সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শাহবাগ আন্দোলন এবং সামগ্রিকতা : আমাদের ভাবনা

তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভয়কে জয় করা, পাহাড়সম বাধা ডিঙানো, অজানাকে জানা, অত্যাচারীর রক্তচুর পরোয়া না করা মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে নিজেকে, নিজের দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার জন্য দৃঢ়পায়ে শুধুই সামনে এগিয়ে চলা। তারুণ্যের এই অনন্য বেশিষ্ট্যের জন্যই দেখা গেছে বিশ্বের সব সফল আন্দোলন সংগ্রাম এবং আবিষ্কারে তরুণদের অসামান্য অবদান। শাহবাগে জমায়েত হাজারো তরুণের মধ্যে আমরা দ্রোহ দেখেছি, দাবি আদায়ের দৃপ্ত শপথ দেখেছি। তাদের মতামতকে আমরা শ্রদ্ধা করি। মোবারকবাদ জানাই তাদের দৃঢ় মনোবাসনাকে। তাদের মতো আমরাও স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। কিন্তু আমরা তাদের আন্দোলনের সাথে সহমত পোষণ করি না। এই সহমত পোষণ না করাটা এবং প্রকাশ্যে বলাটা আমাদের অধিকার, যেমনটি তাদের অধিকার শাহবাগে অবস্থানের মাধ্যমে তাদের দাবির পক্ষে উচ্চস্বরে স্লোগান দেয়া। কেন আমরা সহমত পোষণ করি না?শাহবাগকেন্দ্রিক তারুণ্যদ্বীপ্ত ও ব্যতিক্রমী আন্দোলন নিকট অতীতে বাংলাদেশে দেখা যায়নি। এটি অনেকটা মিসরের তাহরির স্কয়ার কিংবা তিউনিসিয়ার বসন্তের মতো, যার মাধ্যমে বেন আলী ও হোসনি মোবারকের সিংহাসন খান খান হয়ে নতুন সূর্যের অভ্যুদয় ঘটেছে। নতুন সংবিধান রচিত হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে সামগ্রিকভাবে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলন সমাজকে খণ্ডিতভাবে দেখছে। এটি অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার মতো। তারা ভাবছে বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা হলো যুদ্ধাপরাধ ইস্যু। এটিই বাংলাদেশ। তারা বিচার বা ন্যায়বিচার চায় না। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সরাসরি ফাঁসি চায়। সরকারও তাদের সাথে একমত। আমাদের প্রশ্ন হলো, যদি তাদেরকে ফাঁসি দিতেই হবে তাহলে ট্রাইব্যুনালের আইনে বলার দরকার ছিল যে, ফাঁসি ছাড়া অন্য কোনো রায় দেয়া যাবে না। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আইন সংশোধন করে উভয় পক্ষের আপিলের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে যদি সাজা বাড়িয়ে ফাঁসির রায় না দেন, তা হলে তো আবারো আইন সংশোধন করতে হবে। যদি তাই না হয় তাহলে কি সরকার এটি নিশ্চিত যে, সুপ্রিম কোর্ট ফাঁসির রায়ই দেবেন? যে আদালতের রায়ের ব্যাপারে সরকার নিশ্চিত এবং যেটি শাহবাগে আন্দোলনের একমাত্র দাবি তার সাথে আমরা সহমত পোষণ করতে পারি না, কারণ এটি ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর নির্বিচারে হত্যা এবং রাজাকারদের হত্যাযজ্ঞের চেয়ে অধিকতর যৌক্তিক কোনো বিষয় নয়। আমরা যদি এটি করি তাহলে দাবি করতে পারি না যে, আমরা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চেয়ে অধিকতর যৌক্তিক বোধসম্পন্ন।
শাহবাগ আন্দোলন হাজারো স্লোগান দেয়, কিন্তু আমরা সে আন্দোলনের সাথে সহমত পোষণ করতে পারি না, কারণ সে আন্দোলন ইলিয়াস আলী বা চৌধুরী আলমদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না, বিবেচনা করে বিরোধী দলের নেতা বা কর্মী হিসেবে। আমরা তাদের সাথে একাত্মতা পোষণ করতে পারি না, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র তাদেরই সহপাঠী আবু বকরের হত্যাকারীদের সাথে হাত মেলায়। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্লোগান ধরে। আমরা তাদের সাথে একমত হতে পারি না, যাদের কানে সাগর-রুনির সন্তান মেঘের কান্নার আওয়াজ পৌঁছে না। যাদের চোখে অদৃশ্য আবরণের কারণে বিশ্বজিতের রক্তমাখা শার্ট কালো দেখায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক হত্যার কারণে চিরুনি অভিযান হলেও আবু বকর আর বিশ্বজিৎ হত্যাকারীরা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পায়। এহেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা টুঁ-শব্দটিও করে না আমরা তাদের সাথে একমত পোষণ করি না। আমাদের সহকর্মী প্রফেসর ইয়াহিয়া আখতারের ভাষায় বলতে হয় যে আন্দোলনকারীরা মনে করে আবু বকর, বিশ্বজিৎ আর কক্সবাজারের নিরীহ দোকানির রক্তে হিমোগ্লোবিন কম ছিল, তাদের সাথে আমরা সহমত পোষণ করতে পারি না। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, ব্লাগার রাজীবের রক্ত আর সোনার ছেলে এবং পুলিশের গুলিতে নিহত বিরোধী দলের কর্মীদের রক্তের রঙ একই। প্রধানমন্ত্রী যখন ব্লগার রাজীবের পিতা-মাতাকে সান্ত্বনা দিয়ে শুধু অনুমানের ভিত্তিতে জামাত-শিবিরকে দায়ী করে বলেন, ‘এ দেশে জামাত-শিবিরের রাজনীতি করার অধিকার নেই।’ তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগেÑ প্রধানমন্ত্রী কেন বিশ্বজিতের পিতা-মাতাকে দেখতে গেলেন না? সান্তনা দিয়ে কেন বললেন না, ‘ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত।’ যাদের বিবেকে এতটুকু প্রশ্নের উদ্রেক হয় নাÑ আমরা তাদের সাথে সহমত পোষণ করতে পারি না।
শেয়ারবাজার ও হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট করে মানুষকে পথে বসানো হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে বিশ্বের বুকে আমাদের মাথা হেঁট করে দেয়া হয়। কালো বিড়ালেরা বস্তা বস্তা টাকা গিলে খায়, আবার ধরা পড়ে কিছু বমি করে দেয়। সেই কালো বিড়াল যখন দাঁত কেলিয়ে হাসে অথচ শাহবাগ আন্দোলনকারীদের মধ্যে কোনো ঘৃণার উদ্রেক করে না, আমরা তাদের সাথে একমত পোষণ করতে পারি না। যারা দিনের পর দিন আন্দোলন করে, ক্রমাগত স্লোগান দেয় অথচ একটিবারও উচ্চারণ করে নাÑ আমার বোন ফালানী কাঁটাতারে ঝোলে কেন? কেন পানি পানি চিৎকার করেও অন্তিমকালে এক ফোঁটা পানি পায় না? কেন আমার দেশের ভরা যৌবনের নদীর বুক চিরে বাঁধ তৈরি করে প্রতিবেশী তার মালামাল পরিবহন করে আর আমাদের দেশের কৃষকের মাঠ পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। যে আন্দোলন আধিপত্যের বিরুদ্ধে কথা বলে না, এশিয়া এনার্জিসহ সাম্রাজ্যবাদীদের লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে কথা বলে না; আমরা তাদের সাথে সহমত পোষণ করতে পারি না।
প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি কিছু দিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেনÑ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে আমেরিকা সারা বিশ্বে সন্ত্রাস করছে এবং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হচ্ছেন সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী। বিশ্বের সবচয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে এত বড় কথা বলার পরও আমেরিকান এই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্র বা ডেমোক্র্যাটদের কোনো প্রতিক্রিয়া আমরা দেখিনি। অথচ আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার কারণে মামলা হয়। আদালত তলব করে শাস্তি দেন। রাষ্ট্রদ্রোহী হয়। টকশোতে নিজের মত প্রকাশের কারণে আসিফ নজরুলের কক্ষ ভাঙচুর হয়, মাহমুদুর রহমান ও পিয়াস করিমকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। যে আন্দোলন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর এহেন স্টিমরোলার চালানোর পরও একটি শব্দ উচ্চারণ করে না, উপরন্তু তাদের চামড়া তুলে নেয়ার স্লোগান দেয়Ñ তাদের সাথে আমরা সহমত পোষণ করতে পারি না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করে না তাদের বিবেকবোধ নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে। যে আন্দোলন শুধু ভিন্নমত পোষণ করার কারণে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম, দিগন্ত টিভি, সোনার বাংলাদেশ ব্লগ বন্ধ করার দাবি জানায়, আমরা তাদের সাথে একমত হতে পারি না।
শাহবাগ আন্দোলনের কেউ কেউ এই যুক্তি দেখান যে, তারা বাংলার সময় ইংরেজি পরীক্ষা দেন না, পদার্থবিদ্যার সময় রসায়ন পরীক্ষা দেন না; অর্থাৎ এখন শুধু যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাওয়ার সময়, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, গণ-আন্দোলন আর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা এক নয়। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ’৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলন, ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান শুধু একটি ইস্যুকে প্রাধান্য দেয়নি। অত্যাচার, নির্যাতন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণসহ সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলেছে। যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শাহবাগ আন্দোলন, প্রয়োজনে তারা দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেয় আবার ধর্মভিত্তিক দলের সাথে রাজনৈতিক প্রয়োজনে আঁতাত করে। কিন্তু উর্দু শব্দ আওয়ামী যার অর্থ ‘জনগণ’, যা আওয়াম শব্দ থেকে এসেছে তা বাদ দেয় না অথচ কথায় কথায় পাকিস্তান ও পাকিস্তানপন্থীদের গালি দিতে দিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। এই শাহবাগ আন্দোলন যখন তাদেরই বন্দনা করেÑ আমরা তাদের সাথে সহমত পোষণ করতে পারি না।
শাহবাগের তরুণদের বলবÑ যে আন্দোলন ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়Ñ সেই আন্দোলন আর যাই হোক রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না, পারে না কায়েমি স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে; কারণ আন্দোলনের  জ্বালানির মধ্যে ভেজাল রয়েছে। এই কিছু দিন আগেও দেখেছি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হরতাল হয়েছে। কিন্তু সেই মানুষেরাই যখন সাম্রাজ্যবাদীদের লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকল, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর নামে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারের  প্রতিবাদ করল; ক্ষমতাসীনেরা কিন্তু তখন মরিচের গুঁড়া নিক্ষেপ করল। তাই আপনাদের বলব, যে অদৃশ্য সুতার টানে আপনারা পরিচালিত হচ্ছেনÑ তাদের ইতিহাস হলো ছুড়ে ফেলার ইতিহাস। তারা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে ছুড়ে ফেলেছে, তারা ছুড়ে ফেলেছে আবদুল মান্নান, আবদুল মমিন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, আতাউর রহমান খানের মতো নেতাকে। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সাহস করে যে ব্যক্তি প্রথম সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলেন, সেই বাঘা সিদ্দিকীও তাদের সাথে থাকতে পারেননি। হয়েছেন রাজাকার।
তাই আমরা মনে করি, আপনাদের সামনে দুটো পথ খোলা আছে। একটি হলো ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় থাকার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া এবং লক্ষ্য অর্জনের পর তাদের দ্বারা আবর্জনার মতো নিক্ষিপ্ত হওয়া। অন্যটি হলো বাংলাদেশ নামক আমাদের এই প্রিয় ভূখণ্ডটিকে ভূমি থেকে কয়েক কিলোমিটার ওপরে উঠে দেখা এবং এটিকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের এলিটদের একটি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়া। যে ঝাঁকুনিতে কালো বিড়ালেরা হাত গুটিয়ে নেবে, পদ্মা সেতুর রাঘব বোয়ালেরা দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে, আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শ্যেনদৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে; আর কোনো মায়ের বুক পুলিশের গুলিতে অথবা সোনার ছেলেদের কোপে কিংবা স্বাধীনতাবিরোধীদের আঘাতে খালি হবে না।
অদৃশ্য সুতার টানে নাচলে এ আন্দোলনে ঠাণ্ডা পানি থাকবে, বিরিয়ানি থাকবে, তথাকথিত সুশীলসমাজের উচ্চসিত প্রশংসা থাকবে, রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা থাকবে; সেই সাথে থাকবে নাটের গুরুদের দিয়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার নিশ্চিত গন্তব্য। আবার এ আন্দোলনকে একটি সামগ্রিক আন্দোলন হিসেবে এগিয়ে নিয়ে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জনগণের ভোটের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে কথা বলে দমন-নিপীড়নের শিকার হওয়ার পথও খোলা আছে। প্রথমটি ভীরু, কাপুরুষ ও তরুণ নামের পৌঢ়দের পথ। দ্বিতীয়টি দৃঢ়পায়ে চলা, বাধাকে জয় করা, শাসকগোষ্ঠীর রক্তচুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলা তরুণদের পথ। আপনারা কোন পথে চলবেন, সেটি সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনইÑ এখনই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads