সোমবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

লাঠি চুমু খাওয়ার জন্য নয়- প্রসঙ্গ জয়নুল



একই বিষয়ের ওপর বার বার লেখালেখি করতে ভালো লাগে না। তারপরও প্রয়োজনের তাগিদে লিখতে হয়। বারবার কাউকে আঘাত করা হলে কষ্টও বারবারই হয়। জনগণের বারবার কষ্ট দেখলে সংবাদপত্রের সাথে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব হিসেবে বারবারই একই বিষয়ে লিখতে হয়। যে কোনো সমাজেই কম-বেশি সমাজবিরোধী, দুর্নীতিবাজ, আইনের ব্যত্যয় ঘটানো লোক থাকে। সেজন্য দেশেই অপরাধ দন্ডবিধি রাখা হয়েছে। সে অনুযায়ী অপরাধীদের বিচার হয়।
মানবাধিকার রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। বৃহত্তর সমাজ সদস্যদের শান্তি-নিরাপত্তার স্বার্থেই তাদের অর্থেই অপরাধ উচ্ছেদ ও অপরাধীদের দমন বাদ দিয়ে নিজেরাই অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয় এবং নিজেরাই অপরাধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জনগণের ওপর অত্যাচার ও তাদের শোষণ চালায়, তখন সংশ্লিষ্ট সমাজের মানুষ যাবে কোথায়? এভাবে জনগণের অর্থে লালিত-পালিত লোকেরা জনগণের বিপরীত অবস্থান নিলে সমাজ বিরোধীরাও যে নিজেদের দুষ্কর্মে অধিক উৎসাহী হয়ে উঠবে এবং গোটা দেশের মানুষ অতীতের ন্যায় অপরাধী ও দুর্নীতিবাজ একশ্রেণীর পুলিশের হাতে পণবন্দী হয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন সবচেয়ে বেশি ইমেজ সঙ্কটে আছে বাংলাদেশ। নেতিবাচক খবর হিসেবেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পাচ্ছে। দ্যা গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসিসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের কলুষিত চিত্র ফুটে উঠেছে। শিশুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে পুলিশ, করুণভাবে তাকিয়ে আছেন নিরপরাধ গ্রেফতারকৃতরা, আইনশৃক্মখলা বাহিনীর সদস্যরা জোর করে বন্ধ করে দিচ্ছে ছবি প্রদর্শনী-এমন অসংখ্য নেতিবাচক খবর বাংলাদেশকে নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় পুলিশের যে আচরণ দেখছে বা যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তাতে মনে হয় পুলিশ ঔপনিবেশিক আমলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনে পুলিশ এখন আরও আক্রমণাত্মক।
সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ আশা করেছিল সমাজবিরোধী দুর্নীতিবাজদের যেমন উচ্ছেদ ঘটবে, তেমনি দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ দমনের পরিবর্তে যেসব পুলিশ নিজেরাও দুর্নীতিতে লিপ্ত, আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর কাজে লিপ্ত তাদের সংশোধন ঘটবে। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের চরিত্রে কোনোপ্রকার পরিবর্তন আসেনি। তাদের অব্যাহত দুর্নীতি আর অসততার কারণেই পুরো পুলিশ বিভাগের প্রতি মানুষ আস্থা হারাতে বসেছে। অসৎ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত তদন্ত এবং শাস্তি না হওয়ায় দুর্নীতিবাজ পুলিশরা বহাল তবিয়তেই থেকে যাচ্ছে। তার ওপর যদি সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশকে পুরস্কার প্রদান করা হয় তাহলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?
বাংলাদেশের পুলিশ সংস্কার কাজে ইউএনডিপি যুক্ত  হয়েছে বেশ কয়েকবছর আগে। বাংলাদেশ সরকারকে ইউএনডিপি সহায়তা দিচ্ছে। ইউএনডিপি'র যুক্ত হওয়ার মূলনীতি ব্যাখ্যা করে ১৯ জুলাই ২০১১ ঢাকায় পুলিশ সংস্কার বিষয়ক ৩ দিনের সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইউএনডিপি'র বাংলাদেশে ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর এসকে মূর্তি তার লিখিত বক্তৃতায় বলেছেন, পুলিশের সঙ্গে আমাদের যুক্ত হওয়ার মূলনীতিটি এখানে স্পষ্ট। জাতিসংঘ মহাসচিব ২০০৮ সালে নিরাপত্তা পরিষদে তার রিপোর্টে বলেছেন, পুলিশসহ যে কোনো নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততার মূল উদ্দেশ্য হলো-রাষ্ট্র এবং সমাজে একটি কার্যকর, সমন্বিত এবং জবাবদিহি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যার মাধ্যমে নিশ্চিত হবে আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন এবং সুরক্ষিত হবে সবার মানবাধিকার। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের সম্পৃক্ততার মূলে রয়েছে মানবাধিকার সুরক্ষা, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সুযোগ এবং আইনের শাসন। আমরা মনে করি, পুলিশের প্রধান দায়িত্ব মানবাধিকার নিশ্চিত করা।
এদিকে এ প্রকল্প সম্পর্কে পলিসি ইস্যুতে বলা হয়েছে, পিআরপি'র লক্ষ্য হলো মানবাধিকার, ন্যায়বিচারের সুযোগ এবং আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা। এছাড়া পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা, বিদ্যমান আইনের সংস্কার, পুলিশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি, তদন্ত এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে দক্ষতা বৃদ্ধি, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানব পাচার রোধসহ অন্যান্য বিষয়ের কথাও বলা হয়েছে প্রকল্পের পলিসি ইস্যুতে।
২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০০৯ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে পিআরপি'র প্রথম পর্যায়ের কাজ। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর থেকে এবং চলবে ৩১ অক্টোবর ২০১৪ সাল পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকারের প্রতি পুলিশকে শ্রদ্ধাশীল করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর নেয়া পুলিশ সংস্কার প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে পুলিশ এখন বেশি আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। পুলিশ সংস্কার প্রকল্পে মানবাধিকার ইস্যুটি বুলিসর্বস্ব বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীরা। ২০০৫ সালে চালু হওয়া এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার পর এখন দ্বিতীয় পর্যায় চলছে।
পিআরপি'র প্রথম পর্যায় বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ ছিল ১২৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ ১ কোটি ৬৬ লাখ ৬৯ হাজার ৬৬৯ মার্কিন ডলার। এ অর্থায়ন করেছে ইউএনডিপি, ডিএফআইডি এবং ইউরোপীয় কমিশন। দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ হয়েছে ২১৭ কোটি টাকার সমপরিমাণ ২ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। এ অর্থায়ন করেছে ইউএনডিপি, ইউকে এইড এবং বাংলাদেশ সরকার। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২৪ জুলাই ২০১১)
পিআরপি এরই মধ্যে ৬ বছর পার করলেও মূল লক্ষ্য অর্জন অর্থাৎ পুলিশকে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রকল্প বাংলাদেশের জনগণের কোনো কাজে লাগছে না এবং এর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
২২ জানুয়ারী ২০১৩ বাংলাদেশ পুলিশের বার্ষিক সপ্তাহ উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী রাজারবাগ পুলিশ লাইন প্রাঙ্গণে প্যারেড অভিবাদন গ্রহণ করেছেন। প্রতি বছরের মতো এবারো সাহসিকতাপূর্ণ ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পুলিশ সদস্যদের পদক দেয়া হয়। তবে এবার পুলিশ পদক নিয়ে অনেক নাটকীয়তা, বিতর্কিত ও দলীয়করণ পুলিশ বাহিনীর মাঝে ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। অনেক সৎ, সাহসী ও দক্ষ কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিপিএম ও পিপিএম পদকের জন্য সারাদেশ থেকে পাঁচ শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা আবেদন করে। তন্মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ৬৭ জনকে পদক দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবারো যাচাই বাছাই করে ৯ জনকে বাদ দিয়ে ৫৮ জনকে পুলিশ পদক দেয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads