গত শনিবার এক আলোচনা সভায় বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ফরমালিন দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, খাবারে ফরমালিন দিয়ে পচা ও নষ্ট জিনিস যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, আমাদের রাজনীতিতেও সেভাবে ফরমালিন দেয়া হচ্ছে। ড. কামাল হোসেন একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক অঙ্গনের বর্তমান চালচিত্র দেখে নিজের অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানের আলোকে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। বর্তমান সময়ে রাজনীতি যেভাবে দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েছে, তাতে অনেকেই দেশের রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত। আর সাম্প্রতিক সময়ে যেহারে গুম, অপহরণ, হত্যাকা- সংঘটিত হচ্ছে তাতে জনগণ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে। নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর নির্মম হত্যাকা- আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শাসকদলের রাজনীতিকে বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের এখন মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই নায়ক না ভেবে বরং খলনায়ক ভাবতে শুরু করেছে। এ কারণেই হয়তো ড. কামাল হোসেন বলতে চেয়েছেন, পচা ও নষ্ট জিনিস ফরমালিন দিয়ে উপস্থাপন করার মত নষ্ট মানুষদের ফরমালিন দিয়ে এখন নেতা বানানো হচ্ছে। এমন চিত্র মানুষের মধ্যে কোনোক্রমেই আশাবাদ সৃষ্টি করতে পারে না।
ড. কামাল হোসেনের সমালোচনাকে স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয়, রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। সুস্থ রাজনীতির মাধ্যমেই দেশের সমৃদ্ধি ও জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু বর্তমান সময়ের দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি কাঙ্খিত সেই রাজনীতির উদাহরণ হতে পারে না। গণমুখী রাজনীতির আদর্শিক ভিত্তি থাকতে হয়। নেতা-নেত্রীদের জ্ঞানচর্চায় পুষ্ট হয়ে ত্যাগ-তিতিক্ষার উদাহরণ সৃষ্টি করতে হয়। কিন্তু এখন তো রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন বাতাবরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক অঙ্গনে সহিষ্ণুতা ও যুক্তির বদলে দমন-অবদমন, ভাঙচুর, গুম, অপহরণ ও হত্যার কৌশল এখন প্রবল হয়ে উঠেছে। আর অর্থলিপ্সা রাজনীতি ও প্রশাসনে ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়েছে। এমন সংস্কৃতি দিয়ে তো দেশের উন্নয়ন জনগণের ইচ্ছে পূরণ সম্ভব নয়। তাই ফরমালিনযুক্ত কৃত্রিম রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের বদলে এখন প্রয়োজন আদর্শনিষ্ঠ ও নৈতিক মানদ-ে উত্তীর্ণ নেতা-কর্মীর।
আদর্শের রাজনীতি তো এখন সময়ের দাবি। জনগণও এমন রাজনীতি চায়। কিন্তু এমন পরিবর্তনের সূচনা কিভাবে হবে? ভিন্নগ্রহ থেকে কেউ এসে তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করবেন না। ভিনদেশের কেউ এসে আমাদের রাজনীতির উপর ছড়ি ঘোরাবেন তাও আমরা চাই না। আমাদের কাজ আসলে আমাদেরই করতে হবে। কালান্তরের এই সময়ে নেতানেত্রীদের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে কিছু বিষয়ে জনগণের শক্ত ভূমিকা প্রয়োজন। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মোনাফেকির সাথে জড়িত কাউকেই নেতৃত্বের আসনে বসানো যাবে না। দল, মত, অঞ্চল এক্ষেত্রে যেন প্রশ্রয়ের ভূমিকা পালন না করে। রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার বদলে যারা দমন-পীড়ন ও আতঙ্ক ছড়াবে তাদের সুস্পষ্টভাবে ‘না’ বলতে হবে। আর কোনো প্রলোভনের কাছে মাথা নত না করার শপথও নিতে হবে জনগণকে। নেতানেত্রীদের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে কালান্তরের সময় এভাবেই ভূমিকা পালন করতে হয় স্বাধীন দেশের সাহসী জনগণকে। নেতানেত্রীরা ব্যর্থ হলে তো জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং মর্যাদা পড়ে যায় হুমকির মুখে। জাতীয় স্বার্থে কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের লক্ষ্যে জনগণকেই তখন যৌক্তিক পরিবেশ সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হয়। এমন পরিবেশে পথহারা নেতারা পথ খুঁজে পেতে পারেন কিংবা সৃষ্টি হতে পারে নতুন নেতৃত্বও। আর এ কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় যে, গণজাগরণের এমন বাতাবরণে ফরমালিন-নেতাদের পরাজয় অনিবার্য। তেমন সুদিনের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে জাতি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন