মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ধর্মহীনতা ও বাংলাদেশ


ইদানীং শিতি, সচেতন ও সুশীলসমাজের অংশবিশেষের পরিষ্কার পানি ঘোলা করার চেষ্টা দেশকে একটি অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এরা যুদ্ধাপরাধী ও ইসলাম ধর্মকে এক কাতারে দাঁড় করাচ্ছে। এদের ইন্ধনে না বুঝেই তরুণ প্রজন্মও তাদের দেখানো পথে হাঁটছে, যা তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করারই নামান্তর।

মনে রাখা ও জানা দরকার অপরাধ ব্যক্তির আর ধর্ম সার্বজনীন। ইতিহাস সাী দেয় শুধু মুসলমানেরাই যুদ্ধাপরাধী নয়। সমতলের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে পাহাড়ি উপজাতীয়রাও পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন অনেকে। তাদের মধ্যেও রাজাকারের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। অপর দিকে স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিতে যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল তারাসহ সব মুক্তিযোদ্ধার ৯০ শতাংশই ছিল ইসলামপন্থী মুসলমান। ইদানীং শুধু ইসলাম ধর্মই নয়, অনেকেই নিজেদের স্মার্ট প্রমাণ করতে নিজ নিজ  ধর্মের বিরোধিতা করছে। কয়েক দশক ধরে এই নব্য বর্বরদের উদয় ঘটেছে বাংলাদেশে। দাউদ হায়দারের হাত ধরে তসলিমা নাসরীন থেকে বর্তমান সময়ের কিছু ব্লগার পর্যন্ত এই যাত্রার যাত্রী। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার ধর্মের যথাযথ ব্যাখ্যা না জেনে ও না বুঝেই শুধু শর্টকাট পথে পরিচিতি পাওয়ার ও নিজেদের স্মার্ট প্রমাণ করতেই ধর্মকে অবমাননা করে লেখালেখি করছে।
বাংলাদেশের প্রোপটে মনে রাখা দরকার এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। এখানকার ভালো কাজে যেমন অধিক হারে তাদের পাওয়া যাবে, একইভাবে খারাপ কাজে সংখ্যানুপাতে তাদের পাওয়া যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ভারতের েেত্রও ওই একই সূত্র। যেহেতু ভারতের বেশির ভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী, তাই ভারতে ভালো কাজের সাথে যেমন হিন্দুরা যুক্ত, তেমনি খারাপ কাজের সাথে জড়িতরাও বেশির ভাগই হিন্দু। আর এ কারণেই ধর্ম নয়, অপকর্মের জন্য দোষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। মনে রাখা দরকার কিছু মুসলমান যেমন মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তেমনি মাদরাসা শিায় শিতি দাড়ি মুখে টুপি পরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন মাওলানা ভাসানীও। যতটুকু জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ব্যক্তিজীবনে ধর্মভীরু ছিলেন এবং শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশে নির্মমভাবে সপরিবারের নিহত হওয়ার পেছনে মস্কোপন্থীদের অবজ্ঞা করে ওআইসির সম্মেলনে যোগদান করাও ছিল অন্যতম একটি কারণ। যার ফলে তিনি ভারতসহ অনেকের রোষানলে পড়েছিলেন।
এ পর্যন্ত ধর্মের নামে যত অপকর্ম হয়েছে তা হয়েছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে, কোনো কারণেই তা ধর্মের প্রয়োজনে হয়নি। বর্তমান প্রগতিশীল অধার্মিকেরা তো ধর্ম পালনই করে না, তারা কিভাবে জানবে ধর্মের গুরুত্ব। পৃথিবীর সব ধর্ম শান্তির সপ।ে কোনো ধর্মই হানাহানিতে বিশ্বাস করে না।
ব্যক্তিস্বার্থে যেমন কিছু মুসলমান বাংলাদেশের সৃৃষ্টিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, মানুষের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে, নারী ধর্ষণ, মানুষ খুন করেছে। তেমনি ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রত্য সহায়তায় হাজার হাজার মুসলমানকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ওই গণহত্যায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদির নির্লিপ্ততাকে দায়ী করেছেন। সম্প্রতি আমেরিকা নরেন্দ্র মোদিকে আমেরিকা সফরের অনুমতি দেয়নি তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ থাকায়। নরেন্দ্র মোদি কিন্তু হাজার হাজার মুসলমান হত্যা করিয়েছেন হিন্দুত্ববাদকে রা করার জন্য নয়। তিনি মুসলমান নিধনে উৎসাহ দিয়েছেন ভারতের ৯০ শতাংশ হিন্দুর আবেগকে নির্বাচনী ব্ল্যাকমেইল করার জন্য এবং তিনি তার কূটচালে সফলও হয়েছেন। গণহত্যার অভিযোগের পরও নরেন্দ্র মোদি মাসখানেক আগে তৃতীয়বারের মতো তার রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন এবং তাকে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
পাশাপাশি পাকিস্তানের রাস্তাঘাটে, মসজিদে এমনকি ঈদের নামাজের জামাতে পর্যন্ত বোমা বিস্ফোরণে শত শত মানুষ জীবন দিচ্ছে। পাকিস্তানে যারা বোমা মারছে তারাও মুসলমান, আবার যারা অকাতরে জীবন দিচ্ছে তারাও মুসলমান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভারতে মুসলমান গণহত্যা ও পাকিস্তানের মুসলমানে মুসলমানে  যুদ্ধ কি প্রমাণ করে না যে, ধর্মের জন্য নয় ব্যক্তিস্বার্থেই ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী যুদ্ধাপরাধ করেÑ রাজাকার হয়, ব্যক্তির উসকানিতেই অয্যোধায় গণহত্যা হয়, দলীয় সুবিধা পেতেই পাকিস্তানে এক মুসলমান আরেক মুসলমানের মসজিদে বোমা মারে?
তবে কেন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী বলতে কিংবা জামায়াত-শিবির বলতে দাড়ি টুপিকে চিহ্নিত করা হবে? কেন কিছু ব্যক্তি বা দলের অপকর্মকে ধর্মের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর অবমাননার প্রতিবাদকে ‘যুদ্ধাপরাধীকে রার’ চেষ্টা বলে অবহিত করাটা কি ইচ্ছা করেই শক্ত প্রতিপক্ষ তৈরি করে  যুদ্ধাপরাধের বিচার বিলম্বিত করার জন্য?
দাড়ি-টুপি ইসলামের চিহ্ন। এ ছাড়াও অনেক ধর্মের ধার্মিক পুরুষেরই দাড়ি-টুপি আছে। এই দাড়ি-টুপি পরা মানুষ যেমন যুদ্ধাপরাধ করেছে আবার এই দাড়ি-টুপি পরা মওলানা ভাসানীই প্রথম অত্যাচারের প্রতিবাদে পাকিস্তানিদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন।
তাই সরকারকে সচেতন হওয়া দরকার ধর্মবিদ্বেষীদের ব্যাপারে। এ দেশ সব ধর্মের মানুষের দেশ। বাংলাদেশ কোনো ধর্মহীনদের দেশ হতে পারে না। হজরত শাহজালাল (রহ:) যেমন এ দেশে শায়িত আছেন, তেমনি অতীশ দীপঙ্কর থেকে শুরু করে শ্রী অনুকূল চন্দ্র ও লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মতো ধার্মিকের জন্ম এ দেশের মাটিতেই হয়েছে। অতএব এ দেশের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবেও চিরকাল। আধুনিকতার নামে, সুশীলতার নামে বাংলাদেশকে ধর্মহীন করা যাবে না।
বর্তমান সরকার তাদের অপকর্ম ঢাকতে এখন খড়কুটো ধরে সমুদ্র পাড়ি দিতে চাচ্ছে। যা সঠিক নয়। দলমত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এ দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প।ে সেখানে কেন সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারছে না? কেন ইসলামি আন্দোলনকে ‘যুদ্ধাপরাধী রার আন্দোলন’ বলে অপপ্রচার করা হচ্ছে? যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারা দেশ আজ এককাতারে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে কেন সরকার সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জামাত-শিবির আখ্যা দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? নবী সা:-এর অবমাননার বিরুদ্ধে ‘তৌহিদি জনতার’ ব্যানারে গত ২২ ফেব্রুয়ারি যে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়েছে তার নেতৃত্বে ছিল দেশের কয়েকজন পীরের মুরিদ, স্বতন্ত্র কয়েকটি ইসলামি দল ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসল্লি।
যুদ্ধাপরাধ মামলার বাদি সরকার, সাী সরকার মনোনীত, তদন্তকারী সরকার মনোনীত, প্রসিকিউশন সরকারি দলের লোক, বিচারক সরকার নিয়োগ দিয়েছে, সেখানে সরকার কেন রায় মানছে না কিংবা সরকার কেন কাদের মোল্লাকে ফাঁসির রায় না দিয়ে যাবজ্জীবন দিলো? আবার সরকারই কেন তরুণদের উসকানি দিচ্ছে? তা-ও মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। তরুণদের একবারের জন্য হলেও ভেবে দেখা দরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো একটি সেনসেটিভ মামলায় কেন বাদি অর্থাৎ রাষ্ট্রের আপিল ক্ষমতা রহিত করে আইন করা হয়েছিল? একজন মানুষকে মুসলমান হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে ঈমান। আর আল্লাহ তায়ালা দেশপ্রেমকে ঈমানের অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অর্থাৎ একজন প্রকৃত মুসলমান ধর্মীয় কারণেই দেশদ্রোহী হতে পারে না। আর যারা দেশবিরোধী তারা অবশ্যই প্রকৃত মুসলমান নয়। তবে কেন দেশপ্রেমের বিপরীতে ইসলাম  ও দাড়ি-টুপিকে দাঁড় করানো হচ্ছে?
প্রজন্ম চত্বরে সমবেত তরুণদের মধ্যে অধার্মিকের সংখ্যা কত? আমার ধারণা শাহবাগে নাস্তিকের সংখ্যা উপস্থিতির ১ শতাংশও নয়। বাকি সবাই যার যার ধর্মের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাশীল। তবে কি সরকারই যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বিলম্বিত করার জন্য তরুণদের ভুল পথে পরিচালিত করে কিংবা তাদের ভুল বুঝিয়ে মতার মসনদ শিকার করতে পানি ঘোলা করছে? নাকি নবপ্রজন্ম যখন বুঝতে শুরু করেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারের বিভিন্ন নাটকীয়তা তখন তাদের হাতে রাখার জন্য সরকারই জনজোয়ারকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করে দিয়েছে? যাতে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিলম্বিত হয় এবং কিছু দিন পর শেষ মুহূর্তে এসে বিচারের দায়িত্ব পরবর্তী সরকারের কাঁধে দিয়ে যেতে পারে। তখন এরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে ভবিষ্যৎ সরকারকে প্রতিদিন মিছিল-মিটিং করে বেকায়দায় ফেলতে পারবে? দেশকে যেমন ভালোবাসতে হবে, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে, পাশাপাশি দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সব ধর্মের সহাবস্থান ও ধর্মের প্রতি যথাযথ সম্মান। আজ সময় হয়েছে সব ধর্মের ধর্মবিশ্বাসীদের এক হয়ে নাস্তিকতাবাদের বিষবৃ উপড়ে ফেলার।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads