সৈয়দ আবদাল আহমদ
ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের কপালে এঁকে দিয়েছিলেন দুর্নীতির তিলক। ২০০০ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে বিশ্বের এক নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। আর এবার ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনার উপহার দুর্নীতির সঙ্গে যোগ হয়েছে গুম ও হত্যা। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের এখন এটাই পরিচিতি। দুর্নীতির জন্য বাংলাদেশ শিরোনাম হচ্ছে। গুম ও হত্যার জন্য বাংলাদেশ খবর হচ্ছে। সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের নাম।
গত ৫ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ২০ ঘণ্টার ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট নাগরিক এবং তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় হিলারি তার দেশের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে গুম চলতে পারে না এবং চলতে দেয়া যায় না। তিনি গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে গুমের পর নিহত হওয়া এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এ ঘটনাগুলোর যথাযথ ও স্বাধীন তদন্ত হওয়া উচিত। তিনি সরকার ও বিরোধী দলকে মতপার্থক্য দূর করতে সংলাপের তাগিদ দেন। বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে আড্ডায় হিলারি জানান, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বিশেষায়িত মার্কিন সহায়তা তহবিল মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টে (এমসিএ) অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না।
হিলারির আগে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুইয়া ওকাদা। ঢাকা ছাড়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ জরুরি। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জাপানের অর্থায়নের সদ্ব্যবহারের জন্য দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ নিতে হবে। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশকে বিষয়টি ফয়সালা করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমস্যার সমাধান করতে না পারলে জাপানের একার পক্ষে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করা সম্ভব নয়।
৯ মে বুধবার ঢাকার একটি হোটেলে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ৯ জন রাষ্ট্রদূত। তারা জোরালভাবে বলেছেন, গুম, হত্যা, সহিংসতা ও দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে বাংলাদেশ। পত্রিকা খুললেই দুর্নীতি, গুম, হত্যার খবর চোখে পড়ে। আর বাংলাদেশের এই নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। ইলিয়াস আলী গুম ও আমিনুল ইসলামের গুপ্তহত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরা বলেন, উভয় ঘটনার সঠিক তদন্ত হতে হবে। দুর্নীতির ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিরো টলারেন্স দেখাবে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
দুর্নীতি ও গুমের ঘটনা নিয়ে যখন বিদেশি নেতৃবৃন্দ এ বক্তব্য দিচ্ছেন, ঠিক সে সময়ে বিশ্বব্যাংক আবারও সরকারকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দুর্নীতির প্রমাণ দিয়েছে। দুর্নীতির প্রমাণ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হাতে সরাসরি দেয়া হয়। এই প্রতিবেদনে দায়ী কিছু ব্যক্তির নামসহ দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিশ্বব্যাংক একইসঙ্গে দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও তাগিদ দিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, তহবিলের অর্থ পেতে হলে সরকারকে অবশ্যই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের এ দেশীয় পরিচালক অ্যানেল গোল্ডস্টেইন একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, বিশ্বব্যাংক যখন তার কোনো প্রকল্পে গুরুতর ও বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতির প্রমাণ পায়, তখন আমরা সদস্য দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছে তদন্তের ফলাফল বা তথ্যাদি পেশ করি। পদ্মা সেতুর ব্যাপারেও আমরা একই পথ অনুসরণ করেছি। আমরা প্রত্যাশা করি, দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনবে কর্তৃপক্ষ। এদিকে খবর বের হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীকে ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়েছিল আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে তদবিরের জন্য। তদবির ছিল পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থ যাতে ছাড় করা হয় তার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু ড. গওহর রিজভীর দৌড়ঝাঁপ কাজে আসেনি। তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। বিশ্বব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে তারা ফান্ড প্রত্যাহার করবে।
দুর্নীতি সত্যিই বাংলাদেশের মান-মর্যাদা একেবারে ভূলুণ্ঠিত করে দিচ্ছে। পুরো সরকারই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে না। প্রকল্প মানেই দুর্নীতি। হাতে গোনা দু-একজন মন্ত্রী ছাড়া সবার নামেই আছে দুর্নীতির অভিযোগ। শুধু পার্থক্য, কেউ কম দুর্নীতি করছেন, কেউ বেশি।
গত কিছুদিনের দৈনিক পত্রিকাগুলোয় দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে এমন কোনো পত্রিকা নেই, যেখানে দুর্নীতির রিপোর্ট নেই। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারি তো দিনের পর দিন পত্রিকাগুলোয় ছাপা হয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের দুর্নীতির খবর তো দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। অভিযোগ আছে, ক্ষমতাসীনরা রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। দুর্নীতি করার জন্য নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এসব বিদ্যুেকন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুত্ কিনছে। ফলে প্রতিবছর ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও ঘনিষ্ঠদের তিনটি রেন্টাল ও ১৭টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল দুর্নীতির বিষয়টি সংসদেও উঠেছে। সিপিবি সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এ নিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র দুর্নীতি ও ডাকাতির মাধ্যমে সরকার মূলত আগামী নির্বাচনের তহবিল গঠন করেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির যে অভিযোগ ওঠে তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। অভিযোগটি ওঠার পর বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করে। আর অভিযোগটি প্রমাণ হওয়ায় এখন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ফান্ড প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। এই দুর্নীতির কারণে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিতে সরকার বাধ্য হয়।
একইভাবে টেলিকম সেক্টরে দুর্নীতিও দেশের একটি আলোচিত বিষয়। এ খাত থেকে শত শত কোটি টাকা দুর্নীতি হচ্ছে। অবৈধ ভিওআইপির দুর্নীতির টাকার ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি অনেকটা ওপেন-সিক্রেট। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে টেলিকমিউনিকেশন গেটওয়ে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এ লাইসেন্সও পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, নেতা কিংবা আত্মীয়রা। এখানে যেমন কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, তেমনি অনেকে এসব কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করছেন দুর্নীতির টাকায়। মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছেলেও এ ধরনের একটি লাইসেন্স পেয়েছেন এবং দুর্নীতির বিষয় নিয়ে দুদকে তদন্ত হচ্ছে। সরকার সম্প্রতি ৯টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে। একেকটি ব্যাংকের ৪০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। যারা ব্যাংকগুলো পেয়েছেন, তারা সবারই পরিচিত। এ ৪০০ কোটি টাকা তারা কোথায় পেলেন, এ সম্পদের মালিক তারা কীভাবে হলেন, অনুসন্ধান করলে তা বেরিয়ে যাবে। এভাবে দুর্নীতির উদাহরণ আছে শত শত। দুর্নীতি এত হচ্ছে যে এগুলো আর চাপিয়ে রাখা যাচ্ছে না। দেশের বিরোধী দল কিংবা বিভিন্ন মহল থেকেই দুর্নীতির কথা উঠছে না; বিদেশিদের কাছেও দুর্নীতির প্রমাণ চলে গেছে। ফলে তারা বাংলাদেশের এ দুর্নীতির কথা অবলীলায় বলছেন। শেয়ারবাজার লুটের কারণে আজ ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পথে বসেছে। অথচ হাতে গোনা দুর্নীতিবাজদের কোনো বিচার হয়নি।
এটা আজ অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে বাংলাদেশ সফরে এসে বলে যেতে হচ্ছে—দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বিশেষায়িত মার্কিন তহবিল মিলেনিয়াম সহায়তা থেকে বঞ্চিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৯ জন রাষ্ট্রদূতকে সংবাদ সম্মেলন করে বলতে হচ্ছে দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়ে গেছে। আজ হিলারি ক্লিনটনকে বলতে হচ্ছে বাংলাদেশে সুশাসনের বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গুণগত মান ভালো নয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে ইলিয়াস আলীর গুম ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের গুপ্ত হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে হবে স্বাধীনভাবে, যথাযথভাবে। তাকে বলতে হচ্ছে, এ ধরনের গুম কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চলতে পারে না। হত্যা ও গুমের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
সত্যিই গুম ও হত্যা শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে মহামারী আকার ধারণ করেছে। ২০১০ সাল থেকে ইলিয়াস আলীর ঘটনা পর্যন্ত ১২২ জন শুধু গুমেরই শিকার হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত গুম হয়েছে ২২ জন। প্রতিদিনই অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যাচ্ছে বিল-ঝিল কিংবা ডোবা-নালায়। আশুলিয়ার বেড়িবাঁধ এখন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। তেমনি ঢাকা-আরিচা সড়কের দু’পাশে পাওয়া যাচ্ছে অজ্ঞাত লাশ। পুলিশের হিসাবেই সারা দেশে দিনে অন্তত ১৫টি খুন হচ্ছে। এই যে এত গুম, এত হত্যাকাণ্ড এবং লাশ পাওয়ার ঘটনা ঘটছে, সরকার কেমন যেন নির্বিকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেই যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। এই তো গতকাল বৃহস্পতিবারের পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছে তিনি বলছেন—আমি সবচেয়ে সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ধরনের মন্তব্য করতে লজ্জাও লাগছে না তার। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যার তিন মাস হয়ে যাচ্ছে। অথচ তিনি বলেছিলেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনি ধরা পড়বে। রাজধানীর একটি ফ্ল্যাটের বেডরুমে এ চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডটি ঘটল। তার কোনো কূল-কিনারা আজ অবধি হয়নি। উচ্চ আদালতে পুলিশের তদন্ত সংস্থার লোকজন গিয়ে বলল, তদন্তে আমরা ব্যর্থ। কিন্তু এ ব্যর্থতার জন্য তাদের কোনো জবাবদিহি করতে পর্যন্ত হলো না। আগামীতে কে গুম হয়, কে লাশ হয়—সেই ভয় আজ প্রতিটি নাগরিকের। কিন্তু তাকে সাহস জোগানোর কেউ নেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
গত ৫ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ২০ ঘণ্টার ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট নাগরিক এবং তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় হিলারি তার দেশের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে গুম চলতে পারে না এবং চলতে দেয়া যায় না। তিনি গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে গুমের পর নিহত হওয়া এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এ ঘটনাগুলোর যথাযথ ও স্বাধীন তদন্ত হওয়া উচিত। তিনি সরকার ও বিরোধী দলকে মতপার্থক্য দূর করতে সংলাপের তাগিদ দেন। বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে আড্ডায় হিলারি জানান, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বিশেষায়িত মার্কিন সহায়তা তহবিল মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টে (এমসিএ) অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না।
হিলারির আগে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুইয়া ওকাদা। ঢাকা ছাড়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ জরুরি। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জাপানের অর্থায়নের সদ্ব্যবহারের জন্য দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ নিতে হবে। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশকে বিষয়টি ফয়সালা করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমস্যার সমাধান করতে না পারলে জাপানের একার পক্ষে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করা সম্ভব নয়।
৯ মে বুধবার ঢাকার একটি হোটেলে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ৯ জন রাষ্ট্রদূত। তারা জোরালভাবে বলেছেন, গুম, হত্যা, সহিংসতা ও দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে বাংলাদেশ। পত্রিকা খুললেই দুর্নীতি, গুম, হত্যার খবর চোখে পড়ে। আর বাংলাদেশের এই নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। ইলিয়াস আলী গুম ও আমিনুল ইসলামের গুপ্তহত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরা বলেন, উভয় ঘটনার সঠিক তদন্ত হতে হবে। দুর্নীতির ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিরো টলারেন্স দেখাবে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
দুর্নীতি ও গুমের ঘটনা নিয়ে যখন বিদেশি নেতৃবৃন্দ এ বক্তব্য দিচ্ছেন, ঠিক সে সময়ে বিশ্বব্যাংক আবারও সরকারকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দুর্নীতির প্রমাণ দিয়েছে। দুর্নীতির প্রমাণ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হাতে সরাসরি দেয়া হয়। এই প্রতিবেদনে দায়ী কিছু ব্যক্তির নামসহ দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিশ্বব্যাংক একইসঙ্গে দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও তাগিদ দিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, তহবিলের অর্থ পেতে হলে সরকারকে অবশ্যই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের এ দেশীয় পরিচালক অ্যানেল গোল্ডস্টেইন একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, বিশ্বব্যাংক যখন তার কোনো প্রকল্পে গুরুতর ও বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতির প্রমাণ পায়, তখন আমরা সদস্য দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছে তদন্তের ফলাফল বা তথ্যাদি পেশ করি। পদ্মা সেতুর ব্যাপারেও আমরা একই পথ অনুসরণ করেছি। আমরা প্রত্যাশা করি, দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনবে কর্তৃপক্ষ। এদিকে খবর বের হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীকে ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়েছিল আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে তদবিরের জন্য। তদবির ছিল পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থ যাতে ছাড় করা হয় তার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু ড. গওহর রিজভীর দৌড়ঝাঁপ কাজে আসেনি। তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। বিশ্বব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে তারা ফান্ড প্রত্যাহার করবে।
দুর্নীতি সত্যিই বাংলাদেশের মান-মর্যাদা একেবারে ভূলুণ্ঠিত করে দিচ্ছে। পুরো সরকারই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে না। প্রকল্প মানেই দুর্নীতি। হাতে গোনা দু-একজন মন্ত্রী ছাড়া সবার নামেই আছে দুর্নীতির অভিযোগ। শুধু পার্থক্য, কেউ কম দুর্নীতি করছেন, কেউ বেশি।
গত কিছুদিনের দৈনিক পত্রিকাগুলোয় দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে এমন কোনো পত্রিকা নেই, যেখানে দুর্নীতির রিপোর্ট নেই। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারি তো দিনের পর দিন পত্রিকাগুলোয় ছাপা হয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের দুর্নীতির খবর তো দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। অভিযোগ আছে, ক্ষমতাসীনরা রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। দুর্নীতি করার জন্য নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এসব বিদ্যুেকন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুত্ কিনছে। ফলে প্রতিবছর ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও ঘনিষ্ঠদের তিনটি রেন্টাল ও ১৭টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল দুর্নীতির বিষয়টি সংসদেও উঠেছে। সিপিবি সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এ নিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র দুর্নীতি ও ডাকাতির মাধ্যমে সরকার মূলত আগামী নির্বাচনের তহবিল গঠন করেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির যে অভিযোগ ওঠে তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। অভিযোগটি ওঠার পর বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করে। আর অভিযোগটি প্রমাণ হওয়ায় এখন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ফান্ড প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। এই দুর্নীতির কারণে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিতে সরকার বাধ্য হয়।
একইভাবে টেলিকম সেক্টরে দুর্নীতিও দেশের একটি আলোচিত বিষয়। এ খাত থেকে শত শত কোটি টাকা দুর্নীতি হচ্ছে। অবৈধ ভিওআইপির দুর্নীতির টাকার ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি অনেকটা ওপেন-সিক্রেট। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে টেলিকমিউনিকেশন গেটওয়ে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এ লাইসেন্সও পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, নেতা কিংবা আত্মীয়রা। এখানে যেমন কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, তেমনি অনেকে এসব কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করছেন দুর্নীতির টাকায়। মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছেলেও এ ধরনের একটি লাইসেন্স পেয়েছেন এবং দুর্নীতির বিষয় নিয়ে দুদকে তদন্ত হচ্ছে। সরকার সম্প্রতি ৯টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে। একেকটি ব্যাংকের ৪০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। যারা ব্যাংকগুলো পেয়েছেন, তারা সবারই পরিচিত। এ ৪০০ কোটি টাকা তারা কোথায় পেলেন, এ সম্পদের মালিক তারা কীভাবে হলেন, অনুসন্ধান করলে তা বেরিয়ে যাবে। এভাবে দুর্নীতির উদাহরণ আছে শত শত। দুর্নীতি এত হচ্ছে যে এগুলো আর চাপিয়ে রাখা যাচ্ছে না। দেশের বিরোধী দল কিংবা বিভিন্ন মহল থেকেই দুর্নীতির কথা উঠছে না; বিদেশিদের কাছেও দুর্নীতির প্রমাণ চলে গেছে। ফলে তারা বাংলাদেশের এ দুর্নীতির কথা অবলীলায় বলছেন। শেয়ারবাজার লুটের কারণে আজ ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পথে বসেছে। অথচ হাতে গোনা দুর্নীতিবাজদের কোনো বিচার হয়নি।
এটা আজ অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে বাংলাদেশ সফরে এসে বলে যেতে হচ্ছে—দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বিশেষায়িত মার্কিন তহবিল মিলেনিয়াম সহায়তা থেকে বঞ্চিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৯ জন রাষ্ট্রদূতকে সংবাদ সম্মেলন করে বলতে হচ্ছে দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়ে গেছে। আজ হিলারি ক্লিনটনকে বলতে হচ্ছে বাংলাদেশে সুশাসনের বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গুণগত মান ভালো নয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে ইলিয়াস আলীর গুম ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের গুপ্ত হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে হবে স্বাধীনভাবে, যথাযথভাবে। তাকে বলতে হচ্ছে, এ ধরনের গুম কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চলতে পারে না। হত্যা ও গুমের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
সত্যিই গুম ও হত্যা শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে মহামারী আকার ধারণ করেছে। ২০১০ সাল থেকে ইলিয়াস আলীর ঘটনা পর্যন্ত ১২২ জন শুধু গুমেরই শিকার হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত গুম হয়েছে ২২ জন। প্রতিদিনই অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যাচ্ছে বিল-ঝিল কিংবা ডোবা-নালায়। আশুলিয়ার বেড়িবাঁধ এখন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। তেমনি ঢাকা-আরিচা সড়কের দু’পাশে পাওয়া যাচ্ছে অজ্ঞাত লাশ। পুলিশের হিসাবেই সারা দেশে দিনে অন্তত ১৫টি খুন হচ্ছে। এই যে এত গুম, এত হত্যাকাণ্ড এবং লাশ পাওয়ার ঘটনা ঘটছে, সরকার কেমন যেন নির্বিকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেই যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। এই তো গতকাল বৃহস্পতিবারের পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছে তিনি বলছেন—আমি সবচেয়ে সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ধরনের মন্তব্য করতে লজ্জাও লাগছে না তার। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যার তিন মাস হয়ে যাচ্ছে। অথচ তিনি বলেছিলেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনি ধরা পড়বে। রাজধানীর একটি ফ্ল্যাটের বেডরুমে এ চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডটি ঘটল। তার কোনো কূল-কিনারা আজ অবধি হয়নি। উচ্চ আদালতে পুলিশের তদন্ত সংস্থার লোকজন গিয়ে বলল, তদন্তে আমরা ব্যর্থ। কিন্তু এ ব্যর্থতার জন্য তাদের কোনো জবাবদিহি করতে পর্যন্ত হলো না। আগামীতে কে গুম হয়, কে লাশ হয়—সেই ভয় আজ প্রতিটি নাগরিকের। কিন্তু তাকে সাহস জোগানোর কেউ নেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন