বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

পুরস্কার এখন অপরাধীদের


বাংলা ভাষায় ‘শাহবাগ সিনড্রম’ নামে একটি লোককথা প্রচলন হওয়ার জোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একদল ব্লগার হঠাৎ শাহবাগের ব্যস্ত রাস্তা দখল করে নিলো। ‘ফাঁসি চাই’, ‘জবাই করো’ স্লোগান দিলো। পুলিশ ত্বরিত এসে তিন বর্গকিলোমিটার জায়গা কর্ডন করল। মেটাল ডিটেক্টর, কোজ সার্কিট ক্যামেরা ফিট করে ব্লগারদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করল। আর কী কী সুযোগ সুবিধা চাই, যেচে জিজ্ঞেস করল পুলিশ। ওয়াসা-ডেসা এগিয়ে এলো জরুরি পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও বিদ্যুৎ নিয়ে। অনেকে এগিয়ে এলো খাদ্যপানীয় ও বিনোদন সহযোগিতা নিয়ে।

ড্রাম-ঢাকঢোল বসিয়ে উচ্চ নিনাদে মাতম তুলল তারা। হাজার হাজার মোমবাতি জ্বালিয়ে আলো-আঁধারিতে তৈরি করা হলো রহস্যময় এক টুকরো বাংলাদেশ। মোমবাতির নানা কসরত, কারুকাজ প্রতিদিন ছিল। তবে একটি দিন ছিল বিশেষ। সেটি মোমবাতি প্রজ্বলনের মহাদিন। সে দিন শাহবাগের পাশাপাশি সারা দেশে জ্বলে উঠল লাখ লাখ মোমবাতি। হেফাজতে ইসলাম যাকে চিহ্নিত করেছে মূর্তিপূজকদের রেওয়াজ হিসেবে।
একটি ঘৃণিত চরিত্র থাকল। মাথায় টুপি, থুঁতনিতে দাড়ি। দাড়ি কখনো বা চাপা হয়ে কানের লতি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। এ চরিত্র যখন প্ল্যাকার্ড, ব্যানার-ফেস্টুনে বিকট চেহারা নিয়ে থাকল; সেখানে যুৎসইভাবে সেঁটে দেয়া হলো ঘৃণা উদ্রেককারী স্লোগান। কোনো যুবক আবার টুপি দাড়ি পাঞ্জাবি নিয়ে জীবন্ত চরিত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। বাড়তি হিসেবে গায়ে জড়িয়ে দেয়া হলো আরবীয় আলখেল্লা। এবার তরুণীরা ঝাঁটা নিয়ে দাড়ি-টুপিসহ সারা শরীরে  সজোরে আঘাত করতে থাকল।
ফাঁসির মঞ্চ তৈরি হলো। দাড়ি-টুপিধারীদের ফাঁসি দেয়ার অভিনয় হলো। এক কিশোর নকল করতে গিয়ে প্রাণ হারাল। উৎসাহী ওই তরুণের বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণে জানা যায়, প্রতীকী ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে রোববার রাতে শিশু-কিশোরদের ‘ফাঁসি ফাঁসি খেলা’ উপভোগ করছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। একপর্যায়ে আবদুর রহমান শাকিল নামের ওই কিশোরের গলায় ফাঁসি লেগে যায়। তার গলা থেকে দ্রুত ফাঁসির দড়ি খোলা হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি।
সন্ধ্যায় জড়ো হওয়া তরুণেরা ‘মহান’ বিপ্লবী। পরদিন প্রায় সব পত্রিকায় ব্যানার হেডিং হলো। প্রথম পাতার অর্ধেকজুড়ে আকর্ষণীয় ছবি। অনেকের চেহারা সেখানে দেখা গেল। মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানোর সেই ছবি পত্রিকা পোস্টার আকারে প্রথম পাতার পুরোটা জুড়ে ছাপাল। টেলিভিশন চ্যানেল ‘শতাব্দীর সেরা’ সুযোগ হিসেবে শাহবাগকে লাইভ কাভার করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ২৪ ঘণ্টা কতটা আর টানা যায়। উপস্থিত ব্যক্তিবিশেষকে আলাদা করে দেখানো হলো। সাক্ষাৎকার দেয়া হলো। চেহারা দেখিয়ে ‘বিপ্লবী’ হয়ে যাওয়ার এক বিরল সুযোগ আকর্ষণ করল অনেককে। তারা এলো হাজারে হাজারে এক সীমাহীন প্রদর্শনেচ্ছার উদগ্র বাসনা নিয়ে।
পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে গর্জে উঠল ‘বাঙালিরা’। সরকারি আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত শাহবাগকে অভিহিত করল দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে। সংবাদপত্রের নিউজ, ভিউজ, ফিচার সব পাতায় এক কথা। সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠলেন দুই ডজন ব্লগার। তারা হুকুম দিলেন অমুক প্রতিষ্ঠান, তমুক ব্যক্তির দেশে থাকার অধিকার নেই। পরদিনই সেই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হাওয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। রাজপথে এমন সমান্তরাল দানবীয় সরকার পৃথিবীতে এর আগে দেখা যায়নি। মহান আন্দোলন সংগ্রামের পরিবর্তে ভবিষ্যতে এটি ‘শাহবাগ সিনড্রম’ নামে নেতিবাচক পরিচিতি পেয়ে বাংলা ভাষায় স্থান করে নিতে পারে।
ব্লগারদের বায়োডাটা জনগণের সংশয় কাটিয়ে দিলো। আয়োজকদের অন্যতম একজন ব্লগার নৃশংসভাবে খুন হলেন। তিনি আল্লাহ বিশ্বাস করেন না। আপত্তি করার কারো সুযোগ ছিল না। কারো মনের ওপর অন্য কারো হাত নেই। বিশ্বাস না থাকাটা কেবল একটি ধর্মের প্রতি ঘৃণা জন্ম দেয়ায় বিস্ময় সৃষ্টি করে। সেটি তিনি উগরে রেখেছিলেন ব্লগে। জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব উঠল। বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা তাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ‘শহীদ’ বলে আখ্যা দিলেন। আরো কয়েকজন ব্লগারেরও একই পরিচিতি। তাদেরও ঘৃণা কেবল একটি ধর্মের প্রতি। আলেমরা এর প্রতিকার চাইলেন।
‘হেফাজতে ইসলাম’ আল্লাহ ও নবী সা:-এর অবমাননার প্রতিবাদ জানাল। এ প্রতিবাদে শরিক হওয়ার আহ্বান জানালেন আলেম-ওলামা, মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের প্রতি। একটি বিজ্ঞাপনে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নিজেদের অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দাবি করে তাদের কার্যক্রমের বর্ণনা দেয়। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে একটি সামাজিক আধ্যাত্মিক ও আত্মসংশোধনমূলক সংগঠন। …মুসলমানদের ঈমান-আকিদা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ইসলামের বিধান ও প্রতীকগুলোর হেফাজত সম্পর্কে মুসলমানদের সচেতন করে তোলা এবং ধর্মীয় ইস্যুতে সামাজিক আন্দোলন অব্যাহত রাখা হেফাজতে ইসলামের প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশে প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার পরিচালক, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাকুল মাদারিস) চেয়ারম্যান শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমির।
সরকারের পক্ষ থেকে ব্লগারদের জন্য নিরাপত্তার ত্বরিত উদ্যোগ নেয়া হয়। তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয় গানম্যানের। শুধু ব্লগার নয়, যেকোনো নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্লগারদের নিরাপত্তার উদ্যোগ নিয়ে সরকার প্রশংসনীয় কাজ করেছে। একইভাবে আলেম-ওলামাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে শুক্রবার সারা দেশে বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। পুলিশ তাদেরকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শনের সহযোগিতার পরিবর্তে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করল। মিছিল দেখামাত্র তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল। লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দিলো। টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করল নির্বিচারে। গুলি চালাতেও দ্বিধা করেনি তারা। এতে প্রমাণ হলো সরকার নাগরিকদের একটি অংশকে অপরাধের অভিযোগ থাকার পরও দিচ্ছে নিরাপত্তা; অন্য দিকে যারা এসব অভিযোগ তুলছেন তাদের বিরুদ্ধে নিচ্ছে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা।
দেশের কোনো জায়গায় আলেমরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। পুলিশের গুলিতে গাইবান্ধায় তিনজন, সিলেটে একজন ও ঝিনাইদহে একজন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন চার হাজার। যাকে যেখানে পাওয়া গেছে পুলিশ নির্বিচারে গ্রেফতার করেছে। পরদিন পাবনায় হরতাল পালনের সময় গুলি করে আরো দু’জনকে হত্যা করা হয়। রোববার দেশব্যাপী ডাকা হরতালের দিন মানিকগঞ্জে আরো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। হরতাল সমর্থকদের বাধা দিলে মাদরাসাছাত্রদের সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে নির্বিচারে ছাত্রদের গুলি করে। এলাকাবাসী মাদরাসাছাত্রদের পক্ষ নিয়ে এগিয়ে আসেন। এবার বেপরোয়া গুলি চালালে গ্রামবাসীসহ পাঁচজন নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক। পত্রিকা খবর দিয়েছে, শাহবাগ জমায়েতের ১৯ দিনে ২৩টি প্রাণ ঝরে গেছে।
ব্লগার রাজীব ছাড়া অন্য খুনের ঘটনা নিয়ে সরকারের স্পষ্ট অবস্থান নিপীড়িতদের বিরুদ্ধে। প্রায় সবগুলো প্রাণহানি ঘটেছে পুলিশের গুলিতে। সরকার সে বিষয়ে তদন্তের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি; অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তো অনেক দূরের বিষয়। বরং প্রতিটি ঘটনায় মামলা হয়েছে আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে। এ পর্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক আলেম-ওলামাকে দায়ী করে দেশে শত শত মামলা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ হত্যায় পুলিশ আরো উৎসাহিত হবে। হত্যাকারীরা দেখছে, ভবিষ্যতে তাদের বিচারের কোনো সম্ভাবনা নেই। এটাকে তারা এক ধরনের পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করবে নিশ্চয়ই।
শাহবাগকে কেন্দ্র করে অপরাধীদের পক্ষে সরকারের অবস্থান অরো আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। আয়োজক ব্লগারদের অন্যতম বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু। বাম-চরমপন্থীদের নিয়ে একটি বিশাল জঙ্গি গ্রুপ লালন করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যশোর অঞ্চলে খুন, লুটপাটের সাথে তারা জড়িত। তার মামা জীবন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) দুর্ধর্ষ ক্যাডার। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর সেই ভয়ঙ্কর খুনিদের মধ্যে বসুও একজন। লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ খুন করার পর লাশের ওপর নৃত্য করেছিলেন তিনি। লাশের ওপর নৃত্যদৃশ্যের অনেক ছবি রয়েছে। দৈনিক আমার দেশ  এ ছবি দিয়ে তার নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত তুলে ধরেছে ১২ ফেব্রুয়ারির পত্রিকায়।
বাপ্পাদিত্যের পক্ষ থেকে আমার দেশের  এ প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। তিনি দাবি করেননি পত্রিকায় প্রকাশিত লাশের ওপর নৃত্যরত ছবিটি তার নয়; বা এ নিয়ে তিনি পত্রিকাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতের শরণাপন্ন হননি। কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিদিন আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের জীবন নাশের হুমকি দিতে। শাহবাগ আন্দোলনের একজন নেতা হিসেবে তিনি মঞ্চ থেকে সরাসরি এ হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। অপরাধ লালনে সরকারের এ আশকারা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ভয়ানক পরিণতি বয়ে আনবে।
প্রতিদিন যখন খুনিদের পক্ষ থেকে মাহমুদুর রহমানকে খতম করে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে; সরকারের পক্ষ থেকে এই সম্পাদকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে তার উল্টো ব্যবস্থা। পুলিশকে দিয়ে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করা হলো। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় উগ্রপন্থা উসকে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে ওইসব মামলায়। ধর্মীয় অবমাননার বিরুদ্ধে পবিত্র দায়িত্ব পালন হয়ে যাচ্ছে ‘উগ্রপন্থা উসকে দেয়া’। ব্লগারদের আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম তথ্যপ্রমাণসহ ইসলাম অবমাননার অভিযোগ এনেছে। ব্লগাররা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খণ্ডাতে আসেননি। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীনÑ এ দাবি করছেন না তারা।
অভিযুক্ত ব্লগারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উচ্চ আদালতের রায়ও ছিল ব্লগারের বিরুদ্ধে। সে দায়িত্বও সরকার যথাসময়ে পালন করেনি। সরকার কি মনে করছে তাদের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন? বিশ্বাস এমনটি হলে অভিযোগের অসত্যতা প্রমাণ করে দেয়াই তো সরকারের জন্য সবচেয়ে উত্তম। এই বিষয়ে সরকার ও ব্লগারদের অবস্থান একই। অপরাধ, অপরাধীÑ এসব নিয়ে তারা কোনো কথা বলতে এখন রাজি নয়। সরকারের মন্ত্রী বলছেন, হেফাজতে ইসলামকে প্রতিরোধ করা হবে। শাহবাগ জমায়েতের সাথে তাল মিলিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার পথ খুঁজছে সরকার। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম ও মাহমুদুর রহমান কী অপরাধ করেছেন সুনির্দিষ্টভাবে তা উল্লেখ করছেন না। এ এক আজব সভ্য রাষ্ট্র!

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads