শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

এভারেস্ট চূড়ায় বাংলাদেশের প্রথম নারী



বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা। হিমালয়ের শিখরে পা রাখলেন নিশাত মজুমদার। প্রথম বাংলাদেশী নারী। ইতিহাসের অংশ হলেন তিনি। আনন্দে ভাসছে পুরো দেশ। মা আশুরা মজুমদারের চোখে আনন্দাশ্রু। আমার দেশ-কে বললেন, ‘আনন্দ প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই।’ তবে এখন কিছুটা উদ্বিগ্ন এই তৃপ্ত মা। বললেন, ‘ভালোভাবে ফিরে আসুক মেয়েটি।’
জানা গেছে, সঙ্গী আরেক এভারেস্ট জয়ী এমএ মুহিতকে নিয়ে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায় হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান নিশাত। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন ৩ শেরপা। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে সুপরিচিত শেরপা পেমবা দোর্জি, যিনি নিজেও একজন এভারেস্টজয়ী এবং দ্রুততম সময়ে এভারেস্ট আরোহণের জন্য গিনেস বুক রেকর্ডধারী, তিনি বিবিসিকে এ খবর নিশ্চিত করে বলেন, এভারেস্ট পথে ক্যাম্প টু থেকে আমার ভাই তেনজিং বাংলাদেশের নিশাত মজুমদার ও সেই সঙ্গে আরও এক বাংলাদেশী এমএ মুহিতের এভারেস্ট শীর্ষে আরোহণের খবরটি জানিয়েছেন। হিমালয় জয়ের উদ্দেশে গত মাসের ৬ তারিখ ঢাকা ত্যাগ করেন নিশাত ও মুহিত। এমএ মুহিত এর আগে গত বছরের মে মাসেও এভারেস্ট জয় করেছিলেন, তবে তার সেই অভিযান ছিল চীনে তিব্বতের দিক দিয়ে। এবারে তারা এভারেস্টে উঠলেন নেপালের দিক দিয়ে।
বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক আমার দেশ-কে বলেন, ‘নিশাতের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে সঙ্গী শেরপারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টায় নিশাত ও মুহিত এভারেস্টের চূড়া জয় করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘এভারেস্ট চূড়ায় কারও পক্ষে দীর্ঘ সময় থাকা সম্ভব নয়। ওরা ক্যাম্পের পথে রয়েছেন। আশা করছি, সহসাই স্যাটেলাইট ফোন থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’ ইনাম আল হক বলেন, নিশাত মজুমদারের এ কৃতিত্ব বাংলাদেশের সব পর্বতারোহীকেই দারুণ গর্বিত করেছে—দেশের পর্বতারোহণে এটা এক বিরাট আনন্দের দিন।
নিশাত মজুমদার তৃতীয় বাংলাদেশী, একমাত্র নারী হিমালয় জয় করলেন। এর আগে ২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এভারেস্ট চূড়ায় উঠেছিলেন মুসা ইব্রাহিম। এরপর ২০১১ সালের ২১ মে দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন এমএ মুহিত। নিশাত মজুমদারের এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণের খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা বাবা আবদুল মান্নান মজুমদার ও গৃহিণী মা আশুরা মজুমদারের ৪ সন্তানের মধ্যে নিশাত দ্বিতীয়। তার জন্ম ১৯৮১ সালে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার বাত্রা গ্রামের দক্ষিণপাড়া মজুমদার বাড়িতে। থাকেন ঢাকার পান্থপথে।
নিশাত ফার্মগেটের বটমূলীহোম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা ওয়াসায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। বাংলাদেশের এই প্রথম নারী এভারেস্ট জয়ী নিশাত ২০০৩ সালে এভারেস্ট বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া (৩,১৭২ ফুট) কেওক্রাডং জয় করেন।
২০০৬ সালের মার্চে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে বিএমটিসি আয়োজিত বাংলাদেশের নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে আবার কেওক্রাডং চূড়ায় ওঠেন তিনি। একই বছরের সেপ্টেম্বরে বিএমটিসি আয়োজিত নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে তিনি এভারেস্ট বেস ক্যাম্প (১৭ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতা) ট্র্যাকিংয়ে অংশ নেন।
এরপর ২০০৭ সালের মে মাসে বিএমটিসির অর্থায়নে দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে হিমালয়ের মেরা পর্বতশৃঙ্গ (২১ হাজার ৮৩০ ফুট) জয় করেন।
এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে পরের বছরের মে মাসে হিমালয়ের সিঙ্গুচুলি পর্বতশৃঙ্গে (২১ হাজার ৩২৮ ফুট) ওঠেন। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি ভারতের উত্তর কাশীর গঙ্গোত্রী হিমালয়ের গঙ্গোত্রী-১ পর্বতশৃঙ্গে (২১ হাজার ফুট) বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অভিযানে অংশ নেন। নিশাত ২০০৯ সালের এপ্রিলে পৃথিবীর পঞ্চম উচ্চতম শৃঙ্গ মাকালুতে (২৭ হাজার ৮৬৫ ফুট) ভারত-বাংলাদেশ যৌথ অভিযানে অংশ নেন। গতবছরের অক্টোবরে বিএমটিসি আয়োজিত হিমালয়ের চেকিগো নামের একটি শৃঙ্গেও সফল অভিযানে যান নিশাত। সর্বশেষ এ অভিযানের জন্য গত ৬ এপ্রিল ঢাকা ত্যাগ করেন নিশাত। ৪৩ দিনের অভিযান শেষে তিনি চূড়ায় আহোরণ করলেন। মেয়ের সাফল্যের খবর শুনে উচ্ছ্বসিত, উদ্বেলিত নিশাতের ব্যবসায়ী বাবা আবদুল মান্নান মজুমদার ও মা গৃহিণী আশুরা মজুমদার। তারা আমার দেশ-কে বলেন, ‘নারী হিসেবে সে হিমালয় জয় করেছে এটি বাংলাদেশী পশ্চাত্পদ নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে। নিশাত নানা ধরনের বাধা অতিক্রম করে হিমালয় জয় করল। তার এই অর্জনে আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশী নারীরা সব কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।’
এদিকে নিশাত মজুমদারের সঙ্গী এমএ মুহিত দ্বিতীয়বারের মতো এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করলেন। এর আগে তিনি ২০১১ সালের ২১ মে দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে হিমালয় জয় করেন। মুহিতের এ সফলতায় তার বাবা মনোয়ার হোসাইন এবং মা আনোয়ারা বেগম আনন্দে উদ্বেলিত। তারা আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা খুব খুশি। তবে আমাদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ হয়নি। বিএমটিসির পক্ষ থেকে এ খবর জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি, আমাদের সন্তানের জন্য গর্বিত।’
সুস্থ দেহে মুহিত দেশে ফিরে আসবে এমনটি প্রত্যাশা করছেন তার গর্বিত বাবা-মা।
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী অভিনন্দন : এভারেস্ট জয় করার পর অভিনন্দন বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নিশাত মজুমদারের সাহসিকতায় দেশবাসী গর্বিত। প্রথম বাংলাদেশী নারী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে নিশাত বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করায় পুরো দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গর্বিত।’ তিনি বলেন, প্রথম বাংলাদেশী নারী হিসেবে এই প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে নিশাত মজুমদার বাঙালির সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তার এ সাফল্য আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।’
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট বিজয়ে বাংলাদেশের প্রথম বিজয়ী মহিলা নিশাত মজুমদারকে উষ্ণ অভিনন্দন ও প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
অভিনন্দন বার্তায় বেগম জিয়া বলেন, এ গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের মুুখ উজ্জ্বল হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বাংলাদেশী নিশাত মজুমদারের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করে বলেন, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশী অন্য নারীরা তার এ সাফল্য অনুকরণের মাধ্যমে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনুপ্রাণিত হবে এবং এ ধরনের সফলতা অর্জনে সক্ষম হবে। অভিনন্দন বার্তায় বিএনপি চেয়ারপার্সন আরও বলেন, ‘একজন মহিলা হয়েও এভারেস্ট বিজয় সারাবিশ্বে স্বজাতির মাথাকে উন্নত করেছে। সারাদেশের জনগণ নিশাত মজুমদারের এ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে উদ্বেলিত। আমিও তাদের আনন্দে নিজেকে সামিল করছি।’
বেগম জিয়া বলেন, নিশাত মজুমদারের এই অবিস্মরণীয় সাফল্যে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। আমি তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads