মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

জাতিদ্রোহী ‘সুশীল সমাজ’ বাংলাদেশের গ্লানি



সি রা জু র র হ মা ন

ষাট ও সত্তরের দশকে একটি বাণিজ্যিক বৃটিশ টেলিভিশন চ্যানেল প্রতি শনিবার বিকালে ‘ওয়েস্টার্ন ফিল্ম’ দেখাত। শনিবার ছুটির দিন। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে সোফার ওপর শুয়ে সে ছবিগুলো দেখতে আমার ভালো লাগত। ইতিহাস অবশ্যই ছিল। সহজ-সাধারণ কাহিনী। কোনো জটিলতা নেই। কে ভালো আর কে মন্দ ছবির শুরু থেকেই মোটামুটি আঁচ করা যেত। চিন্তা করে কাহিনী অনুধাবনের জন্য জটিলতা কিছু থাকে না এসব ছবিতে। ভালো লাগলে মনোযোগ দিয়ে দেখতাম। নইলে ঘুমিয়ে পড়তাম ছবি দেখতে দেখতে।
ঊনিশ শতকের আগে পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় অভিবাসীরা উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলের লাগোয়া অঞ্চলগুলোতেই বাস করত। বর্তমানে মধ্যপশ্চিম নামে বর্ণিত অঞ্চল থেকে শুরু করে পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এবং পাহাড়-পর্বত ও মরুভূমিপূর্ণ এলাকা মূলত রেড ইন্ডিয়ান নামে পরিচিত আদিবাসীদের বহু প্রজাতির বাসভূমি ছিল। পূর্বাংশে জনসংখ্যার ভিড় ও জমির স্বল্পতা জটিল হয়ে উঠলে শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরা দলে দলে এবং হাজারে হাজারে গরুর গাড়ির মিছিল করে ক্রমেই পশ্চিমাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বৈরী প্রকৃতি এবং রেড ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ক্রমে ক্রমে তাদের গোটা মহাদেশে বসতি স্থাপন শৌর্য-বীর্য আর রোমান্টিকতায় ভরপুর ইতিহাস। সেসব কাহিনী নিয়ে বহু ছায়াছবি তৈরি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে হলিউডে—নিশ্চয়ই কয়েকশ’ ওয়েস্টার্ন ছবি তৈরি হয়েছে এ পর্যন্ত।
বাংলাদেশে নিকটতম দৃষ্টান্ত সম্ভবত বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন চর দখল আর সেখানে চাষবাস ও বসতি স্থাপন। ছোটবেলায় শুনেছি নোয়াখালী (বর্তমানে ফেনী ও লক্ষ্মীপুরসহ) জেলার লোকেরা সদলবলে নৌকায় করে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন চর দখলে যেত। অন্য কোনো দলের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গেছে এবং জখম হয়েছে কেউ কেউ। বুনো শুয়রের দাঁতের গোত্তায় কিংবা বাঘের কামড়েও কেউ কেউ প্রাণ দিয়েছে। আরও বেশি মারা গেছে ফসল কাটতে যাওয়ার কিংবা ফসল নিয়ে মূল ভূখণ্ডে বাড়ি ফেরার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে। আমেরিকার ওয়াইল্ড ওয়েস্টেও নানাভাবে বহু নতুন বসতিকারী মারা গেছে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা ইত্যাদি ধীরে ধীরে এই নতুন বিজিত ভূমিতে বিস্তার লাভ করে অভিযাত্রীদের অনেক পরে, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এরই মধ্যে তারা নিজেরাই অবস্থামত ব্যবস্থা করে নিত। বন্দুক ছিল তাদের আইন, চটজলদি উপস্থিতমত বিচার তারা করে নিত।
অধিকাংশ ওয়েস্টার্ন ছবিতেই একটা দৃশ্য দেখা যাবে। হয়তো কেউ একজন ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিল দূরে কোথাও। এদিকে অন্য কেউ কাছাকাছি কারও লাশ পেল। ঘোড়সওয়ার লোকটাকে ধরে স্থানীয় দু’চারজন লোক উপস্থিতমত দোষী সাব্যস্ত করে ফেলল। কাছাকাছি একটা গাছ থেকে দড়ি ঝুলিয়ে তাকে ফাঁসি দিয়ে দেয়া হলো। ব্যস! বিচারের প্রক্রিয়া ওখানেই শেষ। চটজলদি, সহজ-সরল, ঝামেলাবিহীন। পারিবারিক বিরোধ থেকেও মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে বহু লোককে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এই বিচার আর এই ফাঁসিকে বলা হতো ‘লিঞ্চিং’কিছুকাল পরে শহরগুলোতে শেরিফ নিয়োগ শুরু হলো। একেকটা বিশাল টেরিটোরিতে (বর্তমানে অঙ্গরাজ্য) একজন করে বিচারপতি নিয়োজিত হতেন। ঘোড়ায় চড়ে কিংবা স্টেজ কোচে (ঘোড়ার গাড়ি) কোথাও কোথাও যেতে তার হয়তো দুই কিংবা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যেত।
কিন্তু বিচার ও শাস্তি দেখার জন্য সাধারণ মানুষ অত ধৈর্য ধরতে রাজি ছিল না। সদলবলে শেরিফের আফিসে হাজির হয়ে তারা অভিযুক্তকে তাদের হাতে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানাত, রক্তপিপাসু জনতা ‘হ্যাং হিম’, ‘হ্যাং হিম’ (ওকে ফাঁসি দাও) বলে স্লোগান দিত এবং প্রায়ই তাদের ঠেকানো শেরিফের পক্ষে সম্ভব হতো না। ইতিহাসে এই ফাঁসি-পূজারীরা ‘লিঞ্চিং মব’ নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। ফাঁসি দানের ঘটনাটা প্রায়ই একটা স্থানীয় উত্সবে পরিণত হতো। সপরিবারে লোকে দেখতে আসত, ফেরিওয়ালাদের দোকান বসে যেত, ভাঁড়-বাজিকর তাদের তামাসা দেখাত, রীতিমত একটা সার্কাসের পরিবেশ গড়ে উঠত।
প্রাণদণ্ডে বিশ্বময় ঘৃণা
লিঞ্চিংয়ের দুঃস্বপ্নের কথা নতুন প্রজন্মের মার্কিনিরা গল্প-কাহিনী কিংবা ছায়াছবি থেকেই জানে। কথায় কথায় সবচাইতে কাছের গাছটি থেকে কাউকে ঝুলিয়ে দেয়া অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। আজকের আমেরিকার অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যেই ফাঁসির দণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওয়াশিংটনের কেন্দ্রীয় সরকার পুরোপুরি প্রাণদণ্ডের বিরোধী। উত্তর আমেরিকার কানাডায় এবং ইউরোপেও শাস্তি হিসেবে কাউকে ফাঁসি দেয়া হয় না। তুরস্ক প্রভৃতি ইউরোপের বাইরের কোনো কোনো দেশেও প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ। মানুষ প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে না। জীবিত কোনো মানুষকে শাস্তি হিসেবে মেরে ফেলা এসব দেশের মানুষের মানবিক অনুভূতিকে আহত করে। আরও একটা কারণ আছে। অনেক ক্ষেত্রে পরে দেখা যায় যে আদি বিচার ও রায়ে ভুল ছিল। আসামিকে মেরে ফেলা হলে সেসব ক্ষেত্রে আর প্রতিকার সম্ভব হয় না।
মানব সমাজের এই নতুন স্পর্শকাতরতা আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলছে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো এখন আর যেসব দেশে প্রাণদণ্ড আছে সেসব দেশে বন্দী প্রত্যার্পণ করে না। শেখ হাসিনার সরকার যে বহু কূটনৈতিক তোলপাড় করে এবং লাখ লাখ ডলার ব্যয়ে একেকটি দেশে লবিস্ট নিয়োগ করেও ক্যাপ্টেন নূর এবং মুজিব হত্যার অন্যান্য আসামিকে ফেরত্ আনতে পারছে না এই হচ্ছে তার কারণ। আরও একটা কারণ আছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার পাননি বলে শেখ হাসিনার হিংস্রতা শতগুণে বেড়ে গেছে। কিন্তু যে দেশে এখনও প্রাণদণ্ড আছে এবং দরাজভাবে সে দণ্ড ব্যবহার করা হচ্ছে সে দেশের সরকার-প্রধানকে কোনো দেশ নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেবে বলে প্রধানমন্ত্রীর চেলাচামুণ্ডারা কী করে আশা করতে পারলেন ভেবে আশ্চর্য হই।
বিগত কয়েকদিনে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম এলাকাগুলোর অন্যতম শাহবাগ মোড়ের ঘটনাবলীর যেসব ছবি দেখছি আর বিবরণ পড়ছি টেলিভিশন এবং সামাজিক মিডিয়াগুলোতে তাতে আমার মনে হচ্ছে মধ্য আর পশ্চিম আমেরিকার ১৮৬০ কিংবা ৭০ দশকের ভূত একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসেছে।
আশা করি কেউ ভুল বুঝবেন না আমাকে। কাদের মোল্লার বিচার কিংবা সে বিচারের রায় নিয়ে মন্তব্য করতে যাচ্ছি না আমি। সরকার ট্রাইব্যুনাল করেছে, বিচারক নিয়োগ করেছে। সে ট্রাইব্যুনাল আর বিচার পদ্ধতি নিয়ে বহু প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। এখন সে ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছে। সে রায়ের বিরুদ্ধে শাহবাগে সার্কাস বসেছে, হ্যাং হিম-হ্যাং হিম স্লোগ্যান উঠছে, সেসব স্লোগানে চিয়ার-লিডারের ভূমিকা নিয়েছেন তথাকথিত সুশীল সমাজ, সরকারের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সমাবেশে এসে, আর বাইরে থেকে সবাইকে উসকানি দিচ্ছেন স্বয়ং আইনমন্ত্রী ও তার লেজুড় কামরুল ইসলাম প্রমুখরা।
বাংলাদেশ জ্বলছে, রক্ত ঝরছে বাংলাদেশে
পটভূমিও বিবেচনা করুন। বাংলাদেশ জ্বলছে। রক্ত ঝরছে বাংলাদেশে। দেশের সর্বত্র চলছে হরতাল-বিক্ষোভ। যানবাহন ভাংচুর হচ্ছে, সরকারের গুণ্ডাবাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাহিনী, র্যাব ইত্যাদি সবাই মিলে প্রতিবাদীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, ঘাড়ে-মাথায় রিভলবার চেপে ধরে গ্রেফতার করা লোকের ওপর গুলি করছে। দেশের অন্যত্র খুন-খারাপি হচ্ছে, গণধর্ষণ হচ্ছে, অর্থনীতির বারোটা আগেই বেজে গিয়েছিল, এসব দিকে খেয়াল দেয়ার সময় নেই কারও। বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ার ৭০-৮০ ভাগ আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ৯৫-৯৬ ভাগ সরকার ও শাসক দলের নিয়ন্ত্রিত, তাদের আজ্ঞাবহ। এসব খবর তারা টুকরো টুকরো আর ছোটখাটো করে প্রকাশ করছে। দেশের কোথায় কে কাদের মোল্লার ফাঁসি চায় তাদের খুঁজে খুঁজে তাদের বক্তব্য প্রচার করছে মিডিয়া। তাদের সবার মনোযোগ শাহবাগের সার্কাসের ওপর, যেন বাংলাদেশ বলতে ওই এক চিলতে জমিকেই বোঝায়। বাংলাদেশের সঠিক খবরের জন্য লোকে এখন ফেসবুক, ইউটিউব, ব্লগ ইত্যাদি সামাজিক মিডিয়ার ওপর নির্ভর করতে শিখছে—একাত্তরে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পত্রপত্রিকা আর রেডিও-টেলিভিশন বাদ দিয়ে ট্রানজিস্টর রেডিওতে বিবিসির খবর শুনতে শিখেছিল।
দেশব্যাপী হরতালের বর্তমান পর্বটি চালাচ্ছে রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলাম। আর আগেই বলেছি শাহবাগের সার্কাসের মূল গায়েন সরকার। বিষয় উভয়েরই এক। কাদের মোল্লার বিচারের রায়। সরকারের বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল প্রশ্নবিদ্ধ বিচার প্রক্রিয়ার পর তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। জামায়াতে ইসলাম কোনো প্রকার শাস্তিরই বিরোধী। মন্ত্রীরা বলছেন ট্রাইব্যুনালের উচিত ছিল তাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া, সে দণ্ডের দাবিতে তারা তথাকথিত সুশীল সমাজকে লেলিয়ে দিয়েছেন। এই সুশীল সমাজ বিশেষ কোনো কারণে আওয়ামী লীগের শিকারি কুকুরের পালের ভূমিকা পালন করছে। তারা মধ্য এবং পশ্চিম আমেরিকার ‘লিঞ্চিং মবের’ মতো ফাঁসি! ফাঁসি! ধ্বনি তুলে জনতাকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে নতুন স্লোগান : ‘শিবির ধরো, জবাই করো’।
অভিধানে ‘সু’-এর অর্থ দেয়া হয়েছে শুভ, সুন্দর। আর ‘শীল’ বলতে বোঝানো হয়েছে স্বভাব, চরিত্র, আচার-আচরণ ও রীতিনীতি। অর্থাত্ আভিধানিক অর্থে সুশীল বলতে আমরা বুঝব যাদের স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ ও রীতিনীতি শুভ ও সুন্দর। কাউকেই বোধকরি বলে দিতে হবে না যে আজকের বাংলাদেশে যাদের সুশীল সমাজ বলা হয় অভিধানে লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো সাধারণত তাদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। যারা ফাঁসি ফাঁসি বলে চিত্কার করতে পারে, যারা মানুষ জবাই করার হুমকি দিতে পারে, সে-সব রক্ত-পিপাসুকে আমি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের চাইতেও জঘন্য মনে করি, তারা সভ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত ভাবতে আমার গা-বমি করে।
জাতিসংঘ এখনও অবিশ্বাসী
সরকার ট্রাইব্যুনাল করেছে, বিচারক নিয়োগ করেছে। গোটা ব্যাপারটাই এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি জাতিসংঘ এখনও বলছে যে ট্রাইব্যুনালের গঠন, বিচার প্রক্রিয়া কিংবা রায় স্বচ্ছ নয়, সে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। সে রায়ে যদি সরকার সন্তুষ্ট না হয় তাহলে তারা আপিল করতে পারে। আপিলের বিধান যদি তাদের আদালত গঠনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না থাকে তাহলে সেটা ট্রাইব্যুনালের গঠনের খুঁত বলতেই হবে। আপিল না করে তারা যে জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে তার মধ্যে তাদের অসত্ অভিপ্রায় সুস্পষ্ট। বাংলাদেশে বিচার পদ্ধতিকে দলীয়করণ করা হয়েছে। তার ওপর ক্ষেপিয়ে তোলা জনতার চাপের দ্বারা আদালতের রায় যদি প্রভাবিত হয় তাহলে এ দেশ কি মনুষ্য বাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে না? দেশে সরকারের জনসমর্থন শূন্যের কোঠায়, শাহবাগ মোড়ে বিশাল একটা জনতা সৃষ্টি করে এবং দলীয় মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত প্রচার চালিয়ে সরকার কি আশা করছে যে তারা হারানো জনসমর্থনের অন্তত কিছুটাও ফিরে পাবে?
ফিল্মে দেখা আরেকটা ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল গত কয়দিনে। ত্রিশের দশকে জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে জার্মান জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলতেন, তাদের আবেগকে আকাশে তুলে দিতেন। তারপরই নির্দেশ আসত : ইহুদিদের বাড়িতে ঢিল ছোড়ো, ইহুদি ও সমকামিদের পেটাও, ইহুদি ও বামপন্থী লোকদের বই পোড়াও। আরও পরে ক্ষেপিয়ে তোলা জনতাকে দিয়ে জার্মান রাইখস্ট্যাগও (পার্লামেন্ট ভবন) পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
এসবের জের ধরেই জার্মান চিন্তানায়ক ও বুদ্ধিজীবীদের জেলে পোরা হয়েছিল, কয়েক লাখ ইহুদি, সমকামি ও উন্মাদকে বন্দী শিবিরে পাঠানো হয়, নািসবাদ জার্মানিতে গেড়ে বসে। পরবর্তী অধ্যায় আরও ভয়াবহ। নািসদের বিশ্বজয়ের বাসনা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, মানব সভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। শাহবাগ মোড়ে ৩০ মাইকে অনবরত অনল বর্ষণ থেকে ফ্যাসিবাদের বিভীষিকা কি আপনাদের চোখের সামনে ভেসে আসেনি?
আরও কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছি শাহবাগের সার্কাসে। উস্কানি দিয়ে এ সমাবেশ সৃষ্টি করেছিলেন সরকারের মন্ত্রীরা এবং আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু একপর্যায়ে দেখা গেল আওয়ামী লীগ নেতারা সমাবেশে ঢুকতে পারছেন না, মন্ত্রীদের কাউকে কাউকে তো পানির বোতল ছোড়া হয়েছিল। আরও বিস্ময় আছে। মন্ত্রীরা এবং আওয়ামী লীগ নেতারা শুক্রবারের মহাসমাবেশের পরে শাহবাগের সার্কাস ভেঙে দিতেই বলেছিলেন। অনেকে চলে গেলেও বহু লোক শাহবাগ মোড়ে থেকেই গেছে। মঞ্চের ওপর না থাকলেও মনে হচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে নেপথ্য থেকে ছাত্রলীগ। অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে এখানে। ছাত্রলীগ কি সরকারের ও আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে এসেছে? তারা কি এখন স্বাধীনভাবে এবং নিজস্ব স্টাইলে হত্যা-লুণ্ঠন, চাঁদা ও টেন্ডারবাজির নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে যাচ্ছে? ঘাদানিক ও বামপন্থীরাও এখনও শাহবাগ মোড়ের অবস্থানে আছে বলে মনে হয়। সেটা কি আওয়ামী লীগের ভেতরে ডান ও বামের ফাটল সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করে?
সরকার-জামায়াত গাঁটছড়া?
আরও বহু রকমের জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে শাহবাগের তামাশা। সরকারের আজ্ঞাবহ ট্রাইব্যুনাল কেন কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়নি? শাস্তির ব্যাপারে নরম হয়ে সরকার কি সঙ্কেত দিচ্ছে যে তারা আবারও জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত গঠন করতে, নিদেন জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে চায়? প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াতও কি সরকারের তেমন কোনো ফাঁদে পা দেবে? ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলন করার পরবর্তী কালের ঘটনাবলী থেকে কি জামায়াতের হাত যথেষ্ট পোড়েনি? কোনো শিক্ষাই কি হয়নি তাদের?
আগেই বলেছি, এ সার্কাস সৃষ্টি করেছে সরকারি নির্দেশে তথাকথিত সুশীল সমাজ। এরা আসলে মোটেই সুশীল নয়। কেননা, এদের অনেকে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী রীগের ও সে দলীয় সরকারের পক্ষে হুজুগ সৃষ্টিকারী ও গুণ্ডাবাহিনীর মতো কাজ করেছে। সেটা অপ্রত্যাশিতও নয়। আমরা জানি আজকের বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর অবাধ লীলাক্ষেত্র। পাশের দেশ ভারত অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে থাকে। তারা মোটেই গোপন করছে না যে তারা যে কোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাখতে চায়। ভারত জানে হাসিনার পরিবর্তে অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি নিজ দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতের স্বার্থের সেবা করবেন না।
ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী র’-এর অন্যূন ছয় লাখ তিন হাজার চর আছে বাংলাদেশে। তারা সব স্তরে এবং সব ক্ষেত্রে সক্রিয়— প্রধানমন্ত্রীর পারিবারিক কর্মচারীদের থেকে শুরু করে যেসব প্রশাসনিক কর্মকর্তা পররাষ্ট্র মন্ত্রক নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যেসব পুলিশ অফিসার বিরোধী দলের চিফ হুইপকে মারপিট করেন এবং বন্দী জামায়াতের সমর্থকের গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে গুলি করেন তারা অবশ্যই র’-এর চর হতে পারেন। আর যারা শাহবাগের সার্কাসের পেছনে উস্কানি দিয়েছেন ও আয়োজন করেছেন তাদের মধ্যে অবশ্যই র’-এর বহু হাজার অনুচর ছিলেন। (লন্ডন, ১০.০২.১৩)
serajurrahman34@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads