মঙ্গলবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

‘আমাদের চেয়ারে এসে বসুন, আমরা চলে যাই'


    ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
 সরকারের মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সাবেক ট্রাইব্যুনাল প্রধান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপে কেলেঙ্কারির পর থেকে এখন পর্যন্ত তা যেন কিছুতেই সরল রেখায় প্রবাহিত হতে পারছে না। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যেন নিজেরাই এ বিচারের রায় ঘোষণার অধিকার রাখেন- এমনভাবে কথা বলছেন। কখনও তারাই বিচারের রায় কবে-কিভাবে দেয়া হবে সেটিও জানিয়ে দিচ্ছেন। এ নিয়ে বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনাল নানাভাবে সতর্ক করেছে। তাদের মধ্যে আছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর।
সর্বশেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ট্রাইব্যুনাল দশদিনের সময় দিয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। গত ৩১ জানুয়ারি মিসরের রাজধানী কায়রোতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক বক্তৃতায় বলেছেন, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় চূড়ান্ত। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি মামলায় ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় রায় হবে এবং ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মামলার রায় হবে। অথচ ট্রাইব্যুনাল এ ধরনের কোনো মামলায় রায়ের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেননি। বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে এটা এখন স্পষ্ট যে, সরকার সত্যি সত্যি ‘যুদ্ধাপরাধী'দের মামলার রায়ের জন্য পাগল হয়ে গেছেন।
এসব মামলার সাক্ষ গ্রহণ প্রক্রিয়াও প্রশ্নের অতীত নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে সাক্ষী হিসেবে যাদের ধরে আনা হয়েছে তাদের অধিকাংশই চোর, ছ্যাচ্চোর, বাটপার ও নারীনির্যাতনকারী। কেউ কেউ জেলখাটা আসামী। ‘অপরাধী'দের অপরাধ প্রমাণের জন্য এ পর্যন্ত কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ সাক্ষী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে লোক মুখে অভিযোগ শুনেছেন বলে দাবি করেছে। কেউ কেউ আজ বলেছেন এক কথা, কাল বলেছেন ভিন্ন কথা। আবার আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আসামীপক্ষের সাক্ষীকে অপহরণ করেও নিয়ে গেছে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা সাক্ষীর লিখিত জবানবন্দী যা লিপিবদ্ধ করে এনেছেন সেটাকেই সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। তার সত্যাসত্য যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি।
ফলে এই বিচার নিয়ে দেশে বিদেশে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এর বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এ বিচার যথাযথ প্রক্রিয়ায় হচ্ছে না। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক মান ও নীতি অনুযায়ী পরিচালনার আহবান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন। আটককৃতদের মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘের নির্যাতন বিষয়ক বিশেষ দলকে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে ওয়ার্কিং গ্রুপ। বিধি বহির্ভূতভাবে আটক রাখার জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম, মীর কাশিম আলী ও এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তি দেয়ার আহবান জানায় তারা। এর আগে গত বছর মওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লাকে আটক রাখার প্রক্রিয়া আইনসম্মত হয়নি বলে অবিলম্বে তাদের মুক্তি দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছিল ওয়ার্কিং গ্রুপ।
বাংলাদেশ মানবাধিকার সনদের স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। ফলে বাংলাদেশ যা করবে তা হতে হবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের অনুকূল। কিন্তু সরকারের গৃহীত কোনো ব্যবস্থাই সে সনদের অনুকূল নয়। এর আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে এক চিঠি লিখে অধ্যাপক গোলাম আযমকে যেন ফাঁসিতে ঝোলানো না হয়, সে বিষয়ে অনুরোধ জানায়। এদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের বার্ষিক রিপোর্টে বলেছে যে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে।
সংগঠনটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ, মানবাধিকার কর্মী ও সমালোচনাকারীদের জন্য উদার পরিবেশ তৈরি এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও তা বাস্তবায়নের কোনো রকম প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ২০১২ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়, সরকার দেশের রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের কর্মকান্ড সীমিত করে দিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন লংঘনের পরও সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে বিচারের মুখোমুখি না করে বরং রক্ষা করেছে। গুম ও হত্যার তদন্ত করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে সংশোধন করতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র‌্যাপ এবং আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা দাবি জানিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
একইভাবে নিরপেক্ষ আইনবিদ ও মানবাধিকার কর্মীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল জুরিস্টস ইউনিয়ন দাবি করেছে যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে (আইসিসি) হস্তান্তর করা হোক। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করা হচ্ছে না। এতে বিচারক কৌঁসুলী, তদন্ত কমিটি- সবকিছুই বর্তমান সরকার নিয়োগ করেছে। এবং আসামীরা সরকার বিরোধী দুটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। এমন এক অবস্থায় আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী বিচার কাজ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, রোমস স্ট্যাটুর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ যদি বিষয়টি আইসিসি'র কাছে না পাঠায়, কিংবা নিরপে  বিচার কাজ না করে, তবে জাতিসংঘ তদন্ত কমিশন গঠন করতে পারে। এবং ঐ কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়টি রোমস স্ট্যাটুর ১৩ (খ) ধারা বলে আইসিসি'র কৌঁসুলির কাছে পাঠাতে পারে। এতে ন্যায়বিচারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ১২টি সুপারিশও করা হয়েছে। আর বলা হয়, বাংলাদেশ যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সৎ থাকে, তবে তাদের উচিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করা।
বাংলাদেশের মানবাধিকার লংঘন এখন বিশ্বব্যাপী এক আলোচিত বাস্তবতা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশ ও প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে সোচ্চার। কিন্তু সরকার ধারাবাহিকভাবে মানবাধিকার লংঘন করেই চলেছে। এখন বাংলাদেশে প্রতিদিনই ঘটছে ডজন ডজন মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা। নারী নির্যাতন, শিশুর শ্লীলতাহানি, খুন, গুম এখন এখানে নিত্যদিনের ঘটনা। এসব ক্ষেত্রে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা তো দূরের কথা, বরং বহু ক্ষেত্রেই সরকার তাদের প্রশ্রয়দাতা। আর যদি একে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে এই সরকার সমর্থক হাজার হাজার লোককে বিচারের আওতায় আনতে হবে। হয়তো একদিন তা হবেও।
এ রকম পরিস্থিতিতে মানবাধিকার বিরোধী অপরাধের বিচার সরকারের তরফ থেকেই বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। কায়রোতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিচারের রায় প্রকাশের দিনক্ষণ ঘোষণা করায় বিচারকরাও বিব্রত হয়ে পড়ছেন। আদালত বলেন, এ রকম মন্তব্য ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপের সমান। ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে রাজনীতিবিদরা মন্তব্য করতে পারেন। তবে ট্রাইব্যুনালের মান ক্ষুণ্ণ হয় এমন বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য আদালত সবার প্রতি আহবান জানান। এতে ক্ষুব্ধ আদালত বলেন, ‘যারা বিচারিক বিষয়ে এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, তারা এখানে এসে বিচারকের চেয়ারে বসলে ভালো হয় এবং তাদের মধ্যে কাউকে আবার জল্লাদখানার দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা বরং বিচারকের আসন ছেড়ে চলে যাব।  কেননা তাদের বক্তব্য শুনলে মনে হয় বিচারের রায় দেয়া এবং ফাঁসিমঞ্চের দায়িত্ব তাদের দিলেই ভালো হয়।' ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল থেকে এর আগেও বেশ কয়েকবার রুল জারি করেও তাদেরকে বিচারিক বিষয়ে বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তাদেরকেই এই বিচারকের চেয়ারে বসিয়ে দিতে হবে। আমাদের বরং চলে যেতে হবে। শুধু মামলার আসামী কেন, সরকারের ভেতরে থেকে যারা বিচারিক বিষয়ে এ ধরনের বক্তব্য বা মন্তব্য করছেন, তাদের বরং কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।'
বর্তমান সরকার তার চার বছরের শাসনকালে তাদের নির্বাচনী ওয়াদার কোনোটিই পূরণ করতে পারেনি। তাদের একমাত্র সাফল্য হয়তো বিরোধী দলের উপর ফ্যাসিবাদী কায়দায় নির্যাতন ও নিপীড়ন। এই চার বছর সুশাসন ও নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য সরকার তেমন কিছুতো করতে পারেইনি, বরং নাগরিকদের জানমাল ও ইজ্জত আরও বিপন্ন করে তুলেছে। কৃষক, শ্রমিক, মজুর, সব শ্রেণীর মানুষের এখন নাভিশ্বাস উঠেছে। শিল্পাঙ্গনে বিনিয়োগ কমেছে। তাই কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানীর মাত্রাও। সরকারী সমর্থক লোকেরা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারী, ডেসটিনি কেলেঙ্কারী এবং শেয়ার বাজারের মহাকেলেঙ্কারী সবকিছুতেই সরকার লুটেরাদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। হলমার্ক ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নিলেও অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এটি কোনো টাকাই নয়। এই সামান্য অর্থে সরকারের কী আসে-যায়? শেয়ার বাজার থেকে সরকারের সমর্থক কারসাজিকাররা ৩০ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিল। সরকার কারসাজিকারদের না ধরে বিনিয়োগকারীদের পিটিয়েছে, জেল দিয়েছে, ফটকাবাজ বলে গালিগালাজ করেছে। আইন, বিচার, প্রশাসন- সকল ক্ষেত্রেই যা চলছে তার মধ্যে জনগণের মধ্যে কোনো সুখবর নেই। সুখবর তৈরি করতে হলে এখন জনগণেরই বোধ করি ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠার সময়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads