনও কোনো সন্ধান নেই। তিনি কোথায় আছেন, কেউ জানে না। সরকার নির্বিকার। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পুরো এক মাস হয়ে গেছে। গত ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস আলী গুম হয়েছিলেন। গতকাল ১৭ মে পার হয়েছে। কিন্তু ইলিয়াস আলীর স্ত্রী লুনাসহ ছেলেমেয়েরা জানেন না তিনি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন। তেমনি দলও জানে না তার একজন সাহসী নেতা এখন কী পরিস্থিতিতে কোথায় আছেন কিংবা আদৌ আছেন কি না। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার তাকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু খুঁজে বের করা তো দূরের কথা, মন্ত্রীদের কথাবার্তায় মানুষ আশ্বস্ত হওয়ার বদলে শংকিত হচ্ছেন। ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়ার জন্যই সরকার আরেকটি কৌশল নিয়েছে। আর এ কৌশলের অংশ হিসেবেই সরকার ১৮ দলীয় জোটের অর্ধশতাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতার নামে মামলা দিয়ে তাদের বেশিরভাগকেই জেলে নিয়েছে। সরকারের লক্ষ্য ইলিয়াসের গুমের ঘটনাটা যাতে আর আলোচিত না হয়। এখন আলোচনা যাতে হয় নেতাদের জেল নিয়ে। বিএনপি ইলিয়াস আলীকে বাদ দিয়ে যাতে এখন নেতাদের মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবে সরকার যত ছলচাতুরিই করুক না কেন, সবকিছুই একদিন বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আর সব লাশের কফিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই বহন করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
এমনই আচরণ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। গত বুধবার বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় ৩৩ জন নেতাকে যেভাবে জেলে নেয়া হলো, সে ঘটনা আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট আচরণের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। হরতালের সময় গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে দায়ের করা এক মিথ্যা মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের ৩৩ জন নেতাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের ২৯ জন এবং শরিক চারটি দলের চার শীর্ষ নেতা রয়েছেন। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার ঘটনায় বিএনপিসহ জোট হরতাল করছিল। তাদের শেষ হরতালটি ছিল গত ৩ মে বৃহস্পতিবার। ওই হরতালের আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশে একটি গাড়ি পোড়ানো হয়। ওই গাড়িটি নাকি বিরোধী দলের নেতারা পুড়িয়েছেন। মামলার চার্জশিটে নেতাদের নামে অদ্ভুত অদ্ভুত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। অথচ এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমদ ওইদিন ছিলেন চট্টগ্রামে, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান ছিলেন দিনাজপুরে। রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ওইদিন নাটোরে কোর্টে একটি মামলার হাজিরায় সেখানে ছিলেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের বড় বড় নেতাকে এ মামলায় জড়িয়ে দেয়া হয়। মামলাটা দেয়া হয় দ্রুত বিচার আইনে। তাই নেতারা গ্রেফতার এড়িয়ে জামিন নেয়ার কৌশল হিসেবে কয়েকদিন আত্মগোপন করেছিলেন; কিন্তু সরকার এমন পরিস্থিতি করে যে তারা যেন জামিন নিতে হাইকোর্টে পর্যন্ত যেতে না পারেন। বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনলে হাইকোর্ট এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনা দেন। ফলে নেতারা কোর্টে যান; কিন্তু ন্যায়বিচার তারা পাননি। হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পাওয়া যায়নি। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের আদেশ দেন। সবার আশা ছিল নিম্নআদালতে জামিন পাওয়া যাবে; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনযন্ত্রকে এমনভাবে সন্ত্রস্ত করে রাখে যে, ন্যায়বিচার আর পাওয়া যায়নি। ৩৩ জন নেতাকে অমানবিকভাবে জেলে যেতে হয়েছে। এদের মধ্যে চারটি দলের শীর্ষ নেতা রয়েছেন। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা জাতীয় স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র সদস্য রয়েছেন। দু’জন এমপি রয়েছেন। যে দলটি কয়েকবার বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, দেশ পরিচালনা করেছে, সেই দল বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা হাইকোর্টের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই নিম্ন আদালতে জামিন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু জামিন পাওয়া গেল না। গুরুত্বপূর্ণ ৩৩ জন নেতাকেই প্রিজন ভ্যানে করে জেলে নেয়া হলো। নজিরবিহীন ঘটনা।
বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের ইতিহাসে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ওপর এমন বৈরী রাজনৈতিক আচরণ আগে দেখা যায়নি। এমনকি স্বৈরাচার এরশাদের সময়ও একসঙ্গে এত সিনিয়র রাজনৈতিক নেতাকে জেলে নেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সময় একবার জাসদের রব-জলিলসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে জেলে নেয়া হয়েছিল। এরশাদের সময় ১৯৮৩ সালে ড. কামাল হোসেনের বাসা থেকে কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আর ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সরকারের সময় রাজনৈতিক নেতাদের ঢালাও জেলে নেয়া হয়েছিল। তবে ১৯৯১ সালের পর নির্বাচিত সরকারগুলোর মধ্যে বর্তমান ঘটনাই একমাত্র নজির। শেখ হাসিনার সরকার এ নিয়ে সামান্য ভ্রূক্ষেপও করছে না। সামান্য রাজনৈতিক সহনশীলতাও দেখাচ্ছে না। সহযোগী রাজনৈতিক দলের এত সিনিয়র নেতাকে হয়রানিমূলক জেলে পাঠিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। যেন সব ঠাণ্ডা করে দেয়া হয়েছে। এতে কি রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হবে? না, রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বাড়বে?
অবশ্য আওয়ামী লীগের কাছে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা আশা করার কোনো কারণ নেই। আওয়ামী লীগ ৬৪ বছরের পুরনো রাজনৈতিক দল হলেও ফ্যাসিবাদী চরিত্র নিয়েই দলটি তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। পেশিশক্তি তথা সন্ত্রাস চালিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেই বরাবর রাজনীতি করেছে আওয়ামী লীগ। এদেশের সাধারণ জনগণের দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মতো একটি ফ্যাসিস্ট দল রয়েছে। এই দল একবার ক্ষমতায় যায়, একবার বিরোধী দলে থাকে। কিন্তু জনগণকে সবসময়ই দলটির অত্যাচার সইতে হয়। আরও কতকাল এই অত্যাচার সইতে হবে কে জানে?
শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের টার্গেট হয়ে যান মির্জা ফখরুল
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে এরই মধ্যে সারাদেশের মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেছেন। এর আগে বিএনপির মহাসচিব ছিলেন অ্যাডভোকেট খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। রাজনীতির এক কঠিন সময়ে তাকে বিএনপির মহাসচিব করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। খোন্দকার দেলোয়ার খালেদা জিয়ার সেই বিশ্বাস রেখেছেন। তিনি বিএনপির বিপদে দলটির কাণ্ডারি হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দলটি রক্ষা করেছেন। জরুরি সরকারের অবসানের পর বিএনপির কাউন্সিলে মহাসচিব পরিবর্তনের কথা উঠেছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া তাকেই মহাসচিব রেখে দেন। যদিও তিনি ছিলেন অসুস্থ। অবশ্য বেশিদিন আর তিনি এ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হন। তিনি দায়িত্বে আসার পর তার কথা বলার ভঙ্গি, তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, বক্তব্যে শব্দচয়ন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে ব্যবহার, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া এবং সর্বোপরি তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কণ্ঠ ও তার শারীরিক গড়ন এবং একজন সুদর্শন মানুষ হিসেবে সর্বমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে, মিডিয়ার কাছে, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে তিনি জনপ্রিয় হলেও টার্গেট হয়ে যান আওয়ামী লীগের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছুতেই পছন্দ করছিল না বিএনপির একজন ভালো মহাসচিব ইমার্জ করছেন। তারা নানাভাবে চক্রান্ত করতে থাকে কীভাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ঘায়েল করা যায়। সেই অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই তাকে প্রতিহিংসামূলক মামলায় জড়ানো হয়েছে। এ মামলায় তাকে জেলে নেয়া হয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্য— মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যাতে একটা বড় বাধা পান, তিনি যেন বিএনপির ইফেকটিভ মহাসচিব হিসেবে গড়ে উঠতে না পারেন। তবে মানুষ চিন্তা করে এক, হয় আরেক। হয়তো দেখা যাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির সবচেয়ে আলোচিত এবং যোগ্য মহাসচিব হিসেবে আবির্ভূত হবেন এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে যাবে বিএনপি, সেদিন বেশি দূরে নয়। মাঠের মানুষ সে কথাই বলছে।
সব লাশের কফিনই বইতে হবে শেখ হাসিনাকে
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা নিয়ে রাজনীতি এখন টালমাটাল। বিরোধী দলের হরতালের কারণে শেখ হাসিনার সরকারও মারমুখো। এরই মধ্যে মিথ্যা মামলা দিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জেলে নিয়েছে সরকার। যার জন্য ৩৫ শীর্ষস্থানীয় নেতা আজ জেলে, সেই ইলিয়াস আলীর এখনও কোনো সন্ধান নেই। তিনি কোথায় আছেন, কেউ জানে না। সরকার নির্বিকার। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পুরো এক মাস হয়ে গেছে। গত ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস আলী গুম হয়েছিলেন। গতকাল ১৭ মে পার হয়েছে। কিন্তু ইলিয়াস আলীর স্ত্রী লুনাসহ ছেলেমেয়েরা জানেন না তিনি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন। তেমনি দলও জানে না তার একজন সাহসী নেতা এখন কী পরিস্থিতিতে কোথায় আছেন কিংবা আদৌ আছেন কি না। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার তাকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু খুঁজে বের করা তো দূরের কথা, মন্ত্রীদের কথাবার্তায় মানুষ আশ্বস্ত হওয়ার বদলে শংকিত হচ্ছেন। ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়ার জন্যই সরকার আরেকটি কৌশল নিয়েছে। আর এ কৌশলের অংশ হিসেবেই সরকার ১৮ দলীয় জোটের অর্ধশতাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতার নামে মামলা দিয়ে তাদের বেশিরভাগকেই জেলে নিয়েছে। সরকারের লক্ষ্য ইলিয়াসের গুমের ঘটনাটা যাতে আর আলোচিত না হয়। এখন আলোচনা যাতে হয় নেতাদের জেল নিয়ে। বিএনপি ইলিয়াস আলীকে বাদ দিয়ে যাতে এখন নেতাদের মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবে সরকার যত ছলচাতুরিই করুক না কেন, সবকিছুই একদিন বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আর সব লাশের কফিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই বহন করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন