রবিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

টেন্ডারবাজি দলবাজি চাঁদাবাজি


শরফুল ইসলাম খান

তারিখ: ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার নানা প্রয়োজনে দরপত্র আহ্বান করার অফিসিয়াল নিয়মকানুন, পদ্ধতি, বিজ্ঞপ্তি, ইশতেহার সবই আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। কারণ অনভিজ্ঞ, অযোগ্য, ভুয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি দলের নেতাকর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতায় টেন্ডার দাখিল করে এবং জোর করে প্রকৃত, অভিজ্ঞ, যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেন্ডার দাখিল করা থেকে বিরত রাখে। ১০ লাখ টাকার কাজ ৬০-৭০ লাখ টাকায় অনুমোদন করে নিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থের বেশির ভাগ এসব নেতাকর্মী ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। বাস্তবে কাজ সম্পন্ন করে তৃতীয় বা চতুর্থ পক্ষ। তাতে কাজের মান বজায় থাকে না। ব্রিজ, রাস্তাঘাট, ড্রেন ইত্যাদি নির্মাণের দেড়-দুই বছরের মধ্যেই ভেঙে যায় বা ক্ষয়ে পড়ে। উত্তরা মডেল টাউনের ড্রেন ও ফুটপাথের কাজ এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। নিম্নœমানের ইট ও খোয়া এবং মাত্র ১৮-২০ ভাগ সিমেন্ট দিয়ে তারা কাজ করছে দেখে সুপারভাইজারকে কাজের মান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন, ‘আমরা সাভারের অমুক ভাইয়ের লোক। তিনি যেভাবে কাজ করতে বলেছেন, যে পরিমাণ সামগ্রী দিয়েছেন সেভাবে আমরা কাজ করছি। অভিযোগ করে লাভ হবে না। তিনি সরকারি দলের নেতার ঘনিষ্ঠ লোক।’ অনেক ক্ষেত্রে ড্রেন তৈরি না করেই সব বিল তুলে নিয়ে যায়। নির্মাণের দু-চার সপ্তাহ পরেই রাস্তা ভেঙে গেলে বা ইট-বালু ক্ষয়ে পড়লেও নির্মাতা কন্ট্রাক্টরের কোনো দায়দায়িত্ব থাকে না।
ব্রিটেনে অবস্থানকালে ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসে পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছি। ব্রিটিশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত অবস্থায় দু’টি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের প্রজেক্ট কমিটির সদস্য ছিলাম। ৬০টির মতো মিটিংয়ের পর ডাক্তার, নার্স, অফিসার, সুপারভাইজার, ইঞ্জিনিয়ার, কোয়ানটিটি সার্ভেয়ার প্রমুখ একমত হয়ে প্রজেক্ট অনুমোদন করার পরই কেবল টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এই টেন্ডার ডকুমেন্ট গ্রহণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দায়িত্ব ঘটনাচক্রে আমার ওপর ন্যস্ত হয়েছিল। কমিটির রূপরেখা অনুসারে তালিকা তৈরি করেছি। তালিকা দেখে প্রজেক্ট চেয়ারম্যান জন উইলার্স, চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, হেসে হেসে বললেন, ‘তোমার দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করেছ’। হাতে কয়েকটি শিট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই তালিকা অনুসারে নির্ভুলভাবে কাট-ছাঁট করে ১০ জনের তালিকা প্রস্তুত করে আমাকে দেখাবে।’ ‘প্রথমে বাদ দেবে যারা আমাদের মিনিয়াম কস্টের নিচে কোটেশন দিয়েছে। কারণ তারা আমাদের ডিজাইন ও চাহিদা বোঝেনি। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান অনেক কোম্পানির নাম আছে তালিকায়। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা-আরবিট্রেশন চলছে। অনেকে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জরিমানা দিয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা পেন্ডিং আছে এবং অনেকে ব্ল্যাকলিস্টেড। তাদের সরাসরি বাদ দেয়ার নির্দেশ রয়েছে।’
আমার তৈরি করা, ১০ জনের শর্টলিস্ট পেয়ে উইলার্স খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। একাধিক কোম্পানির একটা লিস্ট করে দুই দিন সারাক্ষণ ইন্টারভিউর পর সর্বোচ্চ কোটেশনদাতা কোম্পানিকে সিলেক্ট এবং ওয়ার্ক অর্ডার প্রদান করা হলো। সঠিক কোটেশানদাতাদের যুক্তি ও অভিজ্ঞতা, কাজের মুক্ত পর্যালোচনা, সমাপ্তির সময়সীমা, শ্রমিক সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে সিলেক্ট করে ছিলেন। যারা সর্বনিম্নœ কোটেশন দিয়েছেন, তারা অভিযোগ বা রিট মামলা করে নির্মাণকাজে কোনো বাধা সৃষ্টি করেননি।
বাংলাদেশে সর্বনিম্নœ দরপত্রদাতাকে কাজ না দিলে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করে বছরের পর বছর নির্মাণকাজ বন্ধ করে রাখেন। সর্বনিম্নœ মূল্যের দ্রব্য বা সামগ্রী কি আমরা ব্যক্তিগত জীবনে ব্যবহার করি? নিম্নœমধ্যবিত্ত পরিবারও সর্বনিম্ন মানের দ্রব্য ব্যবহার করে না। ব্রিজ, রাস্তাঘাট, ড্রেন, বিল্ডিং তৈরি করা হয় কমপক্ষে ২৫ বছরের জন্য। সেখানে কেন আমরা সর্বনিম্ন টেন্ডার নিয়ে মামলা মোকদ্দমা করি? এর সাথে জড়িত আছে মাস্তান এবং রাজনৈতিক নেতাদের পারসেনটেজ। সে জন্য দেখা যায়, নির্মাণের বা রিপেয়ারের তিন-চার মাসের মধ্যে রাস্তায় খানাখন্দক হয়ে রড বেরিয়ে যাচ্ছে। ব্রিজের ওপর ওঠা-নামার রাস্তায় নিচু গাড়ি আটকে যাচ্ছে বা উল্টে যাচ্ছে। অ্যাপ্রোচ রোড বানাতে পাঁচ-ছয় মাস লেগে যায়। আবার ব্রিজের পুরো অংশ তৈরি হয় না। ফলে যানজট হয় অথবা ধাক্কাধাক্কি লাগে। ব্রিজ চালু হওয়ার পরও দুই পাশের রেলিং তৈরি হয় না। বড় কোনো দুর্ঘটনার ছবি দিয়ে খবর ছাপা হওয়ার পর রেলিং দেয়া হয়।
সংবাদপত্রের হেডলাইনে দেখা যায়, টেন্ডারসন্ত্রাসীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকায় পুলিশও তাদের ভয় পায়। যেখানেই টেন্ডার সেখানেই সন্ত্রাস ঘটছে। একের পর এক খুন-জখমের ঘটনা। মাঝে মধ্যে দু-একটি ঘটনায় হচ্ছে সমঝোতা। বেশির ভাগ ঘটনার সাথে জড়িত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কিংবা যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ বা অপর কোনো অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এমন এক ঘটনায় শিকার হয়েছিলেন রাজধানীর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগ নেতা ইউসুফ। ৭ অক্টোবর ২০১০ ইস্কাটন এলাকার ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজরা প্রকাশ্যে তাকে পিটিয়ে আহত করেছিল। পরে তার মৃত্যু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে হাসপাতাল পর্যন্ত সবখানেই টেন্ডারবাজারদের অবাধ দৌরাত্ম্য। টেন্ডারবাজি দেখে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সে বছর ৬ অক্টোবর কিছু সত্য বাণী উচ্চারণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার ‘দেশ আজ বাজিকরদের হাতে’ বক্তব্যটি স্মর্তব্য এবং এর ব্যাখ্যায় তিনি যা বলেছেন, ভোটে জয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে গণতন্ত্রের মোহনীয় স্লোগানের আড়ালে বেপরোয়া আচরণ, সহজে বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার উন্মত্ততা এবং একই সাথে ভোটদানে বঞ্চিত সাধারণ নাগরিকের অসহায়ত্ব ও অব্যক্ত হাহাকারই এতে ধ্বনিত হয়েছে। প্রতি মন্ত্রণালয়ে সিন্ডিকেট, তারা খুব ক্ষমতাবান। পুলিশের নাকের ডগায় তারা হত্যা, রাহাজানি, লুট করেও মাথা উঁচু করে প্রকাশ্য বিচরণ করে। এই মাফিয়া চক্র প্রতিরোধ অপ্রিয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকি প্রথমপর্যায়ে কোনো সরকার বা সরকারপ্রধান জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে গ্রহণ করেনি। সন্ত্রাস ও অনিয়মের চারা বিগত চার দশকে বিশাল বৃক্ষের আকার ধারণ করেছে। এক হাতে এক টানে যে চারাগাছ উৎপাটন করা যেত, এখন সেই বিশাল বৃক্ষ তুলে ফেলতে হলে করাত, কুড়াল, দা, শাবল, খুন্তির প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০০৮ এর কয়েক অনুচ্ছেদ উল্লেখ না করে পারছি না :
অনুচ্ছেদ ১.১ দ্রব্যমূল্য : দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। মজুদদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে। চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে।
অনুচ্ছেদ ১.২ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা : দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদের বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনেক ওয়াদা করা হয়েছে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য। এ প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর কথোপকথন উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তার (প্রধানমন্ত্রী) তাঁবুতে মওলানা ভাসানী প্রশ্ন করেছিলেন, ‘শহীদ সাহেব, আমাদের ২১ দফা বাস্তবায়নের কী হলো? আমি তো গ্রামগঞ্জে যাই, কৃষক শ্রমিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না।’ জবাবে সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেনÑ ‘মওলানা! আপনি তো পলিটিকস বোঝেন না। টোয়েন্টি ওয়ান (২১) পয়েন্ট তো ইলেকশন দফা ছিল। এখন ইলেকশন হইয়া গেছে, এখন নয়া (নতুন) দফা হবে।’ মওলানা স্তম্ভিত হয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে যান। আমি সেই সময় তাঁবুর ভেতরে অন্যদের সাথে উপস্থিত ছিলাম। আওয়ামী লীগ ওয়াদা ভঙ্গ করার নীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে।
প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার একটা উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি। তিনি সাম্প্রতিক এক টকশোতে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেওয়ালের লেখার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলাম, ‘বঙ্গবন্ধু কঠোর হউনÑ বঙ্গবন্ধু কঠোর হউন’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘কার ওপর আমি কঠোর হবো, সবাই তো আমার লোক, আমার সন্তান।’ বঙ্গবন্ধুর ভাগ্যবতী সুযোগ্য কন্যা অন্তত পিতার সে নীতি অক্ষরে অক্ষরে কার্যকর করেছেন। এই উদারতার কুফল আমরা দেখছি। দলের প্রতি, পরিবারের সদস্যদের প্রতি, দলীয় কর্মীদের প্রতি ‘সদয়’ হওয়া অনেক ক্ষেত্রে নিদারুণ ক্ষতিকর। সস্তা জনপ্রিয়তা এবং কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনা এক নয়। সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় সময়বিশেষে কঠোর নীতি প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ‘আপনার দলীয় কর্মীরা আপনার বিভীষণ। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads