শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শাহবাগ নাটকে যবনিকা




ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
সরকারি আয়োজনে, সরকারি মদদে, সরকারের সহযোগিতায়, সরকারের নিরাপত্তায়, সরকারি ব্যবস্থাপনায়, সরকারি লোকদের খানাপিনায়, খাবার-পানি-টয়লেট ব্যবস্থাপনায় সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতায় শাহবাগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ১৭ দিনের এক চমৎকার নাটক। এ নাটকে তরুণ-তরুণীরা যোগ দিয়েছেন। নবদম্পতিরা যোগ দিয়েছেন। টেলিভিশন ক্যামেরার বদৌলতে শাহবাগে আগত সবাই হিরো-হিরোইন হয়ে গেছেন। সেজেগুজে সেখানে এসে হাজির হতে পারলেই হলো। আপনি হিরো বা হিরোইন। কারণ মাইক ছিল ওপেন। মাইকের কাছে পৌঁছতে পারলেই হলো। আপনি কষে রাজাকারকে গালি দিয়ে বিখ্যাত হয়ে যেতে পেরেছেন। সে রকম হিরো-হিরোইনদের শাহবাগ মঞ্চ থেকে রাত ১০টা-১১টায় ফিরতে দেখেছি। আনন্দিত, উৎফুল্ল। সাথে হয়তো ছয় মাসের ছোট্ট শিশু। তরুণ বাবা-মায়েরা অত্যুৎসাহী হয়ে বোল-না-ফোটা শিশুর গালেও লিখে দিয়েছিলেন ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’। নিজেদের গালে তো বটেই। তাদের জন্য মনে মনে করুণা হয়েছে। কী অশিক্ষাতাড়িত, কী ইতিহাস-অচেতন এই দম্পতি! কিংবা কী সাংস্কৃতিক দৈন্যে ভরা তাদের জীবন! তারা আপন শিশুকে হত্যার দাবি করতে শেখালেন। আর সরকার অবুঝ স্কুলশিশুদের শাহবাগে এনে তাদের দিয়ে বলালো যে, তারা কাদের মোল্লার ফাঁসি চায়। আর সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম, যখন দেখলাম, এই আত্মঘাতী সন্তানঘাতী, বিবেকঘাতী নাটকে দেশের দায়িত্বজ্ঞানহীন সব মিডিয়া কী কাছাখোলা উল্লাসে সমর্থন দিয়ে গেল! মিডিয়ায় কাজ করছি ৪২ বছর। কিন্তু এমন দেউলিয়াত্ব আমি কখনো দেখিনি। তবে কি আমরা যারা মিডিয়ায় কাজ করি, তাদেরই বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে?
এর কোনো মীমাংসা আমার কাছে নেই। আমি হতবুদ্ধি হয়ে প্রত্যক্ষে বা টিভি স্ক্রিনে এসব দৃশ্য দেখেছি। আর এ-ও প্রত্যক্ষ করেছি, মধ্যরাতের পর এই মঞ্চের বাইরে কী ঘটছে। তা নিয়েও অনেক হয়েছে। তার সাথে ফাঁসি চাওয়ার কোনো সম্পর্ক ছিল না। অনেকেই কেবলই আনন্দ করতে এসেছিলেন, মজা করতে এসেছিলেন। তাদের নিয়ে বেশি কথা বলতে চাই না। শাহবাগের মঞ্চে অনেক কিছুই তো হয়ে গেল। সরকার ও তাদের বাম দোসরেরা এসে সমর্থন ঘোষণা করে একেবারে ল্যাপ্টালেপ্টি হয়ে গেল। কেউ কেউ একে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে অভিহিত করতেও কসুর করলেন না। আমরা সাধারণ মানুষেরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলাম।
আসলে গত দুই যুগ ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় এমন ধস নামিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুই অবহিত হতে পারছে না। পারেনি। এখন তাদের যা জানানো হচ্ছে, তার সাথে এ দেশের মানুষের হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রামের কোনো সম্পর্ক নেই। কেন, কিভাবে আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ ঘটল, কিভাবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে আমরা আলাদা জাতি হয়ে উঠলাম, তা এখনকার প্রজন্ম কিছুই জানতে পারেনি। দোষ তাদের নয়। দোষ আমাদের, অগ্রবর্তী প্রজন্মের। জাতি না হলে কোনো জনগোষ্ঠীর মনে স্বাধীনতার আকাক্সা জাগে না। আমরা জাতি হয়ে ওঠার পর আমাদের মনে সে আকাক্সার জন্ম হয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী সব জনগোষ্ঠীর মানুষ এ অঞ্চলে একযোগে স্বাধীনতার দাবি তোলেনি। তার আগে এ দেশে বহুবিধ বিদ্রোহের ইতিহাস আছে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম কেবলই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারে জন্য অসম লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু কেন হয়েছেন, নতুন প্রজন্মকে সে কথা আমরা জানানোর প্রয়োজন অনুভব করিনি। কিংবা তত দিনে আমাদেরও সে শিক্ষা লুপ্ত হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় আমরা একসময় পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিলাম। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, এ প্রজন্মকে তা কেউ শেখায়নি। বরং তা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে অবিরাম। বর্তমান সরকার এসে তার ষোলো কলা পূর্ণ করেছে। এ সরকার ইতিহাস শুরু করে শেখ মুজিবকে নিয়ে। যেন শেষও শেখ মুজিবে। মুজিব এখন নেই। অতএব বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রয়োজনও যেন ফুরিয়ে গেছে। এই মনোভাব হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে-ওঠা একটা জাতিকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এখন কেবলই হুজুগের পূজা করা হচ্ছে। একটা হুজুগ তুলে দিয়ে তার মাধ্যমে ফায়দা লোটার চেষ্টা। শাহবাগে আমরা সে চেষ্টারই বহিঃপ্রকাশ দেখলাম। যে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ লোক ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান, সে দেশে নাকি ইসলামের নামে রাজনীতি করা যাবে না, প্রচার করা যাবে না ইসলাম ধর্ম। আল্লাহ কিংবা মহানবী সম্পর্কে কটূক্তিকারীদের সরকার হিরো বানাবে, আর এ দেশের মানুষ তা চেয়ে চেয়ে দেখবে। সংবিধান থেকে মুছে ফেলা হবে আল্লাহর নাম আর জনগণকে তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে। এমনই বিধান এখন বাংলাদেশে। ইসলামের কথা মুখে আনলেই সরকার তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মৌলবাদী মৌলবাদী বলে শোর তুলছে। আর তাই দেখলাম যে ব্লগারেরা আল্লাহ-রাসূলের বিরুদ্ধে কুৎসিত বক্তব্য প্রচার করল, সরকার তাদের বাহবা দিলো। এই ব্লগারদের একজন আবার খুন হলো অজাচারিত জীবনের জন্য। দেশের প্রধানমন্ত্রী তার বাসায় গিয়ে সমবেদনা জানালেন। যেন ওই ব্লগার দারুণ কাজ করেছে। আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে। অতএব রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তো তারই পাওয়ার কথা। সত্যিই আমাদের দেশটা আজব।
আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি যেকোনো দেশের সাধারণ মানুষই প্রতিদিন প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ায় না। কিন্তু যখন দাঁড়ায়, তখন এর একটা হিল্লা করে ছাড়ে। এর সামান্য একটা বিস্ফোরণ দেখা গেল গত শুক্রবার সারা দেশে। ওই দিন আল্লাহ-রাসূলের অবমাননার প্রতিবাদে সারা দেশের মুসলমানেরা মসজিদ থেকে জুমার নামাজ আদায় করে একযোগে প্রতিবাদে নেমেছিলেন। ইসলাম রক্ষার আন্দোলনে নেমেছিলেন। শাহবাগের আন্দোলনকারীদের যেমন জামাই আদরে সরকার তোষণ করে গেছে, তেমন জামাই আদর সে মুসল্লিরা আশা করেননি। সরকার তা করেওনি। বরং সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ গেছে পাঁচজন মানুষের। পুলিশ মসজিদের ভেতরে ঢুকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়েছে। টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে। তারপর বেধড়ক পিটিয়েছে। শত শত ধর্মপ্রাণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরেছেন। সরকার যদি ভেবে থাকে যে, এই পদ্ধতিতে তারা সাধারণ মানুষের আন্দোলনকে দমিয়ে দেবে, তাহলে বলতেই হবে যে, তারা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছে। সাধারণ মানুষের আকাক্সা এভাবে যদি দমানো যেত, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটত না। শেখ মুজিবের শাসন চিরস্থায়ী হতো। এরশাদের পতন হতো না।
সরকারের হাজারো কেলেঙ্কারিতে সারা দেশে এখন সমালোচনার ঝড় বইছে। যেখানেই যান, একই কথা, একই প্রশ্ন শুনতে পাবেন, তা হলোÑ কী হতে যাচ্ছে দেশে। সরকার সব কিছুকে একেবারে অনিশ্চিত করে ফেলেছে। ঘুষ-দুর্নীতি-কেলেঙ্কারির বিরাট বোঝা সরকারের মাথায়। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, কুইক রেন্টাল কেলেঙ্কারি, হলমার্ক-ডেসটিনির মাধ্যমে লুটÑ এগুলো বড়মাপের ঘটনা। এর বাইরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে দুর্নীতি। ছাত্রলীগকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে অবাধ টেন্ডারবাজিতে। আর সেই পুরস্কারের বিনিময়ে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে। এরা মারণাস্ত্র হাতে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে বিরোধী দল-মত দমনে যুদ্ধ করছে। এসবের মাধ্যমে সরকার দেশকে ত্রাসের জনপদে পরিণত করেছে। এ রকম এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তারা আগামী নির্বাচনেও জয়লাভ করতে চায়।
আর সে আকাক্সার অংশ হিসেবেই তারা আয়োজন করেছিল শাহবাগ নাটকের। বিরোধী দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনেক দিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। শাহবাগ নাটকের আয়োজন করে সে দাবিকে সাময়িকভাবে আড়াল করে দিয়েছিল সরকার। এটাকে তাদের সাফল্যই বলব। এ নাটক সাজিয়ে সরকার যেন শাহবাগে বিকল্প এক সরকারেরই আয়োজন বসিয়েছিল। শাহবাগ থেকে সরকারের ইচ্ছামাফিক দাবি তোলা হলো আর সরকার সে দাবি সংসদে গিয়ে পাস করে দিল। কী চমৎকার আয়োজন! মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য সরকার ট্রাইব্যুনাল বসিয়েছে। সে ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদে র রায় দিয়েছে। শাহবাগীরা দাবি তুলল, না, যাবজ্জীবন নয়, তাকে মৃত্যুদ  দিতে হবে। তা-ই যদি হয়, তাহলে তো এত তথ্যপ্রমাণ, সাক্ষী-সাবুদের দরকার ছিল না। তাদের ধরে এনে গুলি করে মেরে ফেললেই হতো। আর আদালতকে ডিকটেট করার তারা কারা? আইন অনুযায়ী সরকারও তো বিচারপতিদের ডিকটেট করতে পারে না। সেখানে শাহবাগে কিছু তরুণ জড়ো হয়ে আদালতকে আদেশ দেয়ার কে, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। শুধু আদেশ দিলো, তা-ই নয়, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের কটূক্তি করতেও কুণ্ঠা বোধ করেনি। সরকারও পাতানো সে আদেশ শিরোধার্য করে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করেছে। এখন তারা দাবি তুলেছে, শুধু জামায়াত নেতার ফাঁসি দিলেই হবে না, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকারও বলে দিল নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। এবার তারা বলছে, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেফতার করে তার বিচার করতে হবে। সাথে সাথে তাদের কথায় সুর মিলিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বললেন একই কথা। এ এক আজব পরিস্থিতি।
এ ছাড়া শাহবাগ আন্দোলনে যেকোনো একটি প্রতিবেশী দেশের মদদ ছিল, তা এখন আর অস্পষ্ট নেই। ওই দেশ থেকে দলে দলে লোক এসে শাহবাগ আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। গানবাজনা করেছে। তা নিয়ে কোনো কোনো সংবাদপত্র আবার আনন্দের আতিশয্যে ভেসে গেছে। এটাও কম দেউলিয়াত্ব নয়। ভবিষ্যতে আদালত তাহলে কী করবে? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রায় দেয়ার সময় আদালতকে জনগণের আকাক্সার কথা মনে রাখতে হবে। তার পরও কি আশা করা যায় যে, এ আদালত নিরপেক্ষ থাকতে পারবে। এ প্রশ্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরাও তুলেছেন। শাহবাগে যদি লাখো লোকেরও সমাগম হয়ে থাকে, তাদের সবাই যে রাজকারের ফাঁসি চাইতে এসেছিলেন, এমন নয়। বহুসংখ্যক মানুষ এসেছিলেন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেড়াতে। মজা দেখতে। তা ছাড়াও এর বাইরেও রয়েছে আরো পনেরো কোটি নিরানব্বই লাখ মানুষ। তারা কী চান, শাহবাগ আন্দোলনকারীদের দিয়ে তার পরিমাপ করা যাবে না।
সরকার যে পথে যাচ্ছে, তাতে জনরোষ অবধারিত হয়ে উঠছে। সে রোষ শুরু হয়ে গেলে শাহবাগ দিয়ে তার শেষ রক্ষা যে করা যাবে না, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads