ফরমালিন নিয়ে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে রাজধানীর প্রবেশ পথগুলোতে ফরমালিনযুক্ত ফল আটক করার নামে গত ১১ জুন থেকে ঘোষণা দিয়ে চলছে পুলিশের অভিযান, অন্যদিকে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে ও আড়তে ফরমালিন খুঁজে বেড়াচ্ছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটরা। জরিমানা করার এবং কারাদ- দেয়ার পাশাপাশি রাজপথে যখনতখন ফলের বন্যাও বইয়ে দিচ্ছেন তারা। একযোগে অভিযোগও যথেষ্টই উঠেছে পুলিশ এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিরুদ্ধে। পুলিশ যথারীতি অভিযুক্ত হচ্ছে ঘুষবাণিজ্যের কারণে। অন্যদিকে শাহবাগসহ বিভিন্ন মার্কেটের ওষুধ ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, বৈধ কাগজপত্র দেখানো সত্ত্বেও ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে রেহাই পাচ্ছেন না তারা। অনেককে এমনকি কাগজপত্র দেখানোর সুযোগই দিচ্ছেন না ম্যাজিস্ট্রেটরা। এর ফলে অবস্থা এমন হয়েছে যখন বিএসএমএমইউ ও বারডেমের মতো হাসপাতালগুলোতে ফরমালিনের অভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে শুরু করেছে। কারণ, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রায় সব ধরনের অপারেশনেই ফরমালিনের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ে সে ফরমালিন হয় লুকিয়ে ফেলছেন বিক্রেতারা নয়তো ম্যাজিস্ট্রেটরাই সেগুলোকে ধ্বংস করে ফেলছেন।
এভাবে সব মিলিয়েই পরিস্থিতি বিপদজনক হয়ে পড়েছে। ওদিকে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ফরমালিন আমদানির ক্ষেত্রে চলছে ভয়ংকর কর্মকা-। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এ সংক্রান্ত আইনে কেবলই ‘ফরমালিন’ শব্দটি রয়েছে। এর জেনেরিক বা রাসায়নিক নাম ব্যবহার করা হয়নি। অথচ ফরমালিন ছাড়াও এর নাম রয়েছে অন্তত নয় ধরনের। এ অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। তারা ফরমালডিহাইড থেকে মিথালডিহাইড ও মরবিসিড পর্যন্ত বিভিন্ন নামে ফরমালিন আমদানি করছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, গত সাড়ে পাঁচ মাসে যেখানে মাত্র ১৯ কেজি ফরমালিন আমদানি করা হয়েছে সেখানে অন্য বিভিন্ন নামের আড়ালে একই ফরমালিন আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার টন! গত বছর ২০১৩ সালেও ফরমালিন আমদানির ক্ষেত্রে একই চিত্র দেখা গেছে। ফরমালিন নামে ১১ হাজার টন আমদানি করা হলেও অন্য নামগুলোর আড়ালে আমদানি করা হয়েছিল ১১ হাজার টনেরও বেশি। বিষয়টি সম্পর্কে সব জানলেও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কিছুই করতে পারছেন না। কারণ, সরকার যে আইন করেছে সে আইনে কেবল ফরমালিনের ওপরই নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ফলে সব জেনে-বুঝেও কাস্টমস কর্মকর্তারা নীরব থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। উদ্বেগের কারণ হলো, অসাধু এবং টাউট ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা শুধু অন্য নামে ফরমালিন আমদানি করেই বসে থাকছে না, তারা একই সাথে সেগুলোকে বাজারেও ছড়িয়ে দিচ্ছে। তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, ফরমালিন আসলে ফরমালডিহাইডের ৪০ শতাংশ জলীয় দ্রবণ। ৪০ শতাংশ ফরমাল ডিহাইডের সঙ্গে ৬০ শতাংশ পানি মেশানো হলেই তা ফরমালিনে পরিণত হয়। সে কাজটুকুই এখন করছে ব্যবসায়ীরা। তারা এমনকি এক কেজি ফরমালডিহাইড দিয়ে ২৫ কেজি ফরমালিন তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত বা অন্য কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছেন না। কারণ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ও ছাড়পত্র নিয়ে ফরমালডিহাইড ধরনের পণ্যগুলো আমদানি করা হচ্ছে শতভাগ রাসায়নিক যৌগ হিসেবে। সেটাকেই ফরমালিন বানিয়ে বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে সরকারের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। পুলিশও ঘুষবাণিজ্যের বাইরে ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সব মিলিয়েই ফরমালিন সংক্রান্ত পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বেছে বেছে ঠিক মধু মাসে এসে ফলের ভেতরে ফরমালিন খুঁজে বেড়ানোর জন্য জানান দিয়ে অভিযান চালানোর মতো পদক্ষেপ একদিক থেকে প্রশংসাযোগ্য হলেও মুদ্রার অন্যপিঠও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আইন যারা তৈরি করেছেন তাদের অবশ্যই জানা থাকা দরকার ছিল যে, ফরমালিনের আরো কিছূ জেনেরিক বা রাসায়নিক নাম রয়েছে। সে কারণে কেবলই ফরমালিন শব্দটি ব্যবহার না করে আইনে অন্য নামগুলোরও উল্লে¬খ করা কর্তাদের দায়িত্ব ছিল। সেটা করা হলে কোনো ব্যবসায়ী বা আমদানিকারকের পক্ষেই হাজার হাজার টন ফরমালিন আমদানি করা সম্ভব হতো না। বিপন্ন হতো না মানুষের জীবনও। অমরা তাই এ সংক্রান্ত আইনটিকে সংশোধন করার এবং সংশোধিত আইনে ফরমালিনের প্রতিটি জেনেরিক বা রাসায়নিক নাম যুক্ত করার দাবি জানাই। এর কাছাকাছি আরো কিছু নাম থাকলে আইনে সেগুলোরও উল্লে¬খ করতে হবে। আমরা চাই, আইনের কোথাও যেন কোনো ফাঁক না থাকে। যাতে আইনের ফাঁক গলিয়ে কারো পক্ষেই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন বা অন্য কোনো রাসায়নিক আমদানি ও বাজারজাত করা সম্ভব না হয়। সরকারকে একই সঙ্গে অভিযানের নামে ঘুষবাণিজ্য এবং ধ্বংসের ঢালাও অভিযানও বন্ধ করতে হবে। হাসপাতালের চিকিৎসা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে বিশেষ নজর রাখাটাও সরকারের কর্তব্য বলে আমরা মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন