॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার চরণ আছে, ‘জীবনের নিঃসঙ্গ ভেলায়/বেহুলাও নেই সাথে/লখিন্দর একা ভেসে যায়।’ এটি ছিল ব্যক্তিমানুষের আধুনিক জীবনবোধের কবিতা। মানুষ নিরন্তর নিঃসঙ্গ। আধুনিকতার পরিমাপও করা হয় নিঃসঙ্গতা বিবেচনায়। সে অর্থে বর্তমান বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ ভারি নিঃসঙ্গ। তাদের খামখেয়ালি, দায়িত্বহীন ধারাবাহিক উক্তি সমাজকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যে, তাদের সাথে এখন আর কেউ নেই।
আমরা লিখেছিলাম, মহাজোটের যাত্রাপথে বড় বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। তাদের নীতির সাথে, তাদের কার্যক্রমের সাথে, আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত দলছুট তথাকথিত বামপন্থী দিলীপ বড়–য়া ছাড়া আর কেউ নেই। এরশাদ, মেনন, ইনুÑ তারাও এখন আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার দায় নিতে কিছুতেই রাজি নন। আওয়ামী লীগের অতি পেয়ারের লোক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সম্প্রতি সুর বদলে ফেলেছেন। তার দলের নেতারা ইতোমধ্যে বলতে শুরু করেছেন, মহাজোটকে তালাক দেয়ার সময় তাদের হয়ে এসেছে। মহাজোটে থাকার আর কোনো পরিবেশ তাদের জন্য নেই। এরশাদও এমন কথা বলেননি, তা নয়। কিন্তু ক’দিন আগে শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ দিনের মিত্র আপন ভাইয়ের দাবিদার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে শাসিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি যেন তার দলের নেতাদের এমন কথা বলতে বারণ করে দেন। বারণ হয়তো তিনি করবেন কিন্তু সব নেতা সে বারণ অনুসরণ করতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে।
সরকারের জন্য একধরনের অশনিসঙ্কেতও আছে। এরশাদের আবার নানা সমস্যা। তাকে নয় বছর মতায় রাখতে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ যে প্রাণান্ত কোশেশ চালিয়েছে, সেটি কারো অজানা নয়। গণতন্ত্র হরণ করে বিএনপির নির্বাচিত বিচারপতি সাত্তার সরকারকে হটিয়ে যখন এরশাদ মতায় বসেন, তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’। অর্থাৎ হ্যাপি বা সুখী হয়েছিলেন তিনি। গণতন্ত্র যাক। বিএনপি তো গেছে। এরশাদ মতাসীন থাকাকালে সব দলের লোকজন নিয়ে জাতীয় পার্টি করেছিলেন। রংপুর অঞ্চলের মানুষের ভাষ্য হলো, সইল্ খারাপ হয়েছে বলে কি তাকে ফেইলে দেবো? তাই খারাপ হলেও এরশাদকেই তারা ভোট দিয়েছেন। জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি যে ক’টি আসন পায় তার সব ক’টি বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে। এর বাইরে খারাপ সইলের কেউ খবর রাখে না। এরশাদের কোনো জনসমর্থনও নেই।
শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাড়ি রংপুরে। সেই সুবাদে এরশাদ তার অতি আপনজন। মতাচ্যুত হওয়ার পর এই ২২ বছর ধরে শেখ হাসিনাকে কেবলই তার একেবারেই আপন বোন হিসেবে সম্বোধন করে আসছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি অকৃতজ্ঞ নন। শেখ হাসিনা যে তাকে নয় বছর স্বৈরশাসন চালানোর সময় সমর্থন দিয়েছিলেন, সে কথা ভোলেননি তিনি। শেখ হাসিনা তাকে মতায় থাকতে আন্তরিক সহযোগিতা করেছিলেন। কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধ হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শত কথা বললেও মহাজোট সরকারের প্রতি তার সমর্থন অব্যাহতই রেখেছেন।
তার দলের নেতাকর্মীরা যদি দু-চারটা এদিক-ওদিক কথা না বলেন, তাহলে তাদেরও তো রাজনীতি টেকে না। ফলে দু-চার কথা তারা বলছেন। শেখ হাসিনার এখন ঘোর দুর্দিন। ফলে এরশাদের মৌখিক সমর্থন হলেও তার খুব প্রয়োজন। এ েেত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদেরও সঙ্গী-সাথীর বড় অভাব। মেনন-ইনু বিশাল বিপ্লবী নেতা মুজিব কোটটা পরেননি, এই যা রা। কিন্তু তারা নির্বাচনী পোস্টার ছেপেছিলেন এক পাশে শেখ হাসিনার ছবি, অপর পাশে তাদের, মাঝখানে নৌকা। রাজনীতিতে ভাঁড় আর কাকে বলে!
কিন্তু এই রাজনৈতিক ভাঁড়েরাও এখন ভাবতে শুরু করছেন যে, তাদের অতীত গৌরবময় কর্মকাণ্ডের জন্য মানুষ তাদের যতটা বাহবা দেয়, তার সব কিছু মুছে যাবে বিনা প্রশ্নে সরকারকে অব্যাহত সমর্থন জানিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই। ‘বিপ্লবী’ রাশেদ খান মেনন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক অনুসারী ছিলেন। মস্কোপন্থী-পিকিংপন্থী বিবেচনায় ষাটের দশকে যখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ভাগ হয়ে যায়, তখন পিকিংপন্থী অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাশেদ খান মেনন। রাশিয়া-ভারতের পদলেহন তখন তিনি করেননি বলেই আমরা জানি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা হাসানুল হক ইনু ১৯৭৩-৭৪ সালে শেখ মুজিবের দুঃশাসন, রীবাহিনীর অত্যাচার, নিপীড়ন, গুপ্তহত্যা, গুম প্রভৃতি ঘটনার প্রতিকারে গঠন করেছিলেন গণবাহিনী। আত্মরার্থে সেই গণবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন হাজার হাজার তরুণ, যারা শেখ মুজিবের অত্যাচার থেকে, রীবাহিনীর বর্বরতা থেকে নিজেদের এবং সেই সাথে জনগণকে রা করার সঙ্কল্প করেছিলেন। সে গণবাহিনী শেখ মুজিবের স্বৈরশাসন, রীবাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এমন কাহিনীও শোনা যায়, দেশের অনেক অঞ্চলের মানুষ রীবাহিনীর নির্যাতন থেকে নিজেদের রার জন্য তাদের গ্রামে গণবাহিনী ডেকে আনতেন। পোষা খাসি জবাই করে খাওয়াতেন। আর গণবাহিনী এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল যে, যে গ্রামে ওই বাহিনী আছে সে গ্রামে আক্রমণ চালাতে ভয় পেত রীবাহিনী। গণবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে হাসানুল হক ইনু ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। এখন নৌকা মার্কায় নির্বাচিত আত্মবিলীনকারী এক পতিত নত্র তিনি। মানুষ এদের কর্মকাণ্ড অবাক বিস্ময়ে ল করছে।
এই সরকারের দুঃশাসন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। শেখ হাসিনার সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, খুন, গুম এখন রীবাহিনীকেও হার মানিয়েছে। র্যাব-পুলিশকে এমনকি বিচার বিভাগকে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। নির্লজ্জ দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসন ও এসব বাহিনীকে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। চেইন অব কমান্ড সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে ওসি প্রশাসন ক্যাডারের এসি (ল্যান্ড)কে কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড়-লাথি মারতেও কসুর করছেন না। সাধারণ মানুষের অবস্থা আরো ভয়াবহ। পুলিশ কিংবা র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বড় বড় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। এর মধ্যে আবার আছে গোপালি সিনড্রোম। যে পুলিশ কনস্টেবলের বাড়ি গোপালগঞ্জ সে ওসিকে থোড়াই পরোয়া করে। ট্রাফিক জ্যামে দুই পুলিশ কনস্টেবলের তর্কাতর্কি শুনছিলাম। কী নিয়ে বিবাদ সেটা জানি না। গাড়িতে বসে ঘামতে ঘামতে সে তর্ক উপভোগ করছিলাম। একজন পুলিশ কনস্টেবল শেষ পর্যন্ত রেগেমেগে অন্যজনকে বলল, চুপ করেন মিয়া, আমার বাড়ি কিন্তু হ্যাপার। অর্থাৎ তিনি গোপালি। মানে গোপালগঞ্জের লোক। হ্যাপারওয়ালাদের দাপট বোধ করি এখন সর্বত্রই বিরাজমান।
ফলে হ্যাপারের যারা নন, তাদের ভারি বিপদ হয়েছে। হ্যাপারওয়ালাদের দোর্দণ্ডপ্রতাপে তারা হিমশিম খাচ্ছে। হ্যাপার বিবেচনায় এবং অন্যান্য ভিত্তিতে প্রশাসন দলীয়করণ করার ফলে এখন অচল হয়ে গেছে কার্যত গোটা রাষ্ট্রই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্লজ্জের মতো এক গীতই গাইছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার শিাদীা বিষয়ে প্রশ্ন করা যায়। কারণ শাস্ত্রে আছে, ‘আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়,/লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।’ তার বক্তব্যে চারদিকে ছিছি ঢিঢি পড়ে। লোকে দূর দূর করে। সে এক বিরাট হাস্যরস। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তিনি বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করা হবে। সে সবই ছিল কেবল ধোঁকা আর বাকোয়াজি। তিন মাস হয়ে গেছে খুনিদের টিকিটিরও নাগাল পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দায়ভার নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সে কথা প্রধানমন্ত্রী নিজে অস্বীকার করেননি। যখন তিনি এই ঘোষণা দিলেন, তখন অনেকেই বলাবলি করেছেন, সাগর-রুনি হত্যাকারীর বিচার ডিপ ফ্রিজে ঢুকল। এর আর কোনো কিনারা হবে না।
সাংবাদিকেরা এখনো তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। হত্যাকারীর বিচার চাই। তারা এমনও বলেছেন, সে হত্যাকারী যদি কোনো সাংবাদিকও হয়ে থাকে, তবু তাকে ধরুন। বিচার করুন। হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। কেউ শোনেনি কারো কথা। এর পরে গুম হয়েছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম ইলিয়াস আলী। প্রত্যদর্শীদের স্যা অনুযায়ী এটাই প্রমাণিত হয়, সরকারি বাহিনীই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। এর ধারেকাছেও যায়নি সরকার। এখন সরকারের লোকেরা প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছে, ইলিয়াস আলী নিজেও সন্ত্রাসী ছিলেন। তার লোকেরাই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। আর আজব কথা বলেছেন কোকিলকণ্ঠী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলেছেন, ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনার তদন্তে পুলিশের সময় কোথায়। হরতাল সামাল দিতেই পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে। যার সন্তান হারিয়ে যায়, যার স্বামী নিখোঁজ হয়, যে শিশু পিতৃহারা হয় তার বেদনা বোঝার মতা কি সাহারা খাতুনের আছে?
সরকার ভেবেছিল, ঢোক মেরে সাগর-রুনি কিংবা ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনা তারা গিলে ফেলবেন। কিন্তু সে রকম ঘটেনি। ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় সারা পৃথিবী প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে। কে না জানে যে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে এক বিশাল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারকে মতায় আসীন করেছিল। কিন্তু সেখানে দুঃশাসন, অত্যাচার, নিপীড়ন, গুম, খুন এসব যদি এতটা প্রকোপ রূপ ধারণ করে, তাহলে চুলজ্জার স্বার্থে তাদেরও প্রতিবাদ করতে হয় বৈকি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন। ভারতীয় অর্থমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ শুভকামনাকারী প্রণব মুখার্জি। আর সর্বশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন। প্রণব মুখার্র্জি ছাড়া বাকি সবাই বলেছেন, আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই করতে হবে। গুম, খুন এসব বন্ধ করতে হবে। এ েেত্র হিলারি সরকারের প্রতি অতিরিক্ত সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, গার্মেন্টশ্রমিক কল্যাণ নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যারও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে। তা না হলে বিদেশী ক্রেতাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। বাজার তিগ্রস্ত হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের কথা বলেছে এবং গুম ও খুনের নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছে। যে প্রণব মুখার্র্জি বারবার উচ্চস্বরে বলেছেন, শেখ হাসিনার নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা তিনি করবেন, সেই মুখার্র্জিও সুর সামান্য বদলেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সাথে সমতাভিত্তিক সম্পর্ক চায়।
অর্থাৎ সরকারের পায়ের নিচের মাটি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। যারা গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এ সরকারকে মতাসীন করেছিল, তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিশ্বব্যাংক পরিবর্তনকৃত যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিশাল দুর্নীতির প্রমাণ ২০১১ সালে একবার এবং ২০১২ সালের এপ্রিলে আবার অর্থমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে তার হাতে পৌঁছে দিয়েছে। এই দুর্নীতির সুরাহা না হলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা সবার ঋণ বন্ধ। বাহাত্তরে পাওয়া অর্থমন্ত্রী এখন খামোশ। বিশ্বব্যাংক তার দুর্নীতির প্রমাণে কি হাজির করেছে সে কথা তিনি প্রকাশ করেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর গলায় বলেছিলেন, আদরের আবুল দুর্নীতি করেছে কি না, এটা বললেই তো আর হবে না, প্রমাণ দিতে হবে আবুল দুর্নীতি করেছে। বিশ্বব্যাংক প্রমাণ দিয়েছে। শেখ হাসিনাও খামোশ।
তাহলে এবার? এবার শেখ হাসিনার সরকার তার অপরিসীম দুর্নীতি, স্বৈরাচার, অপশাসন, দুঃশাসনের নিঃসঙ্গ ভেলায় ভারি একা। এতটা একা হয়ে তিনি কতটা পথ পাড়ি দিতে পারবেন, বলতে পারি না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরপদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের হোসেন মিঞা তার ময়না দ্বীপে নতুন এক (সমাজতান্ত্রিক) জনবসতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সেখানে তিনি নতুন মানুষ উৎপাদনের জন্য দরিদ্র জেলে পরিবারের পুরুষ কুবেরকে সাথে নিতে চেয়েছিলেন মাঝি হিসেবে এবং নতুন সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম হিসেবে। কুবেরকে বিদায় দিতে নদীর ঘাটে ছুটে এসেছিল কুবেরের শ্যালিকা কপিলা। হোসেন মিঞা নতুন জনপদ গড়ে তোলার েেত্র কপিলাও শরিক হোক, চেয়েছিলেন। কুবের নৌকায় উঠে বসলে সাথে গেল কপিলা। ‘ছইয়ের মধ্যে গিয়া সে বসিল। কুবেরকে ডাকিয়া বলিল, ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই বলে তার উপন্যাস সমাপ্ত করেছেন যে, ‘হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। একা এত দূরে কুবের পাড়ি দিতে পারিবে না।’
শেখ হাসিনার নৌকা থেকে একে একে সবাই প্রায় নেমে গেছে। তিনি কতটা পথ একা পাড়ি দিতে পারবেন, বলতে পারি না!
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার চরণ আছে, ‘জীবনের নিঃসঙ্গ ভেলায়/বেহুলাও নেই সাথে/লখিন্দর একা ভেসে যায়।’ এটি ছিল ব্যক্তিমানুষের আধুনিক জীবনবোধের কবিতা। মানুষ নিরন্তর নিঃসঙ্গ। আধুনিকতার পরিমাপও করা হয় নিঃসঙ্গতা বিবেচনায়। সে অর্থে বর্তমান বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ ভারি নিঃসঙ্গ। তাদের খামখেয়ালি, দায়িত্বহীন ধারাবাহিক উক্তি সমাজকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যে, তাদের সাথে এখন আর কেউ নেই।
আমরা লিখেছিলাম, মহাজোটের যাত্রাপথে বড় বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। তাদের নীতির সাথে, তাদের কার্যক্রমের সাথে, আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত দলছুট তথাকথিত বামপন্থী দিলীপ বড়–য়া ছাড়া আর কেউ নেই। এরশাদ, মেনন, ইনুÑ তারাও এখন আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার দায় নিতে কিছুতেই রাজি নন। আওয়ামী লীগের অতি পেয়ারের লোক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সম্প্রতি সুর বদলে ফেলেছেন। তার দলের নেতারা ইতোমধ্যে বলতে শুরু করেছেন, মহাজোটকে তালাক দেয়ার সময় তাদের হয়ে এসেছে। মহাজোটে থাকার আর কোনো পরিবেশ তাদের জন্য নেই। এরশাদও এমন কথা বলেননি, তা নয়। কিন্তু ক’দিন আগে শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ দিনের মিত্র আপন ভাইয়ের দাবিদার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে শাসিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি যেন তার দলের নেতাদের এমন কথা বলতে বারণ করে দেন। বারণ হয়তো তিনি করবেন কিন্তু সব নেতা সে বারণ অনুসরণ করতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে।
সরকারের জন্য একধরনের অশনিসঙ্কেতও আছে। এরশাদের আবার নানা সমস্যা। তাকে নয় বছর মতায় রাখতে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ যে প্রাণান্ত কোশেশ চালিয়েছে, সেটি কারো অজানা নয়। গণতন্ত্র হরণ করে বিএনপির নির্বাচিত বিচারপতি সাত্তার সরকারকে হটিয়ে যখন এরশাদ মতায় বসেন, তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’। অর্থাৎ হ্যাপি বা সুখী হয়েছিলেন তিনি। গণতন্ত্র যাক। বিএনপি তো গেছে। এরশাদ মতাসীন থাকাকালে সব দলের লোকজন নিয়ে জাতীয় পার্টি করেছিলেন। রংপুর অঞ্চলের মানুষের ভাষ্য হলো, সইল্ খারাপ হয়েছে বলে কি তাকে ফেইলে দেবো? তাই খারাপ হলেও এরশাদকেই তারা ভোট দিয়েছেন। জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি যে ক’টি আসন পায় তার সব ক’টি বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে। এর বাইরে খারাপ সইলের কেউ খবর রাখে না। এরশাদের কোনো জনসমর্থনও নেই।
শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাড়ি রংপুরে। সেই সুবাদে এরশাদ তার অতি আপনজন। মতাচ্যুত হওয়ার পর এই ২২ বছর ধরে শেখ হাসিনাকে কেবলই তার একেবারেই আপন বোন হিসেবে সম্বোধন করে আসছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি অকৃতজ্ঞ নন। শেখ হাসিনা যে তাকে নয় বছর স্বৈরশাসন চালানোর সময় সমর্থন দিয়েছিলেন, সে কথা ভোলেননি তিনি। শেখ হাসিনা তাকে মতায় থাকতে আন্তরিক সহযোগিতা করেছিলেন। কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধ হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শত কথা বললেও মহাজোট সরকারের প্রতি তার সমর্থন অব্যাহতই রেখেছেন।
তার দলের নেতাকর্মীরা যদি দু-চারটা এদিক-ওদিক কথা না বলেন, তাহলে তাদেরও তো রাজনীতি টেকে না। ফলে দু-চার কথা তারা বলছেন। শেখ হাসিনার এখন ঘোর দুর্দিন। ফলে এরশাদের মৌখিক সমর্থন হলেও তার খুব প্রয়োজন। এ েেত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদেরও সঙ্গী-সাথীর বড় অভাব। মেনন-ইনু বিশাল বিপ্লবী নেতা মুজিব কোটটা পরেননি, এই যা রা। কিন্তু তারা নির্বাচনী পোস্টার ছেপেছিলেন এক পাশে শেখ হাসিনার ছবি, অপর পাশে তাদের, মাঝখানে নৌকা। রাজনীতিতে ভাঁড় আর কাকে বলে!
কিন্তু এই রাজনৈতিক ভাঁড়েরাও এখন ভাবতে শুরু করছেন যে, তাদের অতীত গৌরবময় কর্মকাণ্ডের জন্য মানুষ তাদের যতটা বাহবা দেয়, তার সব কিছু মুছে যাবে বিনা প্রশ্নে সরকারকে অব্যাহত সমর্থন জানিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই। ‘বিপ্লবী’ রাশেদ খান মেনন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক অনুসারী ছিলেন। মস্কোপন্থী-পিকিংপন্থী বিবেচনায় ষাটের দশকে যখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ভাগ হয়ে যায়, তখন পিকিংপন্থী অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাশেদ খান মেনন। রাশিয়া-ভারতের পদলেহন তখন তিনি করেননি বলেই আমরা জানি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা হাসানুল হক ইনু ১৯৭৩-৭৪ সালে শেখ মুজিবের দুঃশাসন, রীবাহিনীর অত্যাচার, নিপীড়ন, গুপ্তহত্যা, গুম প্রভৃতি ঘটনার প্রতিকারে গঠন করেছিলেন গণবাহিনী। আত্মরার্থে সেই গণবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন হাজার হাজার তরুণ, যারা শেখ মুজিবের অত্যাচার থেকে, রীবাহিনীর বর্বরতা থেকে নিজেদের এবং সেই সাথে জনগণকে রা করার সঙ্কল্প করেছিলেন। সে গণবাহিনী শেখ মুজিবের স্বৈরশাসন, রীবাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এমন কাহিনীও শোনা যায়, দেশের অনেক অঞ্চলের মানুষ রীবাহিনীর নির্যাতন থেকে নিজেদের রার জন্য তাদের গ্রামে গণবাহিনী ডেকে আনতেন। পোষা খাসি জবাই করে খাওয়াতেন। আর গণবাহিনী এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল যে, যে গ্রামে ওই বাহিনী আছে সে গ্রামে আক্রমণ চালাতে ভয় পেত রীবাহিনী। গণবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে হাসানুল হক ইনু ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। এখন নৌকা মার্কায় নির্বাচিত আত্মবিলীনকারী এক পতিত নত্র তিনি। মানুষ এদের কর্মকাণ্ড অবাক বিস্ময়ে ল করছে।
এই সরকারের দুঃশাসন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। শেখ হাসিনার সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, খুন, গুম এখন রীবাহিনীকেও হার মানিয়েছে। র্যাব-পুলিশকে এমনকি বিচার বিভাগকে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। নির্লজ্জ দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসন ও এসব বাহিনীকে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। চেইন অব কমান্ড সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে ওসি প্রশাসন ক্যাডারের এসি (ল্যান্ড)কে কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড়-লাথি মারতেও কসুর করছেন না। সাধারণ মানুষের অবস্থা আরো ভয়াবহ। পুলিশ কিংবা র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বড় বড় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। এর মধ্যে আবার আছে গোপালি সিনড্রোম। যে পুলিশ কনস্টেবলের বাড়ি গোপালগঞ্জ সে ওসিকে থোড়াই পরোয়া করে। ট্রাফিক জ্যামে দুই পুলিশ কনস্টেবলের তর্কাতর্কি শুনছিলাম। কী নিয়ে বিবাদ সেটা জানি না। গাড়িতে বসে ঘামতে ঘামতে সে তর্ক উপভোগ করছিলাম। একজন পুলিশ কনস্টেবল শেষ পর্যন্ত রেগেমেগে অন্যজনকে বলল, চুপ করেন মিয়া, আমার বাড়ি কিন্তু হ্যাপার। অর্থাৎ তিনি গোপালি। মানে গোপালগঞ্জের লোক। হ্যাপারওয়ালাদের দাপট বোধ করি এখন সর্বত্রই বিরাজমান।
ফলে হ্যাপারের যারা নন, তাদের ভারি বিপদ হয়েছে। হ্যাপারওয়ালাদের দোর্দণ্ডপ্রতাপে তারা হিমশিম খাচ্ছে। হ্যাপার বিবেচনায় এবং অন্যান্য ভিত্তিতে প্রশাসন দলীয়করণ করার ফলে এখন অচল হয়ে গেছে কার্যত গোটা রাষ্ট্রই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্লজ্জের মতো এক গীতই গাইছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার শিাদীা বিষয়ে প্রশ্ন করা যায়। কারণ শাস্ত্রে আছে, ‘আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়,/লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।’ তার বক্তব্যে চারদিকে ছিছি ঢিঢি পড়ে। লোকে দূর দূর করে। সে এক বিরাট হাস্যরস। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তিনি বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করা হবে। সে সবই ছিল কেবল ধোঁকা আর বাকোয়াজি। তিন মাস হয়ে গেছে খুনিদের টিকিটিরও নাগাল পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দায়ভার নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সে কথা প্রধানমন্ত্রী নিজে অস্বীকার করেননি। যখন তিনি এই ঘোষণা দিলেন, তখন অনেকেই বলাবলি করেছেন, সাগর-রুনি হত্যাকারীর বিচার ডিপ ফ্রিজে ঢুকল। এর আর কোনো কিনারা হবে না।
সাংবাদিকেরা এখনো তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। হত্যাকারীর বিচার চাই। তারা এমনও বলেছেন, সে হত্যাকারী যদি কোনো সাংবাদিকও হয়ে থাকে, তবু তাকে ধরুন। বিচার করুন। হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। কেউ শোনেনি কারো কথা। এর পরে গুম হয়েছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম ইলিয়াস আলী। প্রত্যদর্শীদের স্যা অনুযায়ী এটাই প্রমাণিত হয়, সরকারি বাহিনীই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। এর ধারেকাছেও যায়নি সরকার। এখন সরকারের লোকেরা প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছে, ইলিয়াস আলী নিজেও সন্ত্রাসী ছিলেন। তার লোকেরাই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। আর আজব কথা বলেছেন কোকিলকণ্ঠী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলেছেন, ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনার তদন্তে পুলিশের সময় কোথায়। হরতাল সামাল দিতেই পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে। যার সন্তান হারিয়ে যায়, যার স্বামী নিখোঁজ হয়, যে শিশু পিতৃহারা হয় তার বেদনা বোঝার মতা কি সাহারা খাতুনের আছে?
সরকার ভেবেছিল, ঢোক মেরে সাগর-রুনি কিংবা ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনা তারা গিলে ফেলবেন। কিন্তু সে রকম ঘটেনি। ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় সারা পৃথিবী প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে। কে না জানে যে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে এক বিশাল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারকে মতায় আসীন করেছিল। কিন্তু সেখানে দুঃশাসন, অত্যাচার, নিপীড়ন, গুম, খুন এসব যদি এতটা প্রকোপ রূপ ধারণ করে, তাহলে চুলজ্জার স্বার্থে তাদেরও প্রতিবাদ করতে হয় বৈকি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন। ভারতীয় অর্থমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ শুভকামনাকারী প্রণব মুখার্জি। আর সর্বশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন। প্রণব মুখার্র্জি ছাড়া বাকি সবাই বলেছেন, আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই করতে হবে। গুম, খুন এসব বন্ধ করতে হবে। এ েেত্র হিলারি সরকারের প্রতি অতিরিক্ত সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, গার্মেন্টশ্রমিক কল্যাণ নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যারও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে। তা না হলে বিদেশী ক্রেতাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। বাজার তিগ্রস্ত হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের কথা বলেছে এবং গুম ও খুনের নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছে। যে প্রণব মুখার্র্জি বারবার উচ্চস্বরে বলেছেন, শেখ হাসিনার নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা তিনি করবেন, সেই মুখার্র্জিও সুর সামান্য বদলেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সাথে সমতাভিত্তিক সম্পর্ক চায়।
অর্থাৎ সরকারের পায়ের নিচের মাটি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। যারা গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এ সরকারকে মতাসীন করেছিল, তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিশ্বব্যাংক পরিবর্তনকৃত যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিশাল দুর্নীতির প্রমাণ ২০১১ সালে একবার এবং ২০১২ সালের এপ্রিলে আবার অর্থমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে তার হাতে পৌঁছে দিয়েছে। এই দুর্নীতির সুরাহা না হলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা সবার ঋণ বন্ধ। বাহাত্তরে পাওয়া অর্থমন্ত্রী এখন খামোশ। বিশ্বব্যাংক তার দুর্নীতির প্রমাণে কি হাজির করেছে সে কথা তিনি প্রকাশ করেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর গলায় বলেছিলেন, আদরের আবুল দুর্নীতি করেছে কি না, এটা বললেই তো আর হবে না, প্রমাণ দিতে হবে আবুল দুর্নীতি করেছে। বিশ্বব্যাংক প্রমাণ দিয়েছে। শেখ হাসিনাও খামোশ।
তাহলে এবার? এবার শেখ হাসিনার সরকার তার অপরিসীম দুর্নীতি, স্বৈরাচার, অপশাসন, দুঃশাসনের নিঃসঙ্গ ভেলায় ভারি একা। এতটা একা হয়ে তিনি কতটা পথ পাড়ি দিতে পারবেন, বলতে পারি না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরপদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের হোসেন মিঞা তার ময়না দ্বীপে নতুন এক (সমাজতান্ত্রিক) জনবসতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সেখানে তিনি নতুন মানুষ উৎপাদনের জন্য দরিদ্র জেলে পরিবারের পুরুষ কুবেরকে সাথে নিতে চেয়েছিলেন মাঝি হিসেবে এবং নতুন সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম হিসেবে। কুবেরকে বিদায় দিতে নদীর ঘাটে ছুটে এসেছিল কুবেরের শ্যালিকা কপিলা। হোসেন মিঞা নতুন জনপদ গড়ে তোলার েেত্র কপিলাও শরিক হোক, চেয়েছিলেন। কুবের নৌকায় উঠে বসলে সাথে গেল কপিলা। ‘ছইয়ের মধ্যে গিয়া সে বসিল। কুবেরকে ডাকিয়া বলিল, ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই বলে তার উপন্যাস সমাপ্ত করেছেন যে, ‘হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। একা এত দূরে কুবের পাড়ি দিতে পারিবে না।’
শেখ হাসিনার নৌকা থেকে একে একে সবাই প্রায় নেমে গেছে। তিনি কতটা পথ একা পাড়ি দিতে পারবেন, বলতে পারি না!
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন