শুক্রবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে



 কোনো একটি বিষয় নিয়ে বেশি খেলতে গেলে নাকি নিজেদের ফাঁদেই আটকে পড়তে হয়। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে সে অবস্থাই হয়েছে আওয়ামী ক্ষমতাসীনদের। রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে ‘নতুন প্রজন্মের' সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়ে পানির বোতলের ঢিল প্রথমে খেয়েছেন সংসদে সরকারী দলের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। পরদিন ৭ ফেব্রুয়ারি পানির বোতল ছুটে গেছে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের দিকে। তিনিও ‘প্রজন্মের' ধাওয়াই খেয়েছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে এরপর কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বা ক্ষমতাসীন দলের বড় কোনো নেতা শাহবাগের ধারেকাছে যাওয়ার সাহস পাননি। সেখানে এখন সেই ‘মস্কোপন্থী'দের একচেটিয়া প্রাধান্য চলেছে, নানা কৌশলে যারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে ফেলেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী যাদের ইচ্ছা ও কথার বাইরে যেতে পারছেন না। ওদিকে পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে ট্রাইব্যুনাল বিচারপতি যাদের নিয়োজিত তাদের ভানুমতির খেলা। সেখানে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়কে  ফাঁসির আদেশে পরিণত করার চেষ্টাও জোরদার করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে ‘মেসেজ' পাঠানো হচ্ছে মাননীয় বিচারপতিদের উদ্দেশে। চাপ তৈরি করা হচ্ছে, যাতে মামলা যতোই বানোয়াট হোক না কেন এবং অপরাধ প্রমাণিত হোক বা না হোক অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের প্রত্যেককে যেন সোজা ফাঁসির আদেশই দেয়া হয়। নাম ধরে ধরেই তাদের ফাঁসির দাবি জানানো হচ্ছে। বাদ যাচ্ছেন না বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও। সরকারের কোনো ট্রাইব্যুনালের রায় ও বিচার নিয়ে সরকার বা সরকারি দল এমনটা করতে পারে কিনা এবং এভাবে চলতে থাকলে দেশে তাদের অধীনে বিচারব্যবস্থা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে কিনা- এ ধরনের অনেক প্রশ্নই ঘটনাপ্রবাহে সামনে এসে গেছে। বলা দরকার, সবকিছুর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদেরই এক কূটিল কৌশল। শাহবাগের নাটক আসলে তারাই সাজিয়েছেন। উদ্দেশ্যও অপ্রকাশিত থাকেনি। প্রধান উদ্দেশ্য বিশ্ববাসীকে জানানো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামে তারা কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য যে আদালত গঠন করেছেন সে আদালতের বিচার কার্যক্রম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবেই চলছে এবং বিচারপতিদের ওপর তারা অন্তত কোনো প্রভাব খাটাচ্ছেন না। প্রভাব খাটালে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির হুকুমই হতো। কারণ, তারা প্রথম থেকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কথাই শুনিয়ে এসেছেন। আইন প্রতিমন্ত্রী ও মাহবু-উল আলম হানিফের মতো কেউ কেউ তো জামায়াতকে একেবারে ‘খতম' করার ঘোষণাও শুনিয়েছেন। তাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে, সবকিছু ‘ঠিকঠাক' করেই নেমেছিলেন তারা। না হলে অভিযুক্তদের যে ‘ফাঁসি'র সাজাই হবে সে কথা আগে থেকে তারা বলেন কিভাবে? অভিযোগের গুরুত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডও তো হতে পারে- যেমনটি হয়েছে কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে! তাছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হলে মুক্তিও তো পেতে পারেন কেউ কেউ! কিন্তু না, অন্য কোনো সম্ভাবনার কথা বিবেচনা পর্যন্ত করতে রাজি ছিলেন না ক্ষমতাসীনরা। সোজা ‘ফাঁসি'ই দেবেন তারা, একেবারে ‘খতম'ও করে দেবেন জামায়াত নেতাদের! এ বিষয়ে প্রমাণও পাওয়া গেছে প্রথম থেকে। যেমন চার্জশিট দাখিল না করেই তারা জামায়াতের শীর্ষ চার নেতার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করিয়েছিলেন। অথচ ১৯৭৩ সালের যে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের আড়াল নিয়ে বিচারের নাটক মঞ্চায়ন করা হচ্ছে, সে আইনেরই ১১-এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে চার্জশিট দাখিল করার আগে কারো বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করা যাবে না। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা সেটাও করিয়েছিলেন এবং করিয়েছিলেনও এমন চারজনের বিরুদ্ধে, যারা আগে থেকেই বন্দী অবস্থায় ছিলেন! এর চাইতে বেআইনী কোনো কাজের কথা কল্পনা করা যায় না, যার মধ্য দিয়েও পরিষ্কার হয়েছিল ক্ষমতাসীনরা আসলেও আইনটিকে নিজেদের হাতিয়ার বানিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের আড়াল নিয়ে তারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চান।
একই কারণে দেশের ভেতরে শুধু নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ‘আন্তর্জাতিক' হিসেবে বর্ণিত ট্রাইব্যুনালের বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রথম থেকে প্রশ্ন উঠেছে। ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইমস কমিটিসহ অনেক সংস্থাই প্রতিবাদ জানিয়েছে, সংশয় প্রকাশ করেছেন, এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র‌্যাপের কাছ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর ২০১১ সালের জানুয়ারিতে হিলারি ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, তাদের দূত স্টিফেন জে র‌্যাপ তাকে জানিয়েছেন, ১৯৭৩ সালের যে আইনের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজ চলছে সে আইনটির বিভিন্ন ত্রুটি ও দুর্বলতা রয়েছে। সেগুলো সংশোধন করে আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। স্মরণ করা দরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিফেন জে র‌্যাপ বাংলাদেশ সফরকালে আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশাপাশি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও অভিযুক্তদের আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলেন। সফরের শুরুতেই তিনি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যপ্রণালী নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধ আইন ও বিধি নিয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তথা ইন্টারন্যাশনাল ‘কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসে' অনুস্বাক্ষরকারী একটি দেশ। এই স্বাক্ষর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জাতীয় বিচার সীমার মধ্যে ফৌজদারি মামলায় সুষ্ঠু বিচারের বিশ্বজনীন নীতি সমর্থন ও অনুসরণ করার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে। সে হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক যে মানদন্ড ও পদ্ধতি রয়েছে বাংলাদেশকে তা মেনে চলতে হবে। কিন্তু বর্তমানে যে আইনের ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে সেটা অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়। তার মতে অভিযুক্তকে পর্যাপ্ত আইনী সুযোগ দেয়ার ব্যবস্থাও বর্তমান আইনে নেই। স্টিফেন জে র‌্যাপের স্পষ্ট অভিমত ছিল, ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ আপিল শুনানির মতো এমন আদালত থাকতে হবে যা হবে ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মধ্যবর্তী অবস্থানে। কথাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। হিলারি সেই সাথে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখবে। হিলারি ক্লিনটনের কথার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে ধমক দেয়ার উদ্দেশ্য গোপন থাকেনি। একই ধরনের বক্তব্য এসেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকেও। কোনো কোনো সংস্থা এবং রাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে বিচারকাজ পর্যবেক্ষণও করেছে। কিন্তু কেউই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। মূলত সে কারণেই ক্ষমতাসীনরা বিচারের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার এবং তারা যে কোনো প্রভাব খাটাচ্ছেন না সেটা দেখানোর কৌশল হিসেবে শাহবাগে নাটক মঞ্চায়নের পদক্ষেপ নিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের মতো কোনো কোনোজন এমনকি প্রকাশ্যেই রায়ের বিরোধিতা করেছেন। বলেছেন এটা নাকি ‘ভ্রমাত্মক' রায়! জাতীয় সংসদের ভেতরেও ‘রায় মানি না' এবং ‘ফাঁসি চাই' বলে চিৎকার করেছেন ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন এমপি ও মন্ত্রী। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ঘোষণাও তারা শুনিয়েছেন। অথচ তাদেরই প্রণীত আইনের বিধানে বলা আছে, আপিল করতে পারবেন শুধু অভিযুক্তরা। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ রায়ের শুধু সে অংশের বিরুদ্ধেই আপিল করতে পারবে যে অংশে অভিযুক্তকে খালাস দেয়া হয়েছে। আপিল করা হলেও রায়ে যে ফাঁসির হুকুমই দেয়া হবে সে কথাটাও কারো পক্ষে জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়। অন্যদিকে তেমন প্রচারণাই চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। এর মধ্য দিয়েও পরিষ্কার হয়েছে, আসল উদ্দেশ্য তাদের বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করা এবং বোঝানো যে, ট্রাইব্যুনাল ‘স্বাধীনভাবেই' কাজ করছে। অর্থাৎ পুরো বিষয়টিকে নিয়েই অপরাজনীতি করতে চাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। তাদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্যও অতি ভয়ংকর। এভাবে বক্তব্য রাখার এবং নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে তারা জামায়াতে ইসলামীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, জামায়াত যাতে বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করে এবং ১৮ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আসে। জামায়াতকে তারা দলীয় সরকারের অধীনে নিজেদের পরিকল্পিত আগামী নির্বাচনে অংশ নিতেও বাধ্য করতে চাচ্ছেন। তাদের ধারণা, জামায়াতে ইসলামী এরশাদের জাতীয় পার্টির মতো সুবিধাবাদী ও আদর্শহীন একটি দল, যাকে চাপ দেয়া ও প্রলোভন দেখানো হলেই নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারের দাবি পরিত্যাগ করবে এবং লাফিয়ে এসে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে!
এদিকে শাহবাগ নাটকের শুরুটা ক্ষমতাসীনরা করলেও ঘটনাপ্রবাহে কিন্তু আরো একবার ‘মস্কোপন্থী'দের প্রাধাণ্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর আগেও একাধিক উপলক্ষে আমরা বলেছি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেন্দ্রিক বিতর্কের সূত্র ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে এবং ওয়াশিংটনকে একহাত দেখিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়েছেন। এমন অবস্থার পেছনে আসল কারণ হচ্ছে সরকারের ভেতরে সাবেক ‘মস্কোপন্থী'সহ বামপন্থীদের শক্তিশালী অবস্থান। বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীকে ‘মস্কোপন্থী'রা ঘিরে ফেলেছেন। উদাহরণ দেয়ার জন্য প্রভাবশালী চার মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নূরুল ইসলাম নাহিদ ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের নাম উল্লেখ করা যায়। এদের সবাই এক সময় সরাসরি ‘মস্কোপন্থী' রাজনীতি করেছেন। ছাত্র ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ এবং গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীও ‘মস্কোপন্থী' ঘরানা থেকেই এসেছেন। তাদের সঙ্গে জুটেছেন দিলীপ বড়ুয়া ও হাসানুল হক ইনুর মতো কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা। এককালের পিকিংপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননও সাবেক মস্কোপন্থীদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের আরেক সাবেক সভাপতি নূর-উল আলম লেনিন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামে ঢুকে পড়েছেন। সর্বশেষ কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এসেছেন আরও অনেক বামপন্থী। বলা হচ্ছে, সিপিবি ও ন্যাপসহ সাবেক মস্কোপন্থীরা মন্ত্রিসভায় ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থান দখল করে নিয়েছেন। সাবেক কমিউনিস্ট ও ‘মস্কোপন্থী'সহ বামপন্থীদের চাপেই প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন। রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র কেনাসহ সকল আয়োজনের পেছনেও ভূমিকা রেখেছেন ‘মস্কোপন্থী'রাই। মস্কোপন্থীদের সম্পর্কে আলোচনার প্রধান কারণ আসলে তাদের অতীত ভূমিকা। পাকিস্তান যুগে ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টি নামে দুটি দল থাকলেও মস্কোপন্থীরা সব সময় আওয়ামী লীগের ভেতরে লোকজন অনুপ্রবেশ করিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও তাদের সে কৌশল ও ভূমিকায় পরিবর্তন ঘটেনি। স্বাধীনতার পরপর মস্কোপন্থীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে ফেলেছিলেন। তাদের প্রভাব ও প্ররোচনাতেই আজীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য জেল-জুলুম খেটে আসা নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। দেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্র ঢুকে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার দিকেও মস্কোপন্থীরাই এগিয়ে নিয়েছিলেন- যা সর্বোতভাবে ছিল কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা। অথচ শেখ মুজিব বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। বলা হয়, এর মধ্য দিয়ে মস্কোপন্থীরা আসলে একটি ‘মধুর' প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। কারণ, ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পল্টন ময়দানের এক জনসভার ভাষণে মস্কোপন্থীদের প্রতি ‘সাইনবোর্ড' পাল্টানোর আহবান জানিয়েছিলেন। এর অর্থ ছিল, মণি সিং-এর কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যাতে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে এবং দল দুটির নেতা-কর্মীরা যাতে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে মণি-মোজাফফররা সত্যিই তাদের ‘সাইনবোর্ড' পাল্টে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাই বলে তারা আওয়ামী লীগে যোগ দেননি। তারা বরং অপমানের বদলা নিয়েছিলেন এবং শেখ মুজিবকে দিয়েই আওয়ামী লীগের ‘সাইনবোর্ড' পরিবর্তন করিয়ে ছেড়েছিলেন। মণি সিংদের পরামর্শেই আজীবন বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে আসা শেখ মুজিব একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এভাবেই বন্ধুত্বের ছদ্মাবরণে সে কালের মস্কোপন্থীরা শেখ মুজিবকে গণতন্ত্র বিরোধী অবস্থানে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। বর্তমানেও মস্কোপন্থীরা বন্ধু সাজার একই কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন। পিতার মতো কন্যা শেখ হাসিনাকেও তারা যে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করতে পেরেছেন তার প্রমাণ প্রথমে পাওয়া গেছে মন্ত্রিসভা ও সরকারে তাদের শক্ত অবস্থান থেকে। এরপর পাওয়া গেছে প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফর থেকে।
সর্বশেষ ঘটনা হিসেবে মস্কোপন্থীদের উদ্যোগে সাজানো হচ্ছে শাহবাগ নাটক। কথাটা বলার কারণ, সেখানে ঘটনাক্রমে ‘জয় বাংলা' স্লোগান উচ্চারিত হলেও একের এক ধাওয়া খাচ্ছেন সেই সব নেতা ‘জেনুইন' আওয়ামী লীগার হিসেবে যাদের পরিচিতি রয়েছে। বিশেষ করে যারা মস্কোপন্থী ঘরানা থেকে আগত নন। এজন্যই পানির বোতলের শিকার হয়েছেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও মাহবুব-উল আলম হানিফ। অন্য কয়েকজন নেতাকেও লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। কয়েকজনকে এমনকি মঞ্চ থেকে নামিয়ে পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারকে তো বটেই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও মস্কোপন্থীরা যথেষ্ট কষেই ইচ্ছাধীন বানিয়ে ফেলেছেন। আওয়ামী লীগও তাদের দখলে আসি আসি অবস্থায় এসে গেছে। পর্যবেক্ষকরা অবশ্য আওয়ামী লীগের বিষয় নিয়ে ততটা আগ্রহী নন। তারা উদ্বিগ্ন আসলে বিশেষ একটি কারণে। সে কারণটি হলো, বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার কৌশল হিসেবে যে ‘শাহবাগ নাটক' সাজানো হচ্ছে তার পরিণতি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের জন্যই ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। সাজেদা চৌধুরী ও মাহবুব-উল আলম হানিফরা ধাওয়া খাওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে, নেতৃত্ব এরই মধ্যে মস্কোপন্থীদের দখলে চলে গেছে। মস্কোপন্থীরা যে শুধু বিচারের রায় পাল্টানোর ধৃষ্ঠতাপূর্ণ চেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে সে কথার নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবেন না। অতীতে শেখ মুজিবের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতাকে রীতিমতো ‘ঘোল খাইয়ে' ছেড়েছে বলেই আশংকা করা হচ্ছে, ‘ঘোল' তারা প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও না খাইয়ে ছাড়বে না। সহজ কথায় বলা যায়, ক্ষমতাসীনদের নেয়া কৌশলের ওপর ভিত্তি করে মস্কোপন্থীরা পুরো বিচার প্রক্রিয়াকেই শুধু প্রভাবিত করবে না, একই সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করারও প্রচেষ্টা চালাবে। সাজেদা চৌধুরীরা ধাওয়া খেয়েছেন বলেই ধরে নেয়া যায়, তেমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী তার পাশে ‘জেনুইন' কোনো আওয়ামী লীগারকেই পাবেন না। যেদিকে তাকাবেন সেদিকে শুধু মস্কোপন্থীদেরই দেখবেন তিনি। দেশের অবস্থা তখন কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে সে কথা ভাবলে যে কাউকে ভীত-সন্ত্রস্ত হতে হবে। তবে আশার কথা হলো, দেশের রাজনীতিতে শুধু আওয়ামী লীগ এবং মস্কোপন্থীরাই নয়, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ জনপ্রিয় আরো অনেক দলও রয়েছে, যে দলগুলো নিশ্চয়ই বসে বসে চুয়িংগাম চুষবে না। তারা বরং দেশকে বাঁচানোর জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads