শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আওয়ামী-বামরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয় ফাঁসি চায়!!


ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম  :
 ফ্যাসিবাদ বা Fascism বলতে লগ্নিপূঁজির উগ্র সাম্রাজ্যবাদী এবং উগ্র প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে উদ্ভূত সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্রকে বুঝায়। যুগে যুগে এই ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছিল। যখন শাসকগোষ্ঠী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আর সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে তখনই এই পথের আশ্রয় নিয়েছে। ফ্যাসিবাদের দুই প্রধান মহানায়ক ছিল ইতালির বেনিটো মুসোলিনি এবং জার্মানির এডলফ হিটলার। মূলত শোষিত, মজলুম আর নির্যাতিত শ্রেণীর আন্দোলন ও শক্তিকে দমানোর জন্যই এর উদ্ভব হয়। এই কাজে তারা প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে। ১৯২২ সালে ইতালিতে আর ১৯৩৩ জার্মানীতে ফ্যাসিবাদের গোড়াপত্তন হলেও আজকের বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর চরিত্রের সাথে অমিল পাওয়া খুবই দুষ্কর। সরকার পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, আইনশৃক্মখলার চরম অবনীতি, দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার যখন সমাজের সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ। ঠিক তখনই সরকার মানুষের নজরকে ভিন্নদিকে সরানোর জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আওয়ামী-বামদের যৌথ প্রযোজনায় শাহবাগ নাটক সাজানো হয়েছে। একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি তত্ত্বাবধায়ন ও রাষ্ট্রীয় তহবিল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে ব্লগার একটিভিস্ট নামের নাম সর্বস্ব একটি সংগঠনের ব্যানারে শাহবাগের এই আয়োজন। আমাদের দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন তরুণদের ওপর এই দায়িত্বভার দেয়ার পর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ও সংস্থার সাথেও এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয় বলে বিশ্বস্ত সূত্র দাবি করছে।
শাহবাগ নাটকের সূচনা করে ব্লগার একটিভিস্ট এর ডা. ইমরান। ইমরান রংপুর মেডিকেলে কলেজ শাখার ছাত্রলীগের নেতা ছিল। যেই ইমরানের নেতৃত্বে স্পিকারকে স্মারকলিপি দিয়ে সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি নিশ্চিত করতে আইন সংশোধন, আমার দেশসহ মিডিয়া বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে, মহাসমাবেশের সভাপতি ও চরমপত্র পাঠকারী ব্লগার ইমরান কট্টর আওয়ামী লীগ। তিনি পেশায় চিকিৎসক এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা। শুধু তাই নয়, ইমরান সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ‘রাজাকার' অভিহিত করে সংসদ ভবন সংলগ্ন জিয়া উদ্যানে অবস্থিত শহীদ জিয়ার মাজার নিয়েও কটাক্ষপূর্ণ ও আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। ইমরান তার ফেসবুকে জিয়াউর রহমানকে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাসে লিখেছে, ‘জাতীয় সংসদ প্রাঙ্গণে রাজাকারের কবর রেখে এই পূজা আর কত দিন? এ সার্কাস আর দেখতাম চায় না প্রজন্ম... এই শালাদের কোনো নিশানা রাখা যাবে না এই বাংলায়।' আবার ইমরান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘যে শ্রেণীরই হোক না কেন গর্ব করার মতো বাঙালির যা কিছু বিদ্যমান তার অন্যতম বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর ক্ষয় নেই।' জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি, দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম, সোনার বাংলা ব্লগ নিষিদ্ধ করাসহ ছয় দফা দাবি নিয়ে শাহবাগে আন্দোলনকারী জনতার প্রতিনিধিরা স্পিকার আবদুল হামিদকে স্মারকলিপি প্রদান করে। ইমরানের পরিচয় জানার পর সারাদেশবাসীর আর বুঝতে বাকি থাকেনি এই সমাবেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি? ক্রমান্বয়ে আওয়ামী-বামরা ছড়িয়ে দেয় সারাদেশে। শাহবাগের সমাবেশ এখন ফ্যাসিবাদ, অশ্লীলতা, মদ গাজা, আর অপসংস্কৃতির অভায়রণ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে।
শাহবাগ নাটকের মিডিয়া কাভারেজের জন্য একজন বামপন্থী মন্ত্রী ও একজন সাবেক বামপন্থী বর্তমান আওয়ামী লীগের নতুন প্রেসিডিয়াম সদস্যকে দায়িত্ব দেয়া হয়। লোক জনসমাগমের জন্য একজন প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগও সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং ঢাকার সকল এমপিদের নির্দেশ দেয়া হয়। বিশেষ করে এমপিদের দায়িত্ব দেয়া হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে ছাত্র-ছাত্রীদের শাহবাগের আন্দোলনে আসতে বাধ্য করা হয়। এতে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
রাজধানীর শাহবাগসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ফ্যাসিবাদী আক্রমণের শিকার হলো দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের পক্ষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর পাঠকপ্রিয় জাতীয় পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ। অবস্থান কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বামদের নিয়ন্ত্রণ যতই বাড়ছে ততই ফ্যাসিবাদী হুঙ্কার ও ভিন্নমত দলন-দমনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে নয়া দিগন্ত পত্রিকা অফিসে আক্রমণ হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলাম শব্দ যোগ করা প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রমণ চালিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। এই সুযোগ নিয়ে কেউ যদি আওয়ামী লীগ ও বাম নেতাদের ব্যাংক বীমা অফিসে হামলা করতে শুরু করে। তাহলে পরিস্থিতি কোন্ দিকে যাবে? কারণ আওয়ামী লীগ যতই ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনার দিবাস্বপ্ন দেখুক না কেন গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুসারে এটি তাদের ক্ষমতার শেষ বছর এটা ভুলে গেলে চলবে না। এরপর পুলিশ প্রটেকশান আর হ্যালো বললেই সব হয়ে যাবে না। মহাসমাবেশে ফ্যাসিবাদী ভাষায় ডানপন্থী সংবাদপত্রের সমালোচনা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও বয়কটের ডাক আমার দেশ পত্রিকার কপিতে আগুন দিয়ে বিকৃত উল্লাস নৃত্য করছে। যত দিন যাচ্ছে শাহবাগ ঘিরে চলা কর্মসূচির আড়ালে শাসকগোষ্ঠীর সূদুরপ্রসারী ফায়দা তোলার সুপ্ত মতলবের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দাদের সমাবেশ থেকে যে কোনো একদিন গিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত আমার দেশ কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক লাকী আখতার মাইকে স্লোগান দেন, ‘আমার দেশ, আমার দেশ, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার', ‘একটা একটা রাজাকার ধর, সকাল-বিকাল জবাই কর' এবং ‘আর কোনো দাবি নাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই' ইত্যাদি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগের ঘোষণা, ‘রাজাকারদের পত্রিকা আমার দেশ-এর কোনো সাংবাদিককে এ সমাবেশে ঢুকতে দেয়া হবে না। পত্রিকাটির কোনো সংবাদিককে পেলেই আক্রমণ করতে হবে।' এই সবকিছু চলছে আমাদের দেশের নামী-দামি সুশীল! আর বুদ্ধিজীবীদের সামনেই!!
অধিকাংশ স্লোগানের মূল কথা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের সম্পত্তি দখল করা এবং দলটির নেতাকর্মীদের হত্যা বা জবাই করা। জবর-দখল বা হত্যা-জবাইয়ের মতো ফ্যাসিবাদ উস্কে দিয়ে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার এসব স্লোগানে দেশ-বিদেশের সচেতন নাগরিকরা বিস্ময় প্রকাশ করছেন। সমাবেশে উচ্চারিত স্লোগানের মধ্যে আছে, ‘একটা একটা শিবির ধর সকাল বিকাল জবাই কর', ‘জামায়াতের আস্তানা গুড়িয়ে দাও গুড়িয়ে দাও', ‘জামায়াতের আস্তানা দখল কর দখল কর', ‘সাম্প্রদায়িকতার আস্তানা ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও', ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো শিবির ধরে জবাই করো', ‘শিবির ধরো শিবির ধরো সকাল বিকাল জবাই করো', ‘একটা একটা শিবির ধর সকাল-বিকাল নাস্তা কর', ‘বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াত-শিবিরের ঠাঁই নাই' ইত্যাদি। সমাবেশের পঞ্চম দিনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উপস্থিতিতে ভারতীয় হিন্দুদের রীতিতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। সন্ধ্যার পর জ্বালানো হয় ছয় হাজার ৪০০টি প্রদীপ। ৬৪ জেলার প্রতিটির জন্য ১০০টি করে প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রদীপ জ্বালিয়ে শুরু হয় শাহবাগের রাতের কর্মসূচি। তাহলে আমরা কোন্ সভ্য সমাজে বাস করি? যেসব নামকরা বুদ্ধিজীবী নামের পরজীবীরা শাহবাগে গিয়ে হত্যার উস্কানি দিয়ে মানবাধিকার লংঘন করে মানবতাবিরোধীদের বিচার চাচ্ছেন, ধিক! তাদেরকে ধিক! তাদের বিবেকের এই বন্দীদশাকে। প্রকাশ্য জবাই করার স্লোগান মিডিয়ায় প্রচার করে উল্লাস করা হয়। জবাই করার স্লোগান দিয়ে সত্যিই আমরা কি কসাই আর বর্বর জাতির খাতায় নিজেদের নাম সংযোজন করছি? হত্যা করার এমন উস্কানি আইনের কোন্ মানদন্ডে পড়ে, জাফর ইকবাল গংরা বলতে পারবেন কি? আর এই উস্কানির মধ্যে দিয়ে যত হত্যা সহিংসতা ঘটবে তার দায় কি ইন্ধনদাতারা এড়াতে পারবেন কি? এই উস্কানিতে ইতোমধ্যেই ১২ জন ছাত্রশিবিরের মেধাবী তাজাপ্রাণ ঝরে পড়েছে। যাদের উস্কানিতে এই মায়েদের বুক খালি হলো তারা যদি শাহবাগের উস্কানিদাতার বিরুদ্ধে মামলা করে, ক্ষমতার জোরে ২৮ আক্টোবরের মামলা থেকে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মতো আজকে মুক্তি পেলেও একদিন হয়তো আপনাদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে! আর দুনিয়ার আদালত থেকে রেহাই পেলেও আল্লাহর আদালত থেকে আপনারা রেহাই পাবেন না।
কবি আবদুল হাই শিকদার লিখেছেন : ‘‘ছাত্রশিবিরের আন্দোলন মোকাবিলায় বেসামাল সরকার যখন হিটলার কিংবা চেঙ্গিস খানের মতো নৃশংসতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যা করছে ছেলেদের, তুলে নিচ্ছে চোখ, পশুর মতো পিটিয়ে করে দিচ্ছে বিকলাঙ্গ, তখন সেসব নিয়ে কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না শাসকরা। তারা বাংলাদেশের মানুষের গণদাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পদ্মা সেতু কিংবা হলমার্কের মতো পাহাড় সমান ইস্যুগুলোকে পাথরচাপা দিয়ে, নিজেদের দুষিত মুখ ডিসটিলড ওয়াটারে ধুয়ে ফের বীর হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য একাত্তরের শত্রু উচ্ছেদের নামে নয়া এজেন্ডা সামনে ঠেলে দিয়েছে। এ কাজে ব্যবহার করছে ডান্ডাবাজ ছাত্রলীগ, পেটোয়া যুবলীগ এবং নিজ গৃহে পালিত সাংস্কৃতিক কর্মীদের। আর জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য আবরণ হিসেবে, ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে কিছু আবেগাক্রান্ত তরুণকে। এই বাকশালের পদধ্বনি শাসকদল তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে দেশময়। নইলে যুদ্ধাপরাধীদের নাম করে বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যেসব ভয়াবহ উচ্চারণ করানো হয়েছে তা দেশে ডেকে আনবে নৈরাজ্য, বিপর্যয় ও গৃহযুদ্ধ। জামায়াত-শিবির দমনের ছদ্মবেশে তারা আসলে চাচ্ছে দেশপ্রেমিক শক্তির সমূলে উৎপাটন।’’
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কি তিনি তার বাবার সমাধানকৃত যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটি জাগিয়ে তুলে মূলত বাবার সাথে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন কি? এতে তিনি আদৌ কি সফল হবেন?
যুদ্ধাপরাধ আইন ও ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মান নিয়ে শুরু থেকে বিতর্কের শেষ নেই। মূলত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের সাথে বেলজিয়াম প্রবাসী জিয়া উদ্দিনের স্কাইপি সংলাপ ইকোনমিস্টসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সেই বিতর্ক দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিচারপতির হকের পদত্যাগ-ই মূলত এই ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর বিশ্বাসযোগ্যতার দিকটি আরো প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে। আর আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিষয়টি ঐ পর্যন্ত থেকে যায়। কিন্তু আইন বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন পৃথিবীতে কোন আইন বা ট্রাইব্যুনাল নিয়ে এর আগে এত বিতর্ক হয়েছে কিনা? এই আইন বিচার হয়তো ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত, বিতর্কিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচার হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে। আওয়ামী লীগ একটি অসৎ উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল। দিন যত যাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বামদের তৎপরতাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তাদের উদ্দেশ্য প্রকৃত দোষীদের বিচার নয় বরং রাজনৈতিক পতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে শেখ মুজিবুর রহমানও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন এ কথা সত্য, কিন্তু তিনি কেন সফল হতে পারেননি? তা আজকে এই বিচারের সময়ও বিবেচনায় আনতে হবে। এর অনেকগুলো কারণ ছিল। সাংবাদিক অ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড' বইতে এইভাবেই তা বর্ণনা করেন- ‘‘আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাস, দলের হিংসাত্মক কর্মকান্ড, হত্যা, লুটতরাজ ইত্যাদিতে চতুর্দিক থমথমে হয়ে উঠলো। তাছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই ব্যর্থ হলেন। দলের আভ্যন্তরীণ ও নিজ আত্মীয়-স্বজনের বেপরোয়া ভাব ছিল সবচেয়ে আলোচনা ও সমালোচনার ব্যাপার। তাছাড়া বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি ও অবকাঠামো এবং ক্রমাবনতিশীল আইনশৃক্মখলার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তেলের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, তারই ভয়াবহ প্রভাব বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে এক বিপর্যয়কর আবর্তে টেনে নেয়।’’ গোটা পরিস্থিতি বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর মতোই নিয়ন্ত্রণ হয়ে পড়ে গোটা সংগঠন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে মাওলানা ভাসানীসহ জাতীয় সকল নেতারা প্রবল বিরোধিতা করেন। শেষ অবধি শেখ মুজিবুর রহমান এই বিচারের কাজ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হন। যে কারণে শেখ হাসিনার বাবা এই বিচারে সফল হননি। তার থেকে ভয়াবহ রূপ এখন দেশে বিরাজমান।
আওয়ামী লীগ আজ ব্যর্থ হয়েই মূলত শাহবাগের এই জায়গা থেকে আওয়ামী-বামরা সেই ফ্যাসিবাদের হুংকার দিচ্ছে। এই হুংকারের আওয়াজের ভয়াবহতা যদি ডানপন্থী আর মধ্যপন্থী আর দক্ষিণ হস্তের শক্তির বুঝে উঠতে যদি বেশি সময় লাগে তাহলে এর জন্য অনেক খেসারত দিতে হবে গোটা জাতিকে। বিশেষ করে বিরোধীদলকে। এটিকে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মঞ্চ মনে করে আমাদের বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমান তাহলে পরিস্থিতি অনেক জঘন্য জায়গায় গিয়ে ঠেকবে। কেউ যদি মনে করে থাকে এই আওয়াজ শুধু দিগন্ত টিভি, পত্রিকা জামায়াতের প্রতিষ্ঠান আর পত্রিকার বিরুদ্ধে তাহলে সেটি হবে মহাভুল। ডানপন্থী চ্যানেল, পত্রিকা ওয়ালারা মনে করেন আমাদেরতো কিছু বলছে না। আমার দেশ তো মাহমুদুর রহমানের পত্রিকা, তার বিরুদ্ধে বললে আমাদের অসুবিধা কি? অবস্থা দেখে মনে হয় আমাদের জাতীয়তাবাদী শক্তির মধ্যে অনেকেই মাহমুদুর রহমানের জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষুব্ধ। অনেক নেতার কাছে মাহমুদুর রহমান নেত্রীর আস্থাভাজন পরামর্শক হিসেবে চক্ষুশূল। কিন্তু তাতে কি হয়েছে? দেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে মাহমুদুর রহমানের আজকের এই অবস্থা তিনি তার যোগ্যতা বলেই অর্জন করেছেন। বরং মাহমুদুর রহমানই সেই ক্ষণজন্মা ব্যক্তি যিনি ১/১১ সময় সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লেখনির মাধ্যমে সবাইকে জাগিয়ে তুলেছেন। নচেৎ আজ যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনিও হয়তো মাইনাসের তালিকায় পড়ে যেতেন। মাহমুদুর রহমান-ই সেই বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর যিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় সন্তান জয়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নগ্ন রোষাণলের শিকার হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়ে দীর্ঘসময় কারাভোগের শিকার হয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকার যখন ইতিহাসের জঘন্যতম হিংসা, বিদ্বেষ ও মানবাধিকার লংঘনের সকল আয়োজন করে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করছে সরকার। যখন বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপি বোমা ফাটিয়ে দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা সারা পৃথিবীকে এই বিচার কার্যের জঘণ্য ইতিহাস সম্পর্কে জানান দিলেন। তখন মাহমুদুর রহমান-ই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের জীবনের কথা না ভেবে আমার দেশ পত্রিকায় সে সত্য ইতিহাস ছাপিয়ে দু'মাস নিজ অফিসে অবরুদ্ধ। সাংবাদিক অলি উল্লাহ নোমান জীবনের নিরাপত্তা না পেয়ে এখন লন্ডনে অবস্থান করছে। তবুও থেমে নেই আমার দেশ পত্রিকার লড়াই। শাহবাগ চত্বরে কি হচ্ছে? কারা করছে? তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করে তাদের আবেগকে পুঁজি করে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে আরো অনেক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে তরুণদের মাঠে নামিয়েছে সরকার, তখন মাহমুদুর রহমানের রাডারেই সবার আগে সে বিপদ সংকেত ধরা পড়েছে। তিনি ইচ্ছে করলে অনেকের মতো চোখ বুজে উট পাখির মতো থাকতে পারতেন। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির নামধারী অনেক নেতার মতো শাহবাগের আন্দোলনকে স্বাগত জানাতে পারতেন। কারণ পত্রিকা অফিসের অবরুদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে আওয়ামী লীগের করুণা বেশি তারই প্রয়োজন। কিন্তু এই আপোষহীন লড়াকু কলম সৈনিক তা করেননি। অথচ শাহবাগের আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আমার বিশ্বাস হয়তো বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পত্নী ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। তিনি বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে দিয়ে ৯ তারিখে ১৮ দলের সমাবেশ আহবান করলেন কিন্তু অনুমতির অজুহাত তুলে গভীর রাতে তা বন্ধের ঘোষণা ১৮ দলের ঐক্যেও ফাটল সৃষ্টির সুড়ঙ্গপথ তৈরি করলো। আন্দোলনের কর্মীদের মাঠপর্যায়ে দারুণ হতাশ করলো। সরকার দারুণভাবে প্রীত হলেন এই সমাবেশ না করতে দিয়ে। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রীর কাছে আমাদের সাধারণ জনগণের বিনীত অনুরোধ রইল, কোন্ অদৃশ্য শক্তি আর কোন্ নেতাদের ইশারায় এই সমাবেশ হলো না তা তিনি খতিয়ে দেখবেন। রাজনীতিতে সব সময় লাভের আশা করা যায় না। কখনও কখনও লাভ না করেও অন্তত লোকসানকে রোখা যায় এমন কাজও করতে হয়। একটা কথা এখন খুব উচ্চারিত হচ্ছে, আসলে ১৮ দলীয় জোটে জামায়াত থাকছে কিনা? সহজ সমীকরণ হচ্ছে শাহবাগের আন্দোলন মিডিয়ার অব্যাহত প্রচারণা আর তরুণ সমাজ! তরুণ সমাজ বলে বিএনপি'র কিছু ব্যক্তিকে ইতোমধ্যে জামায়াতকে জোটে রাখার ব্যাপারে স্নায়ু চাপে ফেলে দিয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান বলছে বিএনপি-জামায়াত তাদের উভয়ের প্রয়োজনেই জোটবদ্ধ থাকতে হবে। এর কোন বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা চিন্তা করে কেউই আলাদা হবেন না। কিন্তু সরকার ইতোমধ্যেই উভয়ের মধ্যে সন্দেহ তৈরিতে সফল হয়েছে। সন্দেহ আর অবিশ্বাস নিয়ে কোন আন্দোলন সফল হতে পারে না। দেশের স্বার্থেই তা দূর করা উচিত। বিএনপি শুধু শাহবাগের তরুণদের কথা ভাবলে চলবে না বরং জামায়াতের ইয়ং ফোর্স ছাত্রশিবির তাদের নিজস্ব শক্তি ও জীবন দিয়ে যা অর্জন করেছে তাও মাথায় রাখতে হবে। কারণ এই শক্তি থেকে যদি বিএনপিকে আলাদা করতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগ এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে পারবে। তাছাড়া শাহবাগের আন্দোলন যদি সারা দেশের মানুষের বাহবা কুড়াতে পারে, তাহলে এরপর এই মঞ্চ থেকে বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে আনেক কুৎসা ও বিষোদগারপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় জাগরণের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে জাতির সামনে পাস করিয়ে নিতে কোনই কষ্ট হবে না। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলের বিরুদ্ধে যে কোন ফতোয়া জায়েজ হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং শাহবাগ ইস্যুকে ১৮ দলীয় জোটের খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এর মাধ্যমে আমাদের তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের মূল্যবোধ। শুধু তাই নয়, আবার ১/১১ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে এই মঞ্চ হয়তো এক সময় আমাদের নেতা-নেত্রীদের প্লাস আর মাইনাস করার ক্ষেত্র তৈরিতে অন্য কোন শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। সুতরাং সাধু সাবধান! পোষা সাপের দংশনেই অধিকাংশ ওঝার মৃত্যু হয়েছে এটাই ইতিহাস। যে বামপন্থীরা এর আগে আওয়ামী লীগের বারোটা বাজিয়েছে, এবার তারা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা তলানীতে নিয়ে পৌঁছাবে।
mrkarim_80@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads