শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

৯ কোটি ৬০ লাখ উন্মাদ!


খন্দকার মনিরুল আলম

১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে উন্মাদের সংখ্যা ৯ কোটি ৬০ লাখ! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের বক্তব্য যদি সঠিক হয় তাহলে বাংলাদেশে উন্মাদের সংখ্যা এটাই হবে।
একটু খোলাশা করে বলি। মুহিত সাহেব বলেছেন, যারা হরতাল করে তারা উন্মাদ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সরকারবিরোধী ১৮ দলীয় জোট হরতাল ডেকেছিল গত ৬ জানুয়ারি। সারা দেশে এই হরতাল পালিত হয়েছিল বিপুলভাবে। যারা হরতাল ডেকেছিলেন এবং যারা হরতাল পালন করেছিলেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারা জনাব মুহিতের কথায় উন্মাদ।
এই উন্মাদের সংখ্যা কত? দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলোর সাম্প্রতিক একটি জরিপ বিশ্লেষণ করলে উন্মাদের সংখ্যা ৯ কোটি ৬০ লাখে দাঁড়ায়। আমি গণিতবিশেষজ্ঞ নই, তাই আমার এই হিসাব কমবেশি হতে পারে।
প্রথম আলোর জরিপে দেখা গেছে ২০১২ সালে বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল ৪৪ শতাংশ। ১৮ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর প্রতি সমর্থন ছিল ৩ শতাংশ। ৪৪+৩= ৪৭ এবং এর সাথে জোটের ছোট ছোট শরিক দলের প্রতি জনসমর্থন ১ শতাংশ যদি ধরে নিই তাহলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ। এই হরতালের প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সমর্থন জানিয়েছিলেন। প্রথম আলোর জরিপে দেখানো হয়েছে যে, ২০১২ সালে জাতীয় পার্টির প্রতি ১২ শতাংশ মানুষের সমর্থন ছিল। ১৮ দলীয় জোট এবং জাতীয় পার্টি সমর্থন সব মিলিয়ে হয় ৬০ শতাংশ। দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরে নিলে হরতাল সমর্থকের সংখ্যা দাঁড়ায় কমবেশি ৯ কোটি ৬০ লাখ। মুহিত সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী এই ৯ কোটি ৬০ লাখ মানুষ তাহলে উন্মাদ। আমার জানা মতে, দেশের মানসিক রোগী তথা পাগলদের জন্য একটিমাত্র হাসপাতাল আছে পাবনায়। এই ৯ কোটি ৬০ লাখ উন্মাদের জায়গা হবে কোথায়?
জনমত যাচাই করার জন্য সারা বিশ্বে জরিপ করা হয়। বাংলাদেশেও এটা হয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় দুইটি পত্রিকা ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো আগের বছরগুলোর মতো এবারো জরিপ করেছে। জরিপে যে ফলাফল দেখা গেছে তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উল্লসিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রথম আলো দেখিয়েছে যে, আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন রয়েছে মাত্র ৩৫ শতাংশ মানুষের। এর বিপরীতে বিএনপির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ৪৪ শতাংশ মানুষ। ‘বিপুল জনসমর্থন’ এবং বিপুল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ‘বিপুল’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার চতুর্থ বছরের মাথায় তাদের জনপ্রিয়তায় যে বিপুলভাবে ধস নেমেছে তা বুঝতে কোনো জরিপের প্রয়োজন হয় না। রাস্তাঘাট, হাটবাজার ও অফিস-আদালতে সর্বস্তরের মানুষ একবাক্যে রায় দিচ্ছেন যে বর্তমান সরকারের ওপর তাদের আস্থা নেই। শুধু আস্থাহীনতা নয়, সরকারের প্রতি তাদের রয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা। আওয়ামী লীগ ও সরকার হয়তো বলবে যে, সাধারণ মানুষের কাছে তারা এখনো প্রিয়। প্রধানমন্ত্রী দেশের যেখানে যাচ্ছেন সেখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছে তাকে দেখা এবং তার বক্তৃতা শোনার জন্য। দেশে যে ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বইছে তাতে মানুষ শুধু সন্তুষ্টই নয়, বিমুগ্ধ। কিন্তু আসলেই কি তাই? উল্লেখ করতে চাই এরশাদ জমানার শেষ দিনগুলোর। যেদিন এরশাদ সাহেবের পতন ঘটে তার আগের দিন তিনি গিয়েছিলেন মাদারীপুর জেলার টেকেরহাট সেতু উদ্বোধন করতে। সেখানে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ তাকে দেখতে ও তার বক্তৃতা শুনতে। এরশাদ কি ভেবেছিলেন পরের দিন তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে? আসলে ক্ষমতায় থাকলে হাজার হাজারই নয়, লাখো মানুষ জড়ো করা যায়। আমাদের রাজনীতিবিদেরা ইতিহাস হয়তো পড়েন, কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন না। দেশে দেশে, যুগে যুগে এ ঘটনা ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে। ক্ষমতা এমনই একটা জিনিস যা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। বর্তমানে যারা ক্ষমতায় রয়েছেন তাদের বেলায়ও এটি ঘটছে। চাটুকার ও জিহুজুরদের দ্বারা ঘিরে থাকা ক্ষমতাসীনেরা বাস্তব অবস্থা বুঝতে পারেন না। তারা বৈধ ও অবৈধ উভয় প্রকারে ক্ষমতা প্রদর্শন করে বিরোধীদের দাবিয়ে রাখতে চান। এতে করে তারা একের পর এক ভুল করেন যার খেসারত তাদের দিতে হয় চরমভাবে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা এবং সে শিক্ষা ক্ষমতাসীনেরা নিতে চান না।
ক্ষমতাসীন জোট তথা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় এত বড় ধস নামল কেন? জনপ্রিয় লেখক সাহিত্যিক মরহুম সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি লেখার উদ্ধৃতি দিতে চাই। অনেক দিন আগে পড়া তাই হুবহু স্মরণ নেই। মোটামুটি যা মনে পড়ছে তা হলো, জার্মান বাহিনী সমুদ্রতীরবর্তী একটি নৌঘাঁটি দখল করেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। একদিন জার্মান নৌবাহিনীর একটি জাহাজ এলো সেই ঘাঁটিতে। কিন্তু জাহাজটির সম্মানে নৌঘাঁটি থেকে ২১ বার তোপধ্বনি করা হলো না। জাহাজ থেকে নেমে কমান্ডার ঘাঁটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিকে প্রচুর ধমকালেন এবং কৈফিয়ত চাইলেন কেন তার সম্মানে তোপধ্বনি করা হলো না? মুখ কালো করে গম্ভীর কণ্ঠে কর্তাব্যক্তি জানালেন যে এর পেছনে ১০১টি কারণ আছে। এক-এক করে বলে যাও, কমান্ডের হুকুম। প্রথম কারণ হলো ঘাঁটিতে কামানের গোলা নেই। ব্যস, এর পরে তো আর কোনো কারণ দেখানোর প্রয়োজনই নেই।
গোলা না থাকলে তোপধ্বনি হবে কিভাবে? আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় যে ধস নেমেছে তার পেছনে মুজতবা আলীর কথায় ১০১টি কারণ আছে। তবে এর মধ্যে একটি কারণই যথেষ্ট আর সেটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সর্বগ্রাসী মনোভাব এবং লুটপাট, অত্যাচার-অনাচার, যা গত চার বছরে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কারো কথা বলারও সাহস নেই। শ্রদ্ধেয় ও বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবিএম মূসা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে প্রভাবশালী ‘চার খলিফার’ এক খলিফা নূরে আলম সিদ্দিকী ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় প্রচুর গালি খেয়েছেন। চার বছর আগে ছাত্রলীগ যখন তাদের আগ্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে তখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সঙ্গ ত্যাগ করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ছাত্রলীগ দমেনি বরং দিন দিন তাদের আগ্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম দিকে তারা তাদের বিরুদ্ধপক্ষের ওপর হামলা করে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত করেছে। এখন তারা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধপক্ষ। টেন্ডার ও ভর্তিবাণিজ্য থেকে শুরু করে এহেন কাজ নেই যা ছাত্রলীগ করেনি। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার এবং ভাগাভাগি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দেশের সর্বত্র ছাত্রলীগ সংবাদপত্রে শিরোনাম হচ্ছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, মূল দলের হাইকমান্ড এখন আর তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনো চেষ্টাই করছে না। যে দলের সাথে ছাত্রলীগ আছে তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামার জন্য অন্য কোনো কারণের প্রয়োজন হয় না। ১০১টি কারণেরও দরকার হয় না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সব কিছু জেনেশুনেই ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন না। তারা চাইছেন ছাত্রলীগের পেশিশক্তি আরো বৃদ্ধি পাক, যাতে তারা রাজপথে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে পারে। তারা এখনই তা করছে এবং ভবিষ্যতে যাতে আরো বেশি করে তার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু একটা বিষয় আওয়ামী লীগের কর্ণধাররা বুঝতে পারছেন না, যে ফ্রাংকেনস্টাইন তারা সৃষ্টি করেছেন তা তাদের ওপরেই চড়াও হবে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে, ছাত্রলীগের এক শ্রেণীর নেতাকর্মী বর্তমানে ধনবান হয়ে উঠেছেন। সারা দেশের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে তারা এখন আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন। অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের ধনবান ব্যক্তি মূল দল বিপাকে পড়লে তার পরিত্রাণে এগিয়ে আসে না। অবৈধ আয়লব্ধ সম্পদ রক্ষা করাই তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এটা বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের জন্য কমবেশি প্রযোজ্য। কাজেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি মনে করে থাকেন যে, ভবিষ্যতে দল রাজপথে অথবা নির্বাচনে কোণঠাসা হয়ে পড়লে ছাত্রলীগের ‘সোনার ছেলেরা’ এগিয়ে আসবেন তাহলে তারা ভুল করবেন। অতীতে এমনটিই হয়েছে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধসকে নিয়ে। ছাত্রলীগ কি একাই এ জন্য দায়ী? গত চার বছরে দলটি এমন কী কাজ করেছে, যে কারণে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বহাল থাকবে। তাদের যে কোনো সাফল্য নেই, তা বলছি না। কিন্তু সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা অনেক ভারী। পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়নি যদিও ২০১৩ সালে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সেতু হয়নি। কিন্তু পদ্মার পানি আরো ঘোলা হয়েছে। শেয়ারমার্কেটে ৩০ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছেন। এর কোনো প্রতিকার হয়নি। সামরিক বাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল হারুনুর রশিদের নেতৃত্বাধীন ডেসটিনি হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশে পাচার করেছেন। জেনারেল হারুন আওয়ামী ঘরানার লোক বলে সর্বমহলে পরিচিত। কুইক রেন্টালের নামে গুটি কয়েক মানুষকে হাজার হাজার কোটি টাকা কামাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলা হয়েছিল বিদ্যুৎসঙ্কট মোকাবেলা করার জন্য কুইক রেন্টালের প্রবর্তন করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানতো হয়নি বরং বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা হেয়ছে। সোনালী ব্যাংকসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে এখন পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাসহ আওয়ামী ঘরানার লোকজন এতে জড়িত বলে জানা গেছে। নোবেলজয়ী বাংলাদেশের গর্ব ড. ইউনূসকে হেনস্তা করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারের কুশাসনের বর্ণনা দিতে গেলে একটি মহাভারত আকারের বই লিখেও শেষ করা যাবে না। এত কিছুর পরও প্রথম আলোর জরিপ অনুযায়ী এখনো যে ৩৫ শতাংশ মানুষের সমর্থন তাদের প্রতি আছে তাই তো বেশি। অবশ্য এই ৩৫ ভাগের মধ্যে এমন একটা বিরাট অংশ আছে যারা আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করলেও শেষ মুহূর্তে তাদের সমর্থন করে এবং নির্বাচনে ভোট দেয়। আগামী দিনে দলটির সমর্থকের সংখ্যা যে আরো কমবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
পুনশ্চঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে বলেছেন, হোসেনকে ধরলে হাসানকেও ধরতে হবে। ‘দোষ যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা দু’জনই করেছেন।’ হোসেন হচ্ছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন, যার প্রতি বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। হাসান হচ্ছেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। দু’জনই আওয়ামী লীগের লোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই দুই অভিযুক্তকেই ধরুন, দেশবাসীর বাহবা পাবেন। ‘হায় হোসেন, হায় হাসান’ বলে দেশের মানুষ মোটেই কারবালার মাতম করবেন না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাবেক সভাপতি জাতীয় প্রেস কাব

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads