সোমবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শাহবাগ চত্বরে অবরোধ, ফাঁসির দাবি ও আইন সংশোধন



সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর সার্বক্ষণিক পাহারায় পরিচালিত শাহবাগ চত্বরে কিছু তরুণদের অবরোধ দু'সপ্তাহ পেরিয়ে এখন তৃতীয় সপ্তাহে পড়েছে। নাচ-গান, চরিত্র হনন, বেলেল্লাপনা ও ফাঁসির দাবিতে উত্তাল এই কর্মসূচি এখন বেশির ভাগ পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনামে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তরুণ-তরুণী ও শিক্ষার্থীরা এখানে এসে যোগ দিচ্ছে এবং কাদের মোল্লা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার জামায়াত নেতাদের ফাঁসির দাবির নতুন নতুন শ্লোগান তুলছে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মুখেও এই অবরোধের কুশীলবরা এমন সব গালিগালাজ ও শ্লোগান, ছড়া, গান তুলে দিচ্ছে যা সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার খুনী বাপ্পাদিত্য বসু এবং বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, যৌন হয়রানি এবং খুন-রাহাজানির নায়ক-নায়িকা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী এবং বামপন্থী ধর্মবিদ্বেষী নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের নেতৃত্ব ও আধিপত্যাধীন তথাকথিত এই গণআন্দোলনের নাটকটি এখন সরকারি প্লাটফর্মে রূপান্তরিত হয়ে নতুন কিছু কৃতিত্বের দাবিদারও হয়েছে। সরকার এই প্লাটফর্মের দাবিকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন তৃতীয়বারের মতো সংশোধন করেছেন। এই সংশোধনী অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্তকে খালাস কিংবা তাকে লঘু দন্ড প্রদান করলে তার বিরুদ্ধে সরকার ও বাদী পক্ষ আপিল করতে পারবেন। আবার এই সংশোধনী অনুযায়ী ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচার করার অধিকারও ট্রাইব্যুনালকে প্রদান করা হয়েছে। এখানে একটি ধ্বনি-প্রতিধ্বনির সন্ধান পাওয়া যায়। এই দাবিটি সরকারি নেতাদের অনেকের মুখেই বহুদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তা কার্যকর করার সুযোগ তারা পাচ্ছিলেন না। ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যুবক এক্টিভিস্ট এবং নানা প্রলোভন ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে শাহবাগে আনা শিশু-কিশোরদের মুখে ফাঁসির ধ্বনি ও কল্পিত যুদ্ধাপরাধী রাজাকার নিধনের দাবি তুলে সরকার তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন এবং ঐ দাবি পূরণের লক্ষ্যে আইন সংশোধনও করলেন। শাহবাগ চত্বরের ছেলে-মেয়েরা হাততালি দিয়ে তাকে বাহবা দিলো। এটা পরস্পর-পরস্পরের পিঠ চুলকানির মতোই দেখা গেলো। এক ঢিলে এখন অনেক পাখি মারা যাবে। ফাঁসি ছাড়া ট্রাইব্যুনাল আর কোন রায় দিতে পারবে না। দিলেও তার পরিণতি ফাঁসিতে গিয়েই গড়াবে। ব্যক্তির সাথে রাজনৈতিক দলকেও শাস্তি দিয়ে নিষিদ্ধ করার পথ খোলাসা হবে। মনে হচ্ছে যেন সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর দিকেই আমরা ফিরে যাচ্ছি। শক্তিশালী প্রতিদ্বনদ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে নানা অজুহাতে শাস্তি দিয়ে বে-আইনী ঘোষণা করে বাকশাল পুনঃপ্রতিষ্ঠার দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এর প্রথম বলি হবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আর যদি আক্কেলমন্দরা ইশারা বুঝে থাকেন তাহলে দ্বিতীয় বলি হবে বিএনপি। এর পরিণতি দেশ এবং দেশের মানুষকে কোথায় নিয়ে যাবে তার আভাস অবশ্য ইতোমধ্যে কিছু কিছু পাওয়া গেছে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ধন্য শাহবাগ চত্বরের প্রজন্ম লীগের ব্লগারদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাদের প্রধান টার্গেট সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় যে ভয়ঙ্কর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা সম্ভবত আল্লাহর আরশকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে। তারা এবং তাদের নেতৃত্বদানকারী যুবগোষ্ঠী ধর্মদ্রোহিতা, নাস্তিক্যবাদ ও ইসলাম বিদ্বেষের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে গত পনেরশ' বছরে এর কোন নজীর পাওয়া যায় না। তাদের ভাষায় ইসলামের প্রিয়  নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হচ্ছেন, ‘মোহাম্মক' (মোহাম্মদ+আহাম্মদ), প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ)কে তারা বলেন, আবু বকরী (ছাগল), সিজদা, হেরাগুহা, তাহাজ্জুতের নামায, নবুয়তের মোহর, সিয়াম সাধনা প্রভৃতি সম্পর্কে এই ব্লগারচক্র যে অশ্লীল ও কুৎসিৎ ভাষা ব্যবহার করে ফেসবুকে পোস্টিং দিয়েছে তা ঈমান-আকীদা সম্পন্ন যে কোন মুসলমানের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে তোলে। তারা আল-কুরআনের নাম দিয়েছে ‘বাল-কুরআন'! আল্লাহ সম্পর্কে তারা ‘আল্লাপাদ' বলে উপহাস করে (দেখুন nuranichapa wordpres.com)। আল্লাহ, রাসূল (সাঃ) কুরআন, হাদিস, নবী সহধর্মিনী, সাহাবায়ে কেরাম, নামায-রোজা প্রভৃতি সম্পর্কে তাদের জঘন্য বিদ্বেষ কাহিনী ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং তা শুধু বাংলাদেশ নয় বাংলাদেশের বাইরেও কোটি কোটি মুসলমানের অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমাদের সরকার এখন এদেরকেই সরকার মনে করেন। অর্থ্যাৎ তারাই হচ্ছে সরকারের সরকার। তাদের নির্দেশনায় দেশের সংবিধান সংশোধন হয়। বিরোধীদলকে প্রতিহত করার নির্দেশও তারা দেয়। তাদের সন্তুষ্ট ও শক্তিশালী করার জন্য সরকার সার্বক্ষণিক তাদের নিরাপত্তা বিধান করছেন। খাবার-দাবার এবং দক্ষিণা সরবরাহের জন্য দৈনন্দিন প্রতিষ্ঠান ঠিক করে দেয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত, লজ্জিত হলেও সরকারের কাছ থেকে তারা সকল প্রকার সহযোগিতা পাচ্ছে। শাহবাগের আন্দোলন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আতঙ্কিত করে রাখছে। সেখানে যোগ না দিলে এমপিওভুক্তি বাতিলের হুমকি আছে। হামলা-মামলা এবং মারধরের আশঙ্কা আছে। শাহবাগের চাঁদাবাজিতে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো আজ উৎকণ্ঠিত।
এ অবস্থা কতদিন চলবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও একটি বিষয় নিশ্চিত যে, ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ এবং জামায়াত নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত সরকার তাদের সেখানে রাখতে চান। আবার কারুর কারুর মতে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তারা সেখানে থাকতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে দেশ-বিদেশের মানুষ সরকারের এক্সটেশন হিসেবে গণ্য করলেও দেখা যাচ্ছে যে, সরকার তার উপর আস্থা রাখতে পারছেন না। এর মধ্যে এর কিছু প্রমাণও পাওয়া গেছে। এই ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় হয়েছিল বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায়। তিনি জামায়াতের কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন না। অনেক বছর আগেই বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। বাজারে গুজব রয়েছে যে তার মামলাটি ছিল সরকারের একটি সাজানো নাটক। তিনি তার বাড়িতে অন্তরীণ অবস্থায় ছিলেন এবং র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনী দ্বারা রাতদিন ২৪ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকতেন। তার বিরুদ্ধে যেদিন আটকাদেশ জারি হয় সেদিনই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান এবং তার মামলায় একতরফাভাবে সরকার পক্ষ জয়লাভ করেন। ট্রাইব্যুনালে তার কোন আইনজীবী ছিল না। সরকার সরকারি দলের একজন জেলা সভাপতিকে তার আইনজীবী নিয়োগ করেন এবং তার বিরুদ্ধে আনীত সবগুলো অভিযোগ বিনা আপত্তিতে প্রমাণিত হয়। রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে সম্পৃক্ত করা হয় এবং জনাব আযাদকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। বাজারে গুজব রয়েছে যে, জনাব আবুল কালাম আযাদ আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম সাজেদা চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, তিনি এবং তার ছেলে ওয়ারেন্ট জারির পরপরই তাকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। শাহবাগের অবরোধকারীরা এই আবুল কালাম আযাদকে ফিরিয়ে আনা এবং তার ফাঁসি কার্যকর করার ব্যাপারে এ যাবত একটি দাবিও পেশ করেননি। তাদের দাবি হচ্ছে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি এবং বিচারাধীন অন্যান্য জামায়াত নেতাদেরও যাতে ফাঁসি হয় তা নিশ্চিত করা। বলাবাহুল্য সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। জামায়াতের তরফ থেকে এই রায়ের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এই কর্মসূচি পালনকালে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশের সশস্ত্র হামলায় জামায়াত-শিবিরের ৪ জন কর্মী নিহত হয়েছেন এবং দলটির আরো অগণিত নেতা-কর্মী মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। আহতদের কেউ কেউ মৃত্যুর প্রহরও গুণছেন বলে জানা গেছে।
জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সরকার হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ছয়টি অভিযোগ এনেছিলেন এবং ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল আইনের অধীনে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার বিচারকার্য শুরু করেন। এজন্য প্রথমে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সেল থেকে তদন্তকারীরা তার বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল তদন্ত করে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করেন এবং আদালতে চার্জ গঠন করা হয়।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যে ছয়টি অভিযোগ ছিল তার প্রত্যেকটিই ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল আইনে এই ফৌজদারী অপরাধসমূহ বিচারের জন্য আমাদের দেশে বিদ্যমান ফৌজদারী আইন ও ফৌজদারী দন্ডবিধি অকার্যকর বলে গণ্য করা হয়  এবং এই অপরাধ প্রমাণের জন্য দেশে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনের কার্যকারিতা রহিত করা হয়। এছাড়াও ট্রাইব্যুনাল আইনে বিচার প্রক্রিয়াকে সহজ ও শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য যে মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে সে অধিকারগুলো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বেলায় অপ্রযোজ্য করে দেয়া হয়। এই অবস্থায় বলতে গেলে সরকার অনেকটা জনাব মোল্লাকে হাত-পা বেধে বিচারে সোপর্দ করেন।
অভিযুক্তের তরফ থেকে দাবি করা হয় যে, মিরপুর ও অন্যান্য স্থানে গণহত্যা ও অপরাপর অপরাধের যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। জনাব মোল্লা এই অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন না এবং অপরাধকালীন সময়ে তিনি ঢাকাতেই ছিলেন না। ১৯৭১ সালে কসাই কাদের ও আখতার গুন্ডা নামে দু'ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে এই অপরাধের সাথে জড়িত ছিল। সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য কসাই কাদেরের স্থলে জামায়াত নেতা নিরপরাধ আব্দুল কাদের মোল্লাকে বসিয়ে বিচারে সোপর্দ করেছেন। এটা অনেকটা গলাকাটা পাসপোর্টের ন্যায়। গলাকাটা পাসপোর্টে যেমন জালিয়াত চক্র আসল ব্যক্তির ছবির গলার উপরের অংশ ফেলে দিয়ে সেখানে নকল ব্যক্তির মাথা সেঁটে দিয়ে তাকে আসল পাসপোর্টধারী বানানোর চেষ্টা করে তেমনি এক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। কিন্তু এতকিছু করার পরও রাষ্ট্রপক্ষ হত্যাকান্ডে কাদের মোল্লার সরাসরি সম্পৃক্ততা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন এবং এই ব্যর্থতাই রায়ের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। একটি সহযোগী দৈনিকে এই রায়টির একটি চমৎকার পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে - জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ঘটনায় সাড়ে ৪শ' জনকে হত্যার অভিযোগ উত্থাপিত হলেও ট্রাইব্যুনাল কোন হত্যার ঘটনায় তার সরাসরি সম্পৃক্ততা পায়নি। অর্থাৎ কাদের মোল্লা নিজ হাতে কাউকে গুলী করে হত্যা করেছেন এমন কোন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেননি। রায় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোন কোন ঘটনায় কাদের মোল্লা রাইফেল হাতে দাঁড়িয়েছিলেন মাত্র। কিন্তু রাইফেল দিয়ে কাউকে গুলী করেছেন এমন চাক্ষুস সাক্ষী ট্রাইব্যুনাল পায়নি। ঘাটারচর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকান্ড সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, হত্যাকান্ড যে ঘটেছিল তা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই; কিন্তু এ হত্যাকান্ডের সাথে আসামীর অংশগ্রহণ বা সংশ্লিষ্টতা প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মিরপুরে পল্লব হত্যা, কবি মেহেরুন্নেছা, তার মা এবং দুই ভাইকে মিরপুরের বাসায় গিয়ে হত্যা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যা, ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটারচর (শহীদনগর) এলাকায় শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসী ও দু'জন নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা, মিরপুরের আলোকদিতে ৩৪৪ জনকে হত্যা, মিরপুরে হযরত আলী, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই বছরের ছেলেকে হত্যা এবং তার ১১ বছরের মেয়েকে ধর্ষণসহ বিভিন্ন ঘটনায় প্রায় সাড়ে ৪শ' ব্যক্তিকে হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। একটি ঘটনা বাদে সবকয়টি ঘটনায় কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল মোট ৪৫ বছরের কারাদন্ড দেয়। এর মধ্যে মিরপুরের আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনের বেশি মানুষ হত্যা ও মিরপুরের হযরত আলী ও তার স্বজনদের হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন (৩০ বছর) কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এই দুই হত্যাকান্ডের অভিযোগে তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩-এর ২০-এর ২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ২০(২) ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল আসামীকে মৃত্যুদন্ড বা অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী অন্য যে কোন কারাদন্ড দিতে পারে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সিদ্ধান্তই ঘোষণা করে।
আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়, হত্যাকান্ডের সময় কাদের মোল্লাকে রাইফেল হাতে সশরীরে উপস্থিত দেখা গেছে। তিনি গুলী করে কাউকে হত্যা করেছেন এমন চাক্ষুস সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেননি। এদিকে আরো তিনটি ঘটনায় কাদের মোল্লাকে মোট ১৫ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। এর মধ্যে কাদের মোল্লার নির্দেশে আখতার গুন্ডা একাত্তরের ৫ এপ্রিল মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলী করে হত্যা করেছে মর্মে অভিযোগ উত্থাপিত হয়। কিন্তু রায়ে বলা হয়েছে যে, কাদের মোল্লা নিজেই পল্লবকে হত্যা করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ এমন কোনও প্রমাণ আদালতে হাজির করতে পারেনি। কাদের মোল্লা ও তার সহযোগী কর্তৃক কবি মেহেরুন্নেছা, তার মা ও দুই ভাইকে হত্যার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু এ ঘটনার অনুকূলে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার প্রত্যক্ষ কোনও সম্পৃক্ততা পায়নি। তবে এতে তার নৈতিক সমর্থন ও উৎসাহ এবং সহযোগিতার বিষয় বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল তাকে শাস্তি প্রদান করেছেন।
এই রায়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, দেশে প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী যদি বিচার হয় তাহলে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন তো দূরের কথা একদিনেরও দন্ডাদেশ হতে পারে না। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এই বিচারকে প্রহসন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনটি বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া, দুইটি রায় প্রকাশ এবং একটির রায় অপেক্ষমাণ থাকা অবস্থায় আইনের সংশোধন সভ্য দুনিয়ায় সম্ভবত এই প্রথম। এর ফলে যে নজির স্থাপিত হয়েছে তা দেশ ও জাতির জন্য শুভ হতে পারে না। শাহবাগের অবরোধকারীরা বিচারাধীন অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবি করছে। এবং এই ফাঁসি দেয়ার দায়িত্ব একমাত্র বিচারকদেরই আছে। তারা যদি ফাঁসি না দেন তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। আইন, সাক্ষ্য-প্রমাণ, অভিযোগের সত্যতা এবং বিচারকের নিরপেক্ষতাই হচ্ছে বিচারের মানদন্ড। এজন্য আদালতকে বলা হয়, বিচার বা ইনসাফের আদালত। এই আদালতে আসামী যেমন খালাস পেতে পারে তেমনি শাস্তিও পেতে পারে। কিন্তু শাহবাগের দাবি হচ্ছে শুধু ফাঁসির। এবং এই দাবির সাথে সরকার ও সরকার প্রধানও একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। আর ট্রাইব্যুনালকে যদি তাদের দাবি অনুযায়ী কাজ করতে হয় তা বিচারের আদালত না হয়ে ফাঁসির আদালতে পরিণত হবে। এটা কাম্য হতে পারে না।
এখন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর প্রসঙ্গে আসা যাক। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই মুফাসসিরে কুরআনকে মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তার প্রতিভা বাগ্মিতাও যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা সরকারকে এতই ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে যে, তিনি তাদের অযোগ্যতা, দুর্নীতি-দুঃশাসনের পথের কাঁটাতে পরিণত হয়েছিলেন। সরকার তার বেলায়ও গলাকাটা পাসপোর্টের নীতি অবলম্বন করে পিরোজপুর এলাকায় জঘন্য অপরাধী দেলোয়ার শিকদারের স্থলে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম বসিয়ে দিয়ে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে তার ওপর যে অবিচার করা হয়েছে তা নজিরবিহীন। সরকারপক্ষ তার সাক্ষীদের গুম করেছেন। তার বিপক্ষের সাক্ষীদের হাজির করতে না পেরে ১৫ জন সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে তাদের কথিত অসমর্থিত লিখিত জবানবন্দি আমলে নিয়েছেন। অন্যের অপরাধ তার কাঁধে চাপিয়েছেন। তার উকিলরা সেফ হোমে সরকারপক্ষের সাক্ষীদের রেকর্ড দাখিল করেছেন তা আদালত বিবেচনা করেননি। আবার পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে যে, সরকার তার ফাঁসির আদেশ দিয়ে রায়ের মুসাবিদাও ইতোমধ্যে তৈরি করেছেন এবং গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তা ঘোষণা করার কথা ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারায় তা হয়নি। এই অবস্থায় ঐ ফাঁসি সংবলিত রায় যতদিন ঘোষণা না হচ্ছে ততদিন শাহবাগ চত্বর খালি করা হচ্ছে না বলে জানা গেছে। এই গুজব যদি সত্য হয় তাহলে বাংলাদেশের আদালতগুলো তাদের মর্যাদা হারাবে এবং এক্ষেত্রে দেশে নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এবং এই নৈরাজ্য দেশকে ভয়াবহ হানাহানি ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ঐ অবস্থায় পৌঁছানোর আগেই দেশপ্রেমিক বিবেকবান মানুষদের দেশরক্ষায় এগিয়ে আসার জন্য আহবান জানাবো।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads