বুধবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

প্রশ্নবিদ্ধ শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলন



দেশে যেন আর কোনো বিষয় নেই, একটাই বিষয় এবং তা হলো যুদ্ধাপরাধের বিচার। এই বিচার আবার আদালতের বিবেচনায় হলে চলবে না, রায় দিতে হবে শাহবাগ মঞ্চের ব্লগারদের ইচ্ছে অনুযায়ী। আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের রায় ব্লগারদের পছন্দ হলো না, তাই তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের শাহবাগ মঞ্চে জড়ো করে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে চাপ সৃষ্টি করলো। সরকারও সে লক্ষ্যে সুড়সুড় করে সংসদে গেল এবং আইনও সংশোধন করলো। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা যেখানে তাদের দাবি দাওয়া উচ্চারণের জন্য একটু দাঁড়াবার জায়গা পায় না, সেখানে দু'টি হাসপাতালের মাঝখানে রাজপথ বন্ধ করে দিনের পর দিন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে শাহবাগ মঞ্চের ব্লগাররা। এ দিনে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, প্রথমদিকে বাম ঘরানার লোকজন শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলন শুরু করলেও সামনের নির্বাচনকে মাথায় রেখে তাতে যুক্ত হয়ে পড়েছে সরকারি দলও। এখন তো সরকারের প্রশ্রয়ে এবং সহযোগিতায় শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলন প্রলম্বিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে যে হম্বি-তম্বি ও লম্ফ-ঝম্ফ, সেই বিচারের ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করেছে কি?
যে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়। তবে তাদের বক্তব্য হলো, যুদ্ধাপরাধের বিচারটি যেন ‘সাজানো বিচার' না হয় এবং রাজনৈতিক স্বার্থে নির্দোষ ব্যক্তিদের যেন অপরাধী সাব্যস্ত করা না হয়। পৃথিবীর সব মানুষই একথা স্বীকার করে যে, অনুরাগ ও বিরাগের পরিবেশে কোনো বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। বিচার কোনো মঞ্চ নয়, বিচার করবে আদালত। আদালত যাতে নিরপেক্ষভাবে সঠিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার করতে পারে তেমন পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে সরকার নিজেই শাহবাগ মঞ্চের পক্ষ অবলম্বন করে একটি পক্ষপাতদুষ্ট পরিবেশ সৃষ্টিতে তৎপর রয়েছে। এমন অবস্থায় কতটা ন্যায়বিচার সম্ভব সেই প্রশ্নই দেখা দিয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার যদি প্রকৃত লক্ষ্য হতো, তাহলে শাহবাগ মঞ্চ তৈরির কোনো প্রয়োজন হতো না। মুক্তিযুদ্ধের চ্যাম্পিয়ন বর্তমান সরকারই তো যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠন করেছে, বিচারক নিয়োগ দিয়েছে এবং বিচারকরা রায় প্রদানও শুরু করেছেন। একজনের ফাঁসি দিয়েছেন, একজনের দিয়েছেন যাবজ্জীবন। কিন্তু যাবজ্জীবনের রায় মনঃপুত না হওয়ায় একশ্রেণীর ব্লগার যখন শাহবাগ মঞ্চ তৈরি করে বিচারকে প্রত্যাখ্যান করলেন, তখন কি আদালত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় না? আসলে আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে গিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে সরকার ও ব্লগাররা। যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, এইসব ব্লগারদের লক্ষ্য যে অন্য কিছু তা প্রতিদিনই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের সাথে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া যুক্ত করেছে, ইসলামী সংগঠন নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে, ভিন্ন মতের নাগরিকদের ব্যাংক-বীমা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার উস্কানি দিয়েছে এমন কি তাদের অপছন্দের নাগরিকদের ভোটার তালিকা থেকে নাম কাটার আবদারও করেছে। তাদের নিত্যনতুন স্লোগান ও দাবি দাওয়া থেকে এখন এ ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা যুদ্ধাপরাধ বিচারের আড়ালে আসলে দেশ থেকে ইসলামী সংগঠন ও ইসলামী রাজনীতি উৎখাত করতে চায়। তাদের এই উদ্দেশ্য যাতে দেশবাসীর চোখে ধরা না পড়ে সে কারণেই তারা মুখোশ পরে নানা কৌশলে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। শাহবাগ চত্বরে নেতৃত্ব প্রদানকারী ব্লগারদের জীবন যাপন ও লেখালেখি বিশ্লেষণ করলে উপলব্ধি করা যায় তারা কতটা ইসলামবিদ্বেষী। ব্লগার রাজীবকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। ‘শহীদ' শব্দটি ইসলামের একটি পরিভাষা। রাজীব কি এই পরিভাষায় ইসলাম ধর্মের মূল বিষয়গুলোকে বিশ্বাস করতো? বিশ্বাস করলে তার লেখায় এতটা ইসলাম বিদ্বেষ ফুটে উঠতো না, তার জীবনযাপনেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে একই চিত্র। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, প্রচন্ড ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার রাজীব হত্যাকান্ডের নেপথ্যে রয়েছে তার গার্লফ্রেন্ড তানজিলা। তিন মাস ধরে স্ত্রী অনিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না রাজীবের। স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে গার্লফ্রেন্ড তানজিলাকে নিয়েই থাকতো রাজীব। তানজিলা ছাড়াও আরেক প্রেমিকা রাফির সঙ্গে অবাধ মেলামেশার তথ্য  পাওয়া গেছে রাজীবের আত্মীয় ও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে। ঘটনার দিন রাজীবের বাসাতেই ছিল তানজিলা। পুলিশ রাজীবের মা নার্গিস হায়দারের বাসা থেকে তানজিলাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। ঐ বাসায় প্রচুর নেশার উপকরণ ও মদের বোতল পাওয়া গেছে। শুধু রাজীবই নয়, অনলাইনে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো ও নাস্তিক্যবাদ প্রসারে তৎপর শাহবাগ আন্দোলনের আরেক উদ্যোক্তা আসিফ মহিউদ্দিন। নিজেকে নাস্তিক পরিচয় দিয়ে সে ফেসবুকে লিখেছে, ‘মানুষের কোন উপাস্য নেই, এমনকি আল্লাহও। হাজারো ঈশ্বরের সৃষ্টি মানুষের অমিত সৃষ্টিশীলতারই নিদর্শন'।
আসলে শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলনকারীদের মূল লক্ষ্য কি তা ক্রমেই দেশের জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাদের জীবনাচার থেকেও উপলব্ধি করা যায় কেন তারা ইসলামবিদ্বেষী। এ কারণেই আশির দশকের ১০১ ছাত্র নেতা প্রশ্ন রেখেছেন, শাহবাগ চত্বরের বিপ্লবীদের মূল চেতনা যদি হয় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি, তাহলে এ চেতনার সাথে ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবা টেবলেটসহ বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্য সংযুক্ত হলো কেমন করে? সন্ধ্যার পর শাহবাগ চত্বরে গাঁজার গন্ধে টেকা যায় না। গভীর রাতে সেখান থেকে পুলিশ গাড়িভরে হাজার হাজার ফেনসিডিলের খালি বোতল সরিয়ে নেয়। তারা আরো প্রশ্ন রাখেন, শাহবাগ চত্বরের বিপ্লবীদের লক্ষ্য যদি শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হতো, তাহলে তাদের মঞ্চ থেকে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার চরিত্র হননের জন্য প্রতিনিয়ত অশ্লীল ও অশ্রাব্য ভাষায় বক্তব্য রাখা হবে কেন? শাহবাগের বিপ্লবীরা দেশপ্রেমিক হলে এবং তাদের উদ্দেশ্য মহৎ সে কথা প্রমাণ করতে হলে তাদেরকে অবশ্যই বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলতে হবে। কিছুটা বিলম্ব হলেও শাহবাগ চত্বরের ব্লগারদের উদ্দেশ্য টের পেয়েছে বিএনপি। গত মঙ্গলবার বিএনপির এক বিবৃতিতে বলা হয়, শাহবাগে কথিত প্রজন্ম চত্বরের ব্লগাররা মহান আল্লাহ, রাসূল (সাঃ) এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যে কদর্য, অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ ও স্টাটাস ও মন্তব্য করে ইন্টারনেটে পোস্ট করেছে তা সুদূরপ্রসারী দুরভিসন্ধি, হীনউদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। তাদের এ তৎপরতা দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হেনেছে। এদিকে শাহবাগের নাস্তিক ব্লগারদের মহান আল্লাহ, পবিত্র ইসলাম ধর্ম, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাতসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধান এবং মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ও কটূক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে দেশের আলেম সমাজ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ইসলাম ধর্ম ও নবী (সাঃ) অবমাননাকারী নাস্তিক মুরতাদদের সর্বাত্মক প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়ে তারা বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এক নাস্তিক ব্লগার অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে ইসলামবিদ্বেষী অপকর্ম করে চলেছে। এদিকে শাহবাগ মঞ্চের নাস্তিক ব্লগারদের চরম ইসলামবিদ্বেষী অপপ্রচারের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় তাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পত্রিকান্তরের খবরে বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলনে সরাসরি ও নেপথ্য থেকে নেতৃত্ব দেয়া এই উগ্র নাস্তিক চক্রের অনেক সদস্য বর্তমানে গা ঢাকা দিয়েছে। নিয়মিত শাহবাগে হাজিরা দেয়া অনেককে এখন শাহবাগ এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। ইসলামপ্রিয় সাধারণ মানুষ তাদের শাস্তির দাবিতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এরপর থেকে জনরোষের ভয়ে ঐসব ব্লগার একা চলাফেরা কমিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। এ রকম এক নাস্তিক ব্লগারকে গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এদিকে আতঙ্কিত নাস্তিকরা বিভিন্ন ব্লগ ও সামাজিক মাধ্যমে তাদের প্রকাশিত ইসলামবিদ্বেষী লেখাগুলো সরিয়ে ফেলছে। অনেকে ফেসবুকে তাদের প্রোফাইলে তথ্য ও ছবি অন্য ভিজিটরদের দেখার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন শুধু সাধারণ জনগণই নয়, খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও এসব নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ ও শাস্তি দাবি করতে দেখা গেছে। অনেকে এখন এসব ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। এজন্য হয়তো প্রবাদবাক্যে বলা হয়েছে ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি'। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন বিচারকরা স্বাধীনভাবে যেন তাদের বিচার কাজ পরিচালনা করতে পারেন, সেই লক্ষ্যেই এখন সরকারের দায়িত্ব পালন করা উচিত। প্রশ্নবিদ্ধ শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলনকে যদি সরকার প্রশ্রয় দিয়ে যান, তাহলে দেশের বিচার ব্যবস্থার ভাব-মর্যাদাই শুধু ক্ষুণ্ণ হবে না, ক্ষুণ্ণ হবে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং আগামী নির্বাচনের স্বচ্ছতাও। বিষয়টি সরকার উপলব্ধি করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads