বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভ্রমণবিলাসী এ মন্ত্রী ভারত ছাড়া কোনো বন্ধুর সন্ধান পাননি। দায়িত্ব গ্রহণের সাড়ে তিন বছরে তিনি শতাধিক বার বিদেশ সফর করেছেন। এ মুহূর্তে তিনি রয়েছেন লাটভিয়া সফরে। এসব দৌড়ঝাঁপ কোনো কাজে আসছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, নতুন ধরনের কূটনীতি শুরু করতে হবে। না হলে বাংলাদেশকে চরম মূল্য দিতে হবে। জনগণের দুর্দশা আরও বাড়বে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই দিল্লিকেন্দ্রিক পররাষ্ট্র নীতি চালু করে। কূটনৈতিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের সঙ্গে একতরফা বন্ধুত্ব গড়তে গিয়ে বর্তমান সরকার ভারতনির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে একদিকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে; অন্যদিকে এ সুযোগে ভারত তার অযৌক্তিক দাবিগুলো বাংলাদেশকে মানতে বাধ্য করছে। তারা বলছেন, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে শুধু একটি দেশকে অবলম্বন করে কোনো দেশের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তার সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। শেখ হাসিনা সরকারের এক বছর পার হতে না হতেই ভারত তার দীর্ঘ ৪০ বছরের দাবিগুলো আদায় করে নেয়। সন্ত্রাস দমনের নামে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিদ্রোহ দমনে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা; করিডোর, ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা; চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার; সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের অনুমতিসহ ভারত যা যা চেয়েছে তার সবকিছুতেই সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লি সফরের সময় ভারতের এসব দাবি পূরণ করা হয়, তখন খোদ ভারতের বিখ্যাত দৈনিক দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়, ‘সুযোগ পেয়ে ঢাকার কাছ থেকে সবকিছু লুফে নিয়েছে দিল্লি।’ এরপর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশকে পুরোপুরি ভারতনির্ভর করতে সহযোগিতার ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সই করিয়ে নেন বর্তমান সরকারকে দিয়ে। শিক্ষা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে একের পর এক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। সীমান্তে বিএসএফের হত্যা এবং বর্বরতা থামেনি। অপদখলীয় ভূমি এবং ছিটমহল বিনিময়সহ সীমান্ত সমস্যার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এবং টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে রীতিমত বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে ভারত।
ভারতের সঙ্গে একতরফা সম্পর্ক গড়তে গিয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়নি ঢাকা। চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশ এখন আর বাংলাদেশের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন খারাপ। সব মিলিয়ে বর্তমান পররাষ্ট্র নীতি বাংলাদেশকে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে।
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে অপমান-অপদস্ত করায় যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। যে ভারতমুখী কূটনীতি চালানো হচ্ছিল, সে ভারতই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় সর্বশেষ পেরেক ঠুকে দিয়ে টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ চুক্তি করে।
বড় বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা এখন বাংলাদেশের ঘাড়ে। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি হয়নি; লাভের বদলে ভর্তুকি দিয়ে ভারতকে করিডোর সুবিধা দেয়া হয়েছে; একটি দেশেও বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি, বরং বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে; সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে, ইউরোপীয় ইউনিয়নও সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশের অবস্থানে। এ সময় উন্নয়ন-সহযোগী দাতা সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুত অর্থ না দেয়ার মতো অবস্থানও নিয়েছে। গভীর সমুদ্রে বন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করলেও চীনের সঙ্গে এ ধরনের কোনো চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। জাপানের মতো বন্ধু রাষ্ট্রও পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের সহায়তা স্থগিত করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ফার্স্ট লেডি হিসেবে দুই দফা বাংলাদেশ সফর করেন। কিন্তু তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর বাংলাদেশ সফরে বারবার অনীহা জানিয়ে এসেছেন। নানা চেষ্টা তদবির করলে সর্বশেষ চলতি মাসের ৫ তারিখ দুইদিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু হিলারির এ সফরে বাংলাদেশ লাভবান হয়নি।
দুর্নীতি ইস্যুতে ও বাংলাদেশের অব্যাহত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম নিয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইইউ’র এ উদ্বেগ কমানোর মতো কোনো কাজ করেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ও সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সম্ভব হয়নি সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সম্প্র্রসারণ; বরং বন্ধ রয়েছে কুয়েত ও সৌদি আরবের বাজার। সেই সঙ্গে ৮ বাংলাদেশী প্রবাসীর শিরশ্ছেদের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঠেকাতে পারেনি এই সরকার। বিভিন্ন কারণে ফিরতে হয়েছে লক্ষাধিক বাংলাদেশিকে। তাদের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় পাঠানোর চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। মূলত সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতায় জনশক্তি রফতানির এ বিপদসঙ্কুল অবস্থা। ভিন্নভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি পাঠানো ছাড়াও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে একাধিকবার সফর করেছেন দীপু মনি। সেখান থেকেও নেই নতুন শ্রমবাজারের ঘোষণা বা অন্য কোনো সুখবর। এছাড়া সম্প্রতি সৌদি এক কূটনীতিক ঢাকায় নিহত হয়েছেন। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কাউকে চিহ্নিত তো দূরের কথা, এ বিষয়ে অগ্রগতির কোনো খবর করতে পারছে না সরকার। বিষয়টি নিয়ে রিয়াদ চরম ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জাপানের সঙ্গেও সম্পর্কে ভাঙন ধরিয়েছে ঢাকা। নিকট অতীতে জাপানের শক্তিশালী ভূমিকম্পের সময় অন্যান্য দেশ সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায়। সহমর্মিতা জানাতে তারা জাপান সফরেরও আগ্রহ দেখায়। তবে জাপান সরকারের পক্ষ থেকেই কয়েক দিন পর সেখানে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু কোনো দেশই তাদের দূতাবাস বন্ধ করেনি। এ সময় ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশের এ ঘোষণায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি এক উপ-প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যেভাবে বিরোধ মেটাতে বলেছেন, জাপানিরা সাধারণত এত কড়া ভাষায় কথা বলেন না।
চীন বাংলাদেশকে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরিতে অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরে এ ধরনের কোনো চুক্তি করতে পারেনি সরকার। বরং গত বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি সাক্ষাত্ করেন তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামার সঙ্গে। বিষয়টি নিজ কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রচারও করেন ওই রাষ্ট্রদূত। তথ্যবিবরণীটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ছাড়া আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয়। কিন্তু চীনের কাছে দালাইলামা নিষিদ্ধ নাম, যেমন তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিষয়টি। এ কারণে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সাক্ষাতের বিষয়টিকে ‘পথ চলতে হঠাত্ দেখা’ বলে দাবি করেন দীপু মনি ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আবুল মোমেন। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
এভাবে একের পর এক বন্ধুপ্রতিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ক শিকেয় তুলেছে বর্তমান সরকার। সবকিছু দিয়ে হলেও ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় চাণক্যপুরীর সঙ্গে। তারপরও যেন মন গলছে না দিল্লির। তিস্তা নিয়ে রীতিমতো প্রতারণামূলক আশ্বাস দিয়ে আসছে নয়াদিল্লি।
কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়লেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভ্রমণবিলাসিতা বন্ধ নেই। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত তিনি শতাধিকবার বিদেশ সফর করেছেন। এরপরও কমপক্ষে ২০ বার বিদেশে গিয়েছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন। গত সাড়ে তিন বছরে তিনি কমপক্ষে ১৫ মাস বিদেশে ছিলেন বলে জানা গেছে। রেকর্ড গড়া এ বিদেশ সফরে দেশের জন্য কোনো অর্জন নেই। বাংলাদেশের আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিদেশ সফরের রেকর্ড অনেক আগেই ভেঙেছেন ডা. দীপু মনি।
ডা. দীপু মনির এই যথেচ্ছ সফরের মধ্যে মাত্র ১৫-১৬ বার গেছেন দ্বিপক্ষীয় সফরে। বাকি সফরে গেছেন তিনি বিভিন্ন সম্মেলন, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে যোগ দিতে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখন আর তার বিদেশ সফরের কোনো হিসাব রাখি না। ৯৭তম সফর পর্যন্ত হিসাব ছিল। এখন আর রাখছি না। গত সাড়ে তিন বছরে দেখা গেছে, কোনো বড় ইনকামিং সফর হয়নি।
বাংলাদেশের বন্ধুহীন হয়ে পড়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভারতের অর্থমন্ত্রী ও জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তারা অনেক কথা বলেছেন। তাদের সিগন্যালগুলো সরকারের বোঝা উচিত। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। জনগণের দুর্দশা বাড়বে।
ভারতের সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘মাঝে মধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, দীপু মনি কি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী? তিনি তিস্তা চুক্তির জন্য ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেনদরবার করবেন কেন? এটা কূটনৈতিক দেউলিয়াত্ব।’
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই দিল্লিকেন্দ্রিক পররাষ্ট্র নীতি চালু করে। কূটনৈতিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের সঙ্গে একতরফা বন্ধুত্ব গড়তে গিয়ে বর্তমান সরকার ভারতনির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে একদিকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে; অন্যদিকে এ সুযোগে ভারত তার অযৌক্তিক দাবিগুলো বাংলাদেশকে মানতে বাধ্য করছে। তারা বলছেন, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে শুধু একটি দেশকে অবলম্বন করে কোনো দেশের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তার সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। শেখ হাসিনা সরকারের এক বছর পার হতে না হতেই ভারত তার দীর্ঘ ৪০ বছরের দাবিগুলো আদায় করে নেয়। সন্ত্রাস দমনের নামে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিদ্রোহ দমনে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা; করিডোর, ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা; চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার; সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের অনুমতিসহ ভারত যা যা চেয়েছে তার সবকিছুতেই সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লি সফরের সময় ভারতের এসব দাবি পূরণ করা হয়, তখন খোদ ভারতের বিখ্যাত দৈনিক দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়, ‘সুযোগ পেয়ে ঢাকার কাছ থেকে সবকিছু লুফে নিয়েছে দিল্লি।’ এরপর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশকে পুরোপুরি ভারতনির্ভর করতে সহযোগিতার ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সই করিয়ে নেন বর্তমান সরকারকে দিয়ে। শিক্ষা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে একের পর এক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। সীমান্তে বিএসএফের হত্যা এবং বর্বরতা থামেনি। অপদখলীয় ভূমি এবং ছিটমহল বিনিময়সহ সীমান্ত সমস্যার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এবং টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে রীতিমত বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে ভারত।
ভারতের সঙ্গে একতরফা সম্পর্ক গড়তে গিয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়নি ঢাকা। চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশ এখন আর বাংলাদেশের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন খারাপ। সব মিলিয়ে বর্তমান পররাষ্ট্র নীতি বাংলাদেশকে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে।
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে অপমান-অপদস্ত করায় যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। যে ভারতমুখী কূটনীতি চালানো হচ্ছিল, সে ভারতই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় সর্বশেষ পেরেক ঠুকে দিয়ে টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ চুক্তি করে।
বড় বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা এখন বাংলাদেশের ঘাড়ে। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি হয়নি; লাভের বদলে ভর্তুকি দিয়ে ভারতকে করিডোর সুবিধা দেয়া হয়েছে; একটি দেশেও বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি, বরং বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে; সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে, ইউরোপীয় ইউনিয়নও সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশের অবস্থানে। এ সময় উন্নয়ন-সহযোগী দাতা সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুত অর্থ না দেয়ার মতো অবস্থানও নিয়েছে। গভীর সমুদ্রে বন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করলেও চীনের সঙ্গে এ ধরনের কোনো চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। জাপানের মতো বন্ধু রাষ্ট্রও পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের সহায়তা স্থগিত করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ফার্স্ট লেডি হিসেবে দুই দফা বাংলাদেশ সফর করেন। কিন্তু তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর বাংলাদেশ সফরে বারবার অনীহা জানিয়ে এসেছেন। নানা চেষ্টা তদবির করলে সর্বশেষ চলতি মাসের ৫ তারিখ দুইদিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু হিলারির এ সফরে বাংলাদেশ লাভবান হয়নি।
দুর্নীতি ইস্যুতে ও বাংলাদেশের অব্যাহত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম নিয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইইউ’র এ উদ্বেগ কমানোর মতো কোনো কাজ করেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ও সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সম্ভব হয়নি সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সম্প্র্রসারণ; বরং বন্ধ রয়েছে কুয়েত ও সৌদি আরবের বাজার। সেই সঙ্গে ৮ বাংলাদেশী প্রবাসীর শিরশ্ছেদের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঠেকাতে পারেনি এই সরকার। বিভিন্ন কারণে ফিরতে হয়েছে লক্ষাধিক বাংলাদেশিকে। তাদের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় পাঠানোর চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। মূলত সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতায় জনশক্তি রফতানির এ বিপদসঙ্কুল অবস্থা। ভিন্নভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি পাঠানো ছাড়াও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে একাধিকবার সফর করেছেন দীপু মনি। সেখান থেকেও নেই নতুন শ্রমবাজারের ঘোষণা বা অন্য কোনো সুখবর। এছাড়া সম্প্রতি সৌদি এক কূটনীতিক ঢাকায় নিহত হয়েছেন। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কাউকে চিহ্নিত তো দূরের কথা, এ বিষয়ে অগ্রগতির কোনো খবর করতে পারছে না সরকার। বিষয়টি নিয়ে রিয়াদ চরম ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জাপানের সঙ্গেও সম্পর্কে ভাঙন ধরিয়েছে ঢাকা। নিকট অতীতে জাপানের শক্তিশালী ভূমিকম্পের সময় অন্যান্য দেশ সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায়। সহমর্মিতা জানাতে তারা জাপান সফরেরও আগ্রহ দেখায়। তবে জাপান সরকারের পক্ষ থেকেই কয়েক দিন পর সেখানে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু কোনো দেশই তাদের দূতাবাস বন্ধ করেনি। এ সময় ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশের এ ঘোষণায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি এক উপ-প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যেভাবে বিরোধ মেটাতে বলেছেন, জাপানিরা সাধারণত এত কড়া ভাষায় কথা বলেন না।
চীন বাংলাদেশকে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরিতে অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরে এ ধরনের কোনো চুক্তি করতে পারেনি সরকার। বরং গত বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি সাক্ষাত্ করেন তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামার সঙ্গে। বিষয়টি নিজ কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রচারও করেন ওই রাষ্ট্রদূত। তথ্যবিবরণীটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ছাড়া আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয়। কিন্তু চীনের কাছে দালাইলামা নিষিদ্ধ নাম, যেমন তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিষয়টি। এ কারণে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সাক্ষাতের বিষয়টিকে ‘পথ চলতে হঠাত্ দেখা’ বলে দাবি করেন দীপু মনি ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আবুল মোমেন। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
এভাবে একের পর এক বন্ধুপ্রতিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ক শিকেয় তুলেছে বর্তমান সরকার। সবকিছু দিয়ে হলেও ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় চাণক্যপুরীর সঙ্গে। তারপরও যেন মন গলছে না দিল্লির। তিস্তা নিয়ে রীতিমতো প্রতারণামূলক আশ্বাস দিয়ে আসছে নয়াদিল্লি।
কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়লেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভ্রমণবিলাসিতা বন্ধ নেই। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত তিনি শতাধিকবার বিদেশ সফর করেছেন। এরপরও কমপক্ষে ২০ বার বিদেশে গিয়েছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন। গত সাড়ে তিন বছরে তিনি কমপক্ষে ১৫ মাস বিদেশে ছিলেন বলে জানা গেছে। রেকর্ড গড়া এ বিদেশ সফরে দেশের জন্য কোনো অর্জন নেই। বাংলাদেশের আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিদেশ সফরের রেকর্ড অনেক আগেই ভেঙেছেন ডা. দীপু মনি।
ডা. দীপু মনির এই যথেচ্ছ সফরের মধ্যে মাত্র ১৫-১৬ বার গেছেন দ্বিপক্ষীয় সফরে। বাকি সফরে গেছেন তিনি বিভিন্ন সম্মেলন, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে যোগ দিতে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখন আর তার বিদেশ সফরের কোনো হিসাব রাখি না। ৯৭তম সফর পর্যন্ত হিসাব ছিল। এখন আর রাখছি না। গত সাড়ে তিন বছরে দেখা গেছে, কোনো বড় ইনকামিং সফর হয়নি।
বাংলাদেশের বন্ধুহীন হয়ে পড়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভারতের অর্থমন্ত্রী ও জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তারা অনেক কথা বলেছেন। তাদের সিগন্যালগুলো সরকারের বোঝা উচিত। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। জনগণের দুর্দশা বাড়বে।
ভারতের সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘মাঝে মধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, দীপু মনি কি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী? তিনি তিস্তা চুক্তির জন্য ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেনদরবার করবেন কেন? এটা কূটনৈতিক দেউলিয়াত্ব।’
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন