শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

‘নতুন প্রজন্মের' আড়ালে বাম ও আওয়ামী শক্তির কৌশলী আয়োজন


সরকারের ব্যর্থতা আড়াল ও বিরোধী দল দমনের ঢেউ সৃষ্টি করাই প্রধান লক্ষ্য

 সংশয় থাকলেও অনেকে আশা করেছিলেন, শাহবাগের কথিত গণজাগরণকে এমন সুকৌশলেই একটা সীমার মধ্যে রাখা হবে, সাধারণ মানুষ যাতে অন্তরালের উদ্দেশ্য ধরে ফেলতে না পারে। কিন্তু সে কষ্ট করার ধৈর্য দেখাতে পারেনি বাম ও আওয়ামী ঘরানার ‘নতুন প্রজন্ম'। আরো সহজ কথায় বলা যায়, অন্তরালের আসল খেলোয়াড়রাই ‘নতুন প্রজন্ড'কে সুযোগ দেয়নি। তারা চায়নি, কথিত গণজাগরণের ফাঁক দিয়ে স্বাধীন কোনো নতুন নেতৃত্ব সামনে এসে যাক এবং ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসুক। এজন্যই নিজেরা না চাইলেও ‘নতুন প্রজন্ম'কে উন্মোচিত করা হয়েছে। জনগণের কাছে তাদের ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। ‘নতুন প্রজন্মের' সামনেও তাই বিকল্প কোনো পথ খোলা থাকেনি। প্রকাশ্যেই তারা পুতুলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এতে অবশ্য আপত্তি থাকার কথা নয়। মিছিল-সমাবেশ তারা করতেই পারে। দাবি জানানোর অধিকারও রয়েছে তাদের। কিন্তু আপত্তি উঠেছে কিছু বিশেষ কারণে। দাবি জানানোর নামে আদালত অবমাননা এ রকম একটি প্রধান কারণ। দেখা যাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায় প্রত্যাখ্যানের মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ থাকেনি, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বন্দী সব নেতাকে সরাসরি ফাঁসির আদেশ দেয়ার জন্যও চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। এ যেন ‘সালিশ মানি কিন্তু বট গাছটি আমার' ধরনের ব্যাপার-স্যাপার! অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারপতিদের কাছ থেকে তারা গায়ের জোরে রায় আদায় করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ বিধান হচ্ছে সাক্ষ্য, তথ্য, দলিলপত্র, জেরা প্রভৃতির ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল যে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। ফাঁসির পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড যেমন দিতে পারেন, তেমনি অভিযোগ প্রমাণিত না হলে কাউকে আবার মুক্তি দেয়ারও অধিকার রয়েছে ট্রাইব্যুনালের। অন্যদিকে ‘নতুন প্রজন্ম'কে দিয়ে এমন দাবিই উত্থাপন করা হয়েছে যাতে এক ফাঁসি ছাড়া অন্য কোনো সাজা দেয়ার কথা মাননীয় বিচারপতিরা বিবেচনা পর্যন্ত করতে না পারেন। বোঝাই যাচ্ছে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালকে নিয়ে এদিক-সেদিক করার পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এবার তথাকথিত ‘নতুন প্রজন্ম'কে নামানো হয়েছে। শিক্ষিত ও ইন্টারনেট প্রজন্মও বিনা বাক্য ব্যয়ে দাবার ঘুঁটি হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানেই এসেছে আপত্তির অন্য এক প্রধান কারণ। কেননা, সরকারী ঘরানা থেকে এভাবে দাবি ও মেসেজ পাঠানো চলতে থাকলে মাননীয় বিচারপতিদের ওপরই শুধু প্রচন্ড মানসিক চাপের সৃষ্টি হবে না, দেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বলেও কিছু অবশিষ্ট থাকতে পারবে না। সবকিছু একেবারে তছনছ হয়ে যাবে।
এমন এক অবস্থায় সরকারের দায়িত্ব যেখানে ছিল আদালত অবমাননার অভিযোগে কয়েকজনকে হলেও গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়া এবং আদালতের স্বাধীন মর্যাদাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো, ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই সেখানে উল্টো খেলতে শুরু করেছেন। উদ্দেশ্য তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা। এ জন্যই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো অভিযোগ তুলেছে, শাহবাগ চত্বরে চলমান কর্মকান্ডকে অবলম্বন করে সরকার নিজের ব্যর্থতা আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বলাবাহুল্য, অভিযোগটিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, শেয়ার কেলেংকারী থেকে শুরু করে সর্বশেষ পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে ব্যর্থতা ও দুর্নামের পরিণতিতে সরকার এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে এসে গিয়েছিল। দেশের ভেতরে তো বটেই, বিদেশেও সরকার ব্যর্থতা ও দুর্নীতির অভিযোগে ভীষণভাবে নিন্দিত হচ্ছিল। কোনো জবাব বা কৈফিয়তেই কাজ হচ্ছিল না। এদিকে আবার মেয়াদের শেষ বছরের দিন গণনা শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীনরাও তাই অতি জঘন্য এক কুটিল কৌশলই অবলম্বন করেছেন। প্রমাণিত হতে বাকি থাকেনি যে, শাহবাগের নাটক আসলে তারাই সাজিয়েছেন। যে কোনোভাবে হলেও সর্বব্যাপী ব্যর্থতা ও দুর্নীতি আড়াল করতে চান তারা। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছে বলে শুধু নয়, সাধারণ পর্যালোচনাতেও একই সত্য বেরিয়ে আসবে।
উদাহরণ দেয়ার জন্য প্রথমে ‘নতুন প্রজন্ম' নামধারীদের দাবিগুলোর উল্লেখ করা দরকার। প্রতি মুহূর্তে উন্মত্ততার সঙ্গে স্লোগান দেয়ার পাশাপাশি গত ১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকারের কাছে তারা যে ছয় দফা দাবি পেশ করেছে, সে দাবিগুলোর কোনো একটিকেই অরাজনৈতিক বা নির্দলীয় কোনো সাধারণ গোষ্ঠীর দাবি বলার উপায় নেই। শুধু তা-ই নয়, প্রতিটি দাবির মধ্যেই রয়েছে পরিষ্কার বাম ও আওয়ামী ঘরানার তীব্র দুর্গন্ধ। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যেককে ‘সর্বোচ্চ' শাস্তি নিশ্চিত করার অর্থাৎ ফাঁসি দেয়ার দাবি তো রয়েছেই, একই সঙ্গে রয়েছে আইন পরিবর্তন করার দাবিও। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ করার জন্যও দাবি জানিয়েছে ‘নতুন প্রজন্ম'। তারা সেই সাথে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করতে বলেছে। বলেছে, দৈনিক সংগ্রাম, নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ এবং দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক ও ইবনে সিনাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও নিষিদ্ধ করতে হবে, যেগুলোর সঙ্গে জামায়ত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। পাঠকরা দাবিগুলোর মূল সুর লক্ষ্য করে দেখুন। তথাকথিত ‘নতুন প্রজন্ম' কিন্তু কোনো লুকোছাপা করেনি। পা বাড়িয়েছে সরাসরি ফ্যাসিস্ট কায়দায়। এটা অবশ্যই কোনো অরাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব নয়। একথাই বরং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ‘নতুন প্রজন্ম'কে সামনে রেখে দাবিগুলো আসলে বাম ও আওয়ামী শিবিরই হাজির করেছে। সেটা তারা করতেই পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষ বিস্মিত হয়েছে অন্য এক বিশেষ কারণে। কারণটি মাননীয় স্পীকারের অতি উৎসাহ। জাতীয় সংসদ দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান। এর সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। সেখানে কোনো গোষ্ঠী চাইলেই তাদের যেতে দেয়া এবং তাদের কাছ থেকে দাবির ফিরিস্তি গ্রহণ করা উচিত কি না সে প্রশ্নও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই আলোচিত হচ্ছে। তাছাড়া শাহবাগ চত্বর থেকে যারা গিয়েছিল তারা জনগণের তো নয়ই, এমনকি কথিত ওই ‘নতুন প্রজন্মের'ও প্রকাশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল না। তারা গেছে গোপন আয়োজনের মাধ্যমে। তারা এমনকি নিজেদের নাম-পরিচয়ও প্রকাশ করেনি। বলেছে, আন্দোলনের ‘সুবিধার্থে' কৌশল হিসেবে তারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চাচ্ছে। অন্যদিকে অমন একটি গ্রুপের কাছ থেকেই স্মারকলিপি নিয়েছেন মাননীয় স্পীকার। তিনি এমনকি ঘণ্টা দেড়েক ধরে কথাও বলেছেন গ্রুপটির সঙ্গে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, আলোচনার ফাঁকে স্পীকার আবদুল হামিদ নাকি ওই পাঁচজনকে কিছু ‘পরামর্শ'ও দিয়েছেন- যদিও এ ব্যাপারে কোনো পক্ষই জনগণকে কিছু জানতে দেয়নি।
ওদিকে সংসদের ভেতরে রীতিমতো স্তম্ভিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। শাহবাগের ‘নতুন প্রজন্ম' নামধারীরা যেদিন স্মারকলিপি পেশ করেছে সেদিনই অর্থাৎ ১০ ফেব্রুয়ারিই জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ‘দৃষ্টি আকর্ষণ করে' প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিচারের রায় দেবে ট্রাইব্যুনাল। আইন দেখেই তারা চলবে। তারপরও তাদের অনুরোধ করবো, মানুষের আকাঙ্ক্ষা তারা যেন বিবেচনায় নেন। দেশের মানুষ কি চায় সেটা বিবেচনায় নিতে এই মহান জাতীয় সংসদ থেকে তাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শুধু শাহবাগ আন্দোলনের তরুণদের পঠিত শপথ বাক্যের প্রতিটি বাক্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেননি, সেগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রতিও দিয়েছেন। বলেছেন, তাদের দেয়া স্মারকলিপির প্রতিটি বাক্যই নাকি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। এগুলোর বাস্তবায়নে যা যা করা দরকার সবই করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, বিচারের ক্ষেত্রে আইনগত দুর্বলতা দূর করার জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করা হবে। ‘নতুন প্রজন্মের' প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে রায় একটা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিচারের রায়ের পর তরুণ সমাজ জেগে উঠলো। তারা এভাবে জেগে না উঠলে সারাদেশের মানুষও এভাবে জেগে উঠতো না। অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি করেছে তারা। এই জাগরণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতার স্মৃতি বিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশেই তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এখানেই পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। তিনি তাই মনে করেন, এর নাম দেয়া উচিত ‘স্বাধীনতার তরুণ প্রজন্মের স্কয়ার'। অন্য একটি কারণেরও উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, ওখানে শাহবাগ বলে এখন কিছু নেই। এক সময় ওটা শাহবাগ হোটেল ছিল। শাহবাগ হোটেল ছিল বলেই ওই স্থানটার নাম হয়েছিল শাহবাগ। তাছাড়া শাহবাগের সঙ্গে একটু ‘পাকিস্তানী, পাকিস্তানী' গন্ধ থেকে যায়। এটা হলো বাস্তব কথা। প্রধানমন্ত্রী শাহবাগের ইতিহাস জানেন কি না সে প্রশ্ন যে ওঠেনি তা নয়। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, টেলিভিশনে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত তরুণদের দেখে তার নাকি নিজেদের অতীত সংগ্রামের কথা মনে পড়ে গেছে। ৬ দফা, ১৯৬৬, ১৯৬৯ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৭ মার্চের ভাষণসহ প্রতিটি দৃশ্য নাকি তার চোখে ভেসে উঠেছে। সেজন্য তারও শাহবাগে ‘ছুটে যাওয়ার' ইচ্ছা জেগেছে। মনে হয়েছে, এই বয়সে ‘ছুটে' গিয়ে তরুণদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাই। তারাও যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি চান সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতেও ভুল করেননি প্রধানমন্ত্রী। দেশের আনাচে কানাচে যেভাবে মানুষ জেগে উঠেছে তা দেখে প্রধানমন্ত্রীর মনে হয়েছে, এতদিনে পথচলা তার সার্থক হয়েছে। এখন তিনি খুব স্বস্তিতে, শান্তিতে ও নিশ্চিন্তে মরতে পারবেন। কারণ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাবে।
১০ ফেব্রুয়ারির সংসদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগের আরো অনেক এমপিই ভাষণ দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রীর ফুফাত ভাই এবং সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে যথারীতি তিনি ‘গভীর ষড়যন্ত্র' আবিষ্কার করেছেন। বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিতে বলেছেন। বেগম খালেদা জিয়াও এক সময় বলেছিলেন, গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীরা যুদ্ধাপরাধী নয়। তাদের মুক্তি দিতে হবে। খালেদা জিয়া নাকি আমেরিকার ‘তোষামোদি' করে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন! শেখ সেলিম তাই বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বলি, আপনি ষড়যন্ত্র পরিহার করুন। বহু অপকর্ম করেছেন। আপনি ও আপনার স্বামী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরে আসতো না। বাংলার ইতিহাসে কোনো মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকের স্থান নেই। নিজামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক হইয়েন না। খালেদা জিয়া আপনি ঘসেটি বেগম হইয়েন না। আপনার পালাবার পথ থাকবে না। বক্তৃতার এই পর্যায়ে এসে আবেগের সঙ্গে ক্রোধও উথলে উঠেছিল শেখ সেলিমের। সে কারণেই স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যেরও প্রকাশ করে বসেছেন তিনি। জাতীয় সংসদের নিয়ম-নীতির অনেক বাইরে গিয়ে ‘তুই-তুকারি' করেছেন তিনি। যেমন শাহবাগের আন্দোলনকে সাজানো নাটক বলায় বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেনের উদ্দেশে শেখ সেলিম বলেছেন, সাজানো নাটক হলে সাহস থাকলে ওইখানে একবার আয়, তোর টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। শেখ সেলিম ভুলেই গেছেন যে, খন্দকার মোশাররফের মাথায় তেমন চুলই নেই। সুতরাং টেকো মাথায় টিকিও পাবেন না তিনি। শেখ সেলিম তাই বলে থেমে পড়েননি। বলেছেন, আরেকজন আছে এম কে আনোয়ার, যাকে সবাই বলে মাথা খারাপ আনোয়ার। ওই মাথা খারাপ আনোয়ার বলেছে, এটা সাজানো প্রতিবাদ। শেখ সেলিম জানতে চেয়েছেন, প্রতিবাদ কখনো সাজানো হয়? সাজানো নাটক তোমরা জানো, ওটা আওয়ামী লীগ জানে না। আরেকজন আছে মাহাবুব (অবসরপ্রাপ্ত সেনা প্রধান জনারেল মাহবুবুর রহমান), ওয়ান ইলেভেনের সময় জুতা খেয়েছিল। এই যে কয়টায় কথা বলছে এদের বায়োডাটা খুঁজে বের করেন। এদের মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান আছে কি না জানতে চাই।
বলা দরকার, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি শেখ সেলিমের বক্তব্য নিয়েও জোর আলোচনা চলেছে। বলা হচ্ছে, বিএনপি নেতাদের যিনি ‘তুই-তুকারি' ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন সে শেখ সেলিমরাও ওয়ান ইলেভেনের সময় নাজেহাল যথেষ্টই। তাদের মধ্যে দু-চারজন তো নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও যা-তা বলেছিলেন, নেত্রীকে অশালীন ভাষায় গালাগাল পর্যন্ত দিয়েছিলেন। উদাহরণ দেয়ার জন্য প্রসঙ্গক্রমে ওবায়দুল কাদের এবং আবদুল জলিলের বক্তব্য উল্লেখ করলে শেখ সেলিমকে কিন্তু লজ্জায় পড়তে হবে। ওদিকে প্রধানমন্ত্রী তার কথা রেখেছেন। শাহবাগে ‘ছুটে' না গেলেও প্রজন্মওয়ালাদের দাবি অনুযায়ী এরই মধ্যে মানবতা বিরোধী বিচারের জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। তার নির্দেশে মাত্র দু'দিনের মধ্যে আইনমন্ত্রী সংসদে বিল পেশ করেছেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও একদিনের মধ্যে আইনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাস করার জন্য ফেরত পাঠিয়েছে। কোনো কারণে কোনো ব্যত্যয় না ঘটলে সংশোধিত আইনটি আগামী কাল ১৭ ফেব্রুয়ারি পাস হয়ে যাবে। এর ফলে অভিযুক্তদের মতো রাষ্ট্রপক্ষও ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অধিকার পাবে। সংশোধিত এ আইনটির মাধ্যমে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় যে নানামুখী ঘটনা ঘটতে শুরু করবে সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। তা সত্ত্বেও সবকিছু দেখার জন্য এই মুহূর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বিশেষ করে দেখা দরকার, ‘নতুন প্রজন্ম' নামের আড়ালে তৎপর আওয়ামী ও বামপন্থী ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীটি সংশোধিত আইন পাস হওয়ার পর শাহবাগ ছেড়ে চলে যায় কি না।
শেষ করার আগে অন্য দুটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করা দরকার। প্রথমটি হলো, ২০০৬ সালের অক্টোবরে যারা লগি-বৈঠার তান্ডব করেছিল, যাদের গুলী ও লাথির আঘাতে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদেরই একজনকে- বাপ্পাদিত্য বসুকে এবার শাহবাগে খুবই তৎপর দেখা গেছে। এ সম্পর্কে সচিত্র রিপোর্ট বেরিয়েছে ১২ ফেব্রুয়ারির দৈনিক আমার দেশ-এ। দ্বিতীয় তথ্যটি আরো মারাত্মক। কথিত গণজাগরণের আড়ালে হামলা শুরু হয়েছে ধর্মপরায়ণ মুসলমানদের ওপর। পুলিশের প্রশ্রয়ে হামলা চালাচ্ছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। ১৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আমার দেশ-এর এক সচিত্র রিপোর্টে দেখা গেছে, মতিঝিলে একজন বয়স্ক মুসলমানের দাড়ি ধরে টানাটানি করছে ছাত্রলীগের এক সন্ত্রাসী। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসার বৃদ্ধকে রক্ষার জন্য কিছুই করেনি। ঘটনাটি সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ইসলামী ও সমমনা ১২ দল এবং বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও বিশিষ্ট আলেমরা তাদের বিবৃতিতে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ইসলামবিদ্বেষী ফ্যাসিস্ট চরিত্রেরই প্রকাশ ঘটেছে। একে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে নতুন পর্যায়ে নগ্ন আওয়ামী হামলা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই ইসলামপ্রিয় নাগরিকদের ওপর আঘাত হেনেছে। এ ধরনের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছেন ইমাম, আলেম এবং ইসলামী ১২ দলের নেতারা। বলার অপেক্ষা রাখে না, কথাগুলো আসলেও একশ ভাগ সত্য। সরকারের প্রশ্রয় রয়েছে বলেই ছাত্রলীগের ওই সন্ত্রাসী এতটা ধৃষ্ঠতা দেখানোর সাহস পেয়েছে। পুলিশ অফিসারও একই কারণে মুসলিম বৃদ্ধকে রক্ষার কোনো চেষ্টা করেনি বরং সহযোগিতা করেছে সন্ত্রাসীকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মুসলমানরা যে আসলেও বিপন্ন ও আক্রান্ত হন মতিঝিলের ঘটনা তার সর্বশেষ প্রমাণ।
বিষয়টিকে গুরুতর না মনে করার এবং পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। ৯০ শতাংশ ধর্মপরায়ণ মুসলমানের দেশে এই ধৃষ্ঠতা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সে ধৃষ্ঠতাও দেখানো হয়েছে। এজন্য বেছে নেয়া হয়েছে শাহবাগের কথিত আন্দোলন সৃষ্ট পরিস্থিতিকে। অর্থাৎ একই সঙ্গে বহুমুখী উদ্দেশ্য অর্জনের পরিকল্পনা নিয়েই ‘নতুন প্রজন্ম' নামধারীদের নামিয়েছে বাম ও আওয়ামী ষড়যন্ত্রকারীরা। দেশপ্রেমিকদেরও তাই এখনই সতর্ক হওয়া দরকার।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads